ভারতীয় ধর্মগ্রন্থগুলির মধ্যে বেদ ও গীতার পরই মনুসংহিতার স্থান নির্দেশ করা হয়। ভারতীয় ঋষিদের বিশ্বাস- মনুসংহিতায় সমস্ত বেদের অর্থ নিহিত রয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দণ্ডবিধি প্রভৃতির বিচিত্র আধার এই গ্রন্থটি। এ ধরনের ধর্মশাস্ত্র সাধারণত ‘স্মৃতিশাস্ত্র’ নামে অভিহিত এবং এই স্মৃতিশাস্ত্র-প্রণেতাদের মধ্যে মনুই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে পরিগণিত হয়ে আসছেন। ইতিহাসে ১৪ জন মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়। এরমধ্যে বৈবস্বত মনু হচ্ছেন অন্যান্য ধর্মগ্রন্থসহ কোর’আনে বর্ণিত নুহ (আ:)। একটি মহাপ্লাবনে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে আবার বৈবস্বত মনু থেকে শুরু হয়েছিল, তাই হিন্দুধর্মশাস্ত্রে মনুকে মানবজাতির আদিপিতা বলে অভিহিত করা হয়। ঋগ্বেদে এবং প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে নানা প্রসঙ্গে মনুকে মনুষ্যজাতির জনক আদিপিতা, পুরাতন ঋষি, অগ্নিদেবের সংস্থাপক, অর্থশাস্ত্রের প্রণেতা, কৃতযুগের রাজা প্রভৃতিরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদের ঋষি বোলছেন- “প্রজাপতি (ব্রহ্মা) মনুকে উপদেশ দিয়েছিলেন এবং মনুই প্রজাদের মধ্যে তা প্রচার করেন।” তাঁর উপরই আল্লাহ সর্বপ্রথম ধর্মগ্রন্থ নাযেল করেন যার নাম বেদ। বেদের ধারক এবং মনুর অনুসারীরাই বর্তমানে হিন্দু বা সনাতন ধর্মী হিসাবে পরিচিত।
অনেকে অভিযোগ করেন, মনুসংহিতা একটি নারীবিরোধী গ্রন্থ। এ প্রসঙ্গে আলোচনার আগে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, পণ্ডিত ও বিদ্বান সমাজ একথা বহুবার স্বীকার কোরেছেন যে, সনাতন ধর্মশাস্ত্রের একটি গ্রন্থও তার সঠিক অবস্থানে নেই। মনুসংহিতাতেও বহু প্রক্ষিপ্ত অংশ রয়েছে। অনেক সময় স্বার্থান্বেষী পুরোহিতরা নিজেদের পক্ষে ধর্মকে টানার জন্য ঐশী গ্রন্থে বা ঐশী শিক্ষামূলক গ্রন্থে নিজেদের মনগড়া কথাকে ঈশ্বরের বাণী বলে ঢুকিয়ে দেয়। শ্লোক রচনার গঠন রীতির আধুনিকতা ও প্রাচীনতা বিবেচনা করে এই জাল শ্লোকগুলো আলাদা করা খুব কঠিন কিছু নয়। এই জাতীয় অপকর্মে কোনো ধর্মের পুরোহিতরাই পিছিয়ে নেই। ইসলাম ধর্মের পুরোহিতরা কোর’আনে কিছু পরিবর্তন করতে পারেন নি, কারণ এই মহাগ্রন্থ শেষ ঐশীগ্রন্থ। তাই আল্লাহ নিজে এর সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন (সুরা হিজর ৯)। কিন্তু হাদিস বা ইতিহাস, মাসলা মাসায়েল বা ফেকাহ শাস্ত্র সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ নেন নি। সেখানে এই পুরোহিত আলেম ওলামা, মাজহাবের এমাম সাহেবরা তাদের ক্ষুরধার মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন এবং দীনের মধ্যে নিজের মনগড়া হাজারো মতবাদ, জাল হাদিস, ইজমা, কেয়াস, ফতোয়া প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন। প্রাচীন ধর্মগুলির সকল গ্রন্থই এভাবে বিকৃত হয়ে গেছে। তবুও সেগুলির মধ্যে যে শিক্ষা এখনো সঞ্চিত আছে তা বিচার করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে প্রায় সকল ধর্মই ভিন্ন ভিন্ন ডালে উৎপন্ন একই গাছের ফল।
কেবল যে স্বার্থসিদ্ধির জন্যই ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে শ্লোক প্রক্ষিপ্ত করা হয়েছে তা বলা ভুল হয়। অনেক মুনি ঋষি পণ্ডিত মানবতার কল্যাণেও অনেক নীতিবাক্য শাস্ত্রের অঙ্গীভূত করে দিয়েছেন। তারা নিজের নাম, যশ, খ্যাতি চান নি, বরং অন্যের লেখার মধ্যে নিজের শ্রমসাধ্য রচনাগুলিকে প্রবেশ করিয়ে অমরত্বের আনন্দ লাভ করতে চেয়েছেন। এভাবে মহাভারত রামায়ণ প্রভৃতি মহাকাব্য দিনে দিনে বৃহদায়তন হয়ে উঠেছে। আদি মনুসংহিতা শাস্ত্রটি অধ্যয়ন করলে যে কেউ বুঝতে সক্ষম হবেন যে, পৃথিবীতে নারীকে মর্যাদা দানে মহর্ষি মনুর প্রচারিত শিক্ষা এতো চমৎকার যে কেবলমাত্র সত্যধর্মেই এমন বিধান থাকা সম্ভব। এমনকি মনুসংহিতার ভাবধারার সাথে খাপ খাওয়াতে হলে অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক নারীবাদীদের চিন্তাধারারও উন্নয়নের প্রয়োজন। আমরা এখন এমন একটি শ্লোক পড়ব যার অর্থ দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করে যে নারীরাই হচ্ছে কোন উন্নত সমাজের ভিত্তিস্বরূপ। এটি নারীদের প্রতি কোন চাটুকারিতা বা তোষামোদি নয়। এটি এমন একটি সত্য যা নারীবিদ্বেষীদের কাছে বিষের মতো, আর নারীশক্তির মহিমা কীর্তনীয়াদের কাছে অমৃতস্বরূপ। প্রকৃতির এই নিয়ম পরিবার, সমাজ, ধর্মগোষ্ঠী, জাতি বা সমগ্র মানবতার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। যারা হিন্দুধর্মকে নারী-পীড়ক বলে দোষারোপ করেন, তারা কখনোই এই শ্লোকের উদ্ধৃতি দেন না। এই শ্লোকগুলি মনুসংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ে (ধর্মসংস্কার প্রকরণ) উল্লেখিত হয়েছে। আমি কয়েকটি শ্লোকের উদাহরণ দিচ্ছি।
পিতৃভির্ভ্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভির্দেবরৈস্থা।
পূজ্যা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহুকল্যাণকামীপ্সুভিঃ॥ (৩/৫৫)
যত্র নার্য্যস্ত পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ॥ (৩/৫৬)
শোচন্তি জাময়ো যত্র বিনশ্যন্ত্যাশু তৎ কুলম্।
ন শোচন্তি তু যত্রৈতা বর্দ্ধতে তদ্ধি সর্বদা॥ (৩/৫৭)
জাময়ো যানি গেহানি শপন্ত্যপ্রতিপূজিতাঃ।
তানি কৃত্যাহতানীব বিনশ্যন্তি সমন্ততঃ॥ (৩/৫৮)
তস্মাদেতাঃ সদা পূজ্যা ভূষণাচ্ছদাশনৈঃ।
ভুতিকামৈর্নরৈর্নিত্যং সৎকারেষুৎসবেষু চ॥ (৩/৫৯)
অনুবাদ:
১. বিবাহের সময় বরই কেবল কন্যাকে ধন দেবেন এমন নয়। বিবাহোত্তরকালেও বরের পিতা, ভাই, পতি বা দেবর সকলেই যদি অতুল কল্যাণরাশির অভিলাষী হয় তাহলে ঐ কন্যাদের মৃদুবাক্য, ভদ্র ব্যবহার, ভোজনাদি ও উপহারাদি দ্বারা সর্বদা খুশি ও সন্তুষ্ট রাখবেন এবং বস্ত্র-অলঙ্কারাদির দ্বারা ভূষিত করবেন।
২. যে বংশে স্ত্রীলোকেরা বস্ত্রালঙ্কারাদির দ্বারা সমাদৃত হন, সেখানে দেবতারা প্রসন্ন থাকেন। আর যে বংশে স্ত্রীলোকদের সমাদর নেই সেখানে সমস্ত ক্রিয়া (প্রার্থনা, উপাসনাদি) নিষ্ফল।
৩. যে বংশে ভগিনী ও গৃহস্থের স্ত্রী (নারীকূল) পুরুষদের কৃতকর্মের জন্য দুঃখিনী হয়, সেই বংশ অতি শীঘ্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
৪. আর যে বংশে স্ত্রীলোকেরা সন্তুষ্ট থাকে, সেই বংশ নিশ্চিতভাবেই শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। আর যে বংশকে উদ্দেশ্য করে ভগিনী, পত্নী, পুত্রবধূ প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা অনাদৃত, অপমানিত হয়ে অভিশাপ দেন, সেই বংশ বিষপান করা ব্যক্তির ন্যায় ধন-পশু প্রভৃতিসহ সর্বতোভাবে বিনাশপ্রাপ্ত হয়।
৫. অতএব যারা ভূতি অর্থাৎ ঐশ্বর্য কামনা করে, তারা (পতিসম্বন্ধীয় লোকেরা) বিভিন্ন সৎকার্যের অনুষ্ঠানে এবং নানা উৎসবে উত্তম অলঙ্কার, বস্ত্র ও ভোজনাদি দ্বারা স্ত্রীলোকদের সম্মান প্রদর্শন (পূজা) করে প্রীত রাখবে।
সুতরাং পরিবারের সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধির জন্য নারীকে সর্বদা সুখী রাখতে হবে – এটাই মহর্ষি মনুর নির্দেশ। পাশাপাশি তিনি স্বামীর মনোরঞ্জন ও ভালোবাসা পাওয়ার জন্য স্ত্রীলোকদেরকে সুন্দর পোশাক ও অলঙ্কারে সুসজ্জিত ও দীপ্তিমতী হয়ে থাকার জন্য উপদেশ দিয়ে বলেছেন:
স্ত্রিয়ান্তু রোচমানায়াং সর্বং তদ্রোচতে কুলম্।
তস্যান্ত্বরাচমানায়াং সর্বমেব ন রোচতে। (৩/৬২)
অনুবাদ: ভূষণাদির দ্বারা স্ত্রী সুসজ্জিত থাকলে সমস্ত পরিবার (কুল) শোভামণ্ডিত থাকে। আর স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যদি রুচি না থাকে তাহলে সমস্ত পরিবার শোভাহীন হয়ে পড়ে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা মহর্ষী মনুর লিপিবদ্ধ বাণী মনুস্মৃতিকে নারী বিদ্বেষী গ্রন্থ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে রেখেছেন। ‘মনু’ শব্দ থেকেই মানুষ, মনুষ্যত্ব, মানবতা শব্দের উৎপত্তি। তাই মহর্ষী মনুর বাণীগুলি কেবল নারী বা পুরুষ নয়, মানবতার জয় প্রচার করে। মানবসমাজের প্রাণ হচ্ছে নারী সমাজ। তাদের মাধ্যমেই মানব প্রজাতির বংশধারা, প্রজন্ম রক্ষিত হয়। এজন্য তাদের বিশেষ সম্মান প্রাপ্য। তিনি বলেন:
প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ।
স্ত্রিয়ঃ শ্রিয়শ্চ গেহেষু ন বিশেষোহস্তি কশ্চন (৯/২৬)
অর্থাৎ, স্ত্রী লোকেরা সন্তানাদি প্রসব ও পালন করে বলে তারা অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী। তারা গৃহের দীপ্তি বা প্রকাশস্বরূপ। এই কারণে স্ত্রীলোকদের সকল সময়ে সম্মান-সহকারে রাখা উচিত। বাড়ীতে স্ত্রী আর শ্রী এদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
আজও ভারতবর্ষে মহর্ষি মনুর এই শ্লোক থেকেই শিক্ষা নিয়ে মেয়েদের ভাগ্যশ্রী বা গৃহলক্ষ্মী বলা হয়। এর একটি কারণ হিসাবে টিকাকার মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন স্ত্রীলোক বাড়িতে না থাকলে কুটুম্ব বা আত্মীয়বর্গের আদর-আপ্যায়ন কিছুই হয় না। পুরুষের ধনৈশ্বর্য থাকলেও যদি ভার্যা না থাকে, তাহলে বাড়ীতে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনেরা উপস্থিত হলে গৃহস্বামী নিজে তাদের প্রত্যেককে পান-ভোজনাদির দ্বারা আপ্যায়িত করতে পারেন না। অন্যকথায়, মাতৃরূপে, কন্যারূপে, স্ত্রীরূপে, ভগ্নীরূপে কিংবা ধর্মকর্মে অংশীদাররূপে নারীরাই সকল কল্যাণের মূল উৎস বলে মহর্ষি মনু প্রতিপাদন করেছেন।
অন্যোন্যস্যাব্যভিচারো ভবেদামরণান্তিকঃ।
এষ ধর্মঃ সমাসেন জ্ঞেয়ঃ স্ত্রীপুংসয়োঃ পরঃ ॥ (৯/১০১)
অর্থাৎ স্ত্রী এবং পুরুষের শ্রেষ্ঠকর্তব্য সম্বন্ধে এই কথাই সংক্ষেপে বলা যায় যে, মরণকাল পর্যন্ত ভার্যা ও পতি পরস্পর পরস্পরের প্রতি ব্যভিচার অর্থাৎ অন্যায় আচরণ করবে না।
এখানে কোন বিশেষ অর্থ না দেখিয়ে সাধারণভাবে ‘অব্যভিচার’ বলা হয়েছে। সুতরাং এর দ্বারা সকল কাজে অব্যভিচার করতে বলা হয়েছে অর্থাৎ কোনো কাজই উভয়ের একজন আর একজনকে ছেড়ে করতে পারবে না। এইজন্য আপন্তম্ব বলেছেন, ‘ধর্ম, অর্থ এবং কাম কোনো কাজেই পত্নীকে লঙ্ঘন করা অর্থাৎ তাকে বাদ দেওয়া যাবে না।’ ধর্ম, অর্থ, কাম এগুলি শ্রেয়ঃ, এই তিনটিকে বলা হয় ত্রিবর্গ। নারী ও পুরুষ একে ভিন্ন অপরে অসম্পূর্ণ। এজন্য বেদে (শ্রুতি) বলা হয়েছে ধর্মকর্ম পত্নীর সাথে মিলিতভাবে কর্তব্য। (মনুসংহিতা ৯/৯৬)
বৈদিক ধর্মের এই শিক্ষা থেকেই নারীকে বলা হয় পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী ও সহধর্মিনী। এই শ্লোকটির কথা একবার ভেবে দেখুন। নারী ছাড়া পুরুষ অসম্পূর্ণ একথা ইসলাম ধর্মেও বলা হয়েছে। তাই নারী ছাড়া পুরুষের ধর্ম সম্পূর্ণ হয় না। তাই আল্লাহর বিধান হচ্ছে ঘরে এবং মসজিদে নারী ও পুরুষ উভয়ে একই সঙ্গে নামাজ পড়বে, একই সঙ্গে হজ্ব করবে, সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একই সঙ্গে অংশ নেবে। এবার নারীদের স্বাতন্ত্রের কথায় আসা যাক। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা মানে উশৃঙ্খলা নয়, স্বাতন্ত্র্য মানেই ঔদ্ধত্য নয়।
অরক্ষিতা গৃহে রুদ্ধাঃ পুরুষৈরাপ্তকারিভিঃ।
আত্মনমাত্মনা যাস্তু রক্ষোয়ুস্তাঃ সুরক্ষিতাঃ। (৯/১২)
অর্থাৎ যে স্ত্রী দুঃশীলতা হেতু নিজে আত্মরক্ষায় যত্নবতী না হয়, তাকে পুরুষগণ ঘরে আটকে রাখলেও সে অরক্ষিতা (Are not well guarded) থাকে। কিন্তু যারা সর্বদা আপনা-আপনি আত্মরক্ষায় তৎপর, তাদের কেউ রক্ষা না করলেও তারা সুরক্ষিতা হয়ে থাকে।
সুতরাং স্ত্রীলোকদের গৃহবন্দী করে রাখা ধর্মের উদ্দেশ্য নয় এবং সতীত্ব রক্ষার্থে সেটা অকার্যকর উদ্যোগ। স্ত্রীজাতির নিরাপত্তা প্রধানত তাদের নিজস্ব মনোভাবের উপর নির্ভরশীল। কীভাবে নারীর চরিত্র দূষিত হয় এবং সে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা বলা হয়েছে পরবর্তী শ্লোকে।
পানং দুর্জনসংসর্গঃ পত্যা চ বিরহোহটনম্।
স্বপ্নোহন্যগেহবাসশ্চ নারীসংদূষণানি ষট্॥ (৯/১৩)
অর্থাৎ মদ্যপান, দুষ্ট লোকের সঙ্গে মেলামেশা করা, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ, যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো, অসময়ে ঘুমানো এবং আত্মীয় কুটুম্বের বাড়িতে দীর্ঘদিন বাস করা এই ছয়টি বিষয় স্ত্রীলোককে দূষিত করে।
নারীদের প্রতি সামাজিক শিষ্টাচার ও সম্মান প্রদর্শনের যে রীতিও মনুসংহিতায় উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন:
১. নববিবাহিতা বধূ, কন্যা এবং গর্ভবতী মহিলাদের অতিথি ভোজনের পূর্বেই ভোজন প্রদান করতে হবে। (৩/১১৪)
২. বাহনে বা যানে আরোহী ব্যক্তির পক্ষে বয়স্ক ব্যক্তি, ক্লান্ত ব্যক্তি, ভারবাহী ব্যক্তি, বর, রাজা, স্নাতক এবং স্ত্রীলোকদের পথ ছেড়ে দেয়া কর্তব্য।” (মনুসংহিতা ২/১৩৮)
নারী নির্যাতনের দণ্ডবিধান:
১. নারী অপহরণকারীদের মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। (৮/৩২৩)।
২. যারা নারী, শিশু ও গুণবান পণ্ডিতদের হত্যা করে, তাদের কঠিনতম শাস্তি দিতে হবে।” (৯/২৩২)
৩. যারা অন্যের স্ত্রীকে ধর্ষণ করে বা করতে প্রবৃত্ত হয় বা তাদের ব্যাভিচারে প্ররোচিত করে তাদের এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে তা অন্যদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে এবং কেউ তা করতে আর সাহস না পায়।” (৮/৩৫২)
৪. যদি কেউ মা, স্ত্রী বা কন্যার নামে মিথ্যা দোষারোপ করে তবে তাকে শাস্তি দিতে হবে।” (৮/২৭৫)
৩. যদি কেউ কোন ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া মা, বাবা, স্ত্রী বা সন্তান ত্যাগ করে, তাকে কঠিন দণ্ড দিতে হবে। (৮/৩৮৯)।
৪. যদি কোন নারীকে সুরক্ষা দেবার জন্য পুত্র বা কোন পুরুষ পরিবারে না থাকে, অথবা যদি সে বিধবা হয়ে থাকে, যে অসুস্থ অথবা যার স্বামী বিদেশে গেছে, তাহলে রাজা (শাসক) তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। যদি তার সম্পত্তি তার কোন বন্ধু বা আত্মীয় হরণ করে, তাহলে রাজা দোষীদের কঠোর শাস্তি দেবেন এবং সম্পত্তি ঐ নারীকে ফেরত দেবেন।” (মনুসংহিতা ৮/২৮-২৯)
উপরোক্ত প্রতিটি বিষয়ে ইসলামেরও কঠোর দণ্ডবিধি রয়েছে যেগুলি উল্লেখ করলে কলেবর বৃদ্ধি পাবে তাই সেদিকে যাচ্ছি না। আমার উপরোক্ত আলোচনার সারাংশ হচ্ছে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অনেকেই তাদের ধর্মে প্রবিষ্ট অসীম বিকৃতি দেখে ধর্মবিদ্বেষী হয়ে গেছেন। তাদেরকে বুঝতে হবে যে, ভারতবর্ষে আগত সনাতন ধর্মমত পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম যার ধারাবাহিকতায় সর্বশেষে এসেছে ইসলাম। কিন্তু মূল ধর্ম একই, উৎসও একই। অতীতের গ্রন্থ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় নতুন অবতার নতুন গ্রন্থ এনেছেন কিন্তু তারা নতুন কোনো ধর্ম নিয়ে আসেন নি। নতুন ধর্ম সৃষ্টি করেছে মানুষ। একজন মুসলিমের ঈমানের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ হচ্ছে পূর্বের সকল নবী রসুল ও তাঁদের উপর অবতীর্ণ কেতাবগুলির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। এই হিসাবে ভারতবর্ষে আগত যেসব অবতার, মহামানব ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের মাঝে সত্যের আলোকচ্ছটা দৃষ্ট হয় তাদের সকলের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা, ভক্তি জ্ঞাপন করা মুসলমানদেরও কর্তব্য।