সামনে একাদশতম সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে চারদিকে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। পাড়ায় পাড়ায়, চায়ের দোকানে, গলির মোড়ে সকল জায়গাতেই আলোচনার মুখ্য বিষয় নির্বাচন। মনোনয়নপ্রাপ্ত দলগুলোও চালাচ্ছে ব্যাপক প্রচারণা। প্রার্থীরা সুবিধাবঞ্চিত জনগণকে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আদায় করে নিচ্ছে নিজেদের ভোট।
কিন্তু সব কিছুর আড়ালেও বড় সত্য হচ্ছে উৎসবমুখর পরিবেশের মাঝেও আতংকে আছে সাধারণ জনগণ। কারণ আমরা দেখেছি যে প্রত্যেকবারেই নির্বাচনের নামে কী পরিমাণ সহিংসতার স্বীকার হতে হয় সাধারণ জনগণকে। নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সহিংসতা যেন দেশের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হত্যা, গুম, লুটপাট ইত্যাদি যেন নির্বাচনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অমীমাংসিত বিষয়গুলোই আবারও সামনে আসতে শুরু করেছে।
দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২২ বছরে প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ৫১৯ জন, আর একই সময়ে কম-বেশি আহত হয়েছেন দেড় লাখ মানুষ। রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন, হরতাল, অবরোধ, নির্বাচনী সহিংসতা এবং দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যমের জরিপ অনুযায়ী, প্রত্যেক সরকারের শাসনামলে সহিংসতা ঘটেছে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের বিএনপির শাসনামলে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছে ১৭৪ জন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ গেছে ৭৬৭ জনের। পরবর্তী ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে ৫ বছরে বিএনপির সরকারের শাসনামলে নির্বাচনী হত্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭২ জনে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালে মারা গেছে ৫৬৪ জন মানুষ। এদের মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে জনসাধারণ। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকারের’ হিসাবে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি। অধিকার বলছে, শুধু ২০০১ সাল থেকে ২০১৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ৯২৬ এবং আহত হয়েছেন ১ লাখ ৫৮ হাজার ২১১ জন। এর মধ্যে ২০০১ সালেই মারা গেছেন ৬৫৬ জন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ১৯৮ আর ২০১৬ সালে নিহত হয়েছেন ৬৪ জন। মানবাধিকার সংগঠন ‘আসক’ এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৬৬৪টি রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে, যাতে নিহত হয়েছেন ১৪৭, আর আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৩৭৩ জন। এদিকে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এক বিবৃতিতে জানায়, ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সহিংসতায় ১৪৯ জন নিহত এবং ৪ হাজার ৮৮৬ জন আহত হন।
গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন সহিংসতায় নিহত হয়েছিলেন ১৯ জন। নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতার দিক থেকেও এ নির্বাচন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও ইউপি নির্বাচনেও সহিংসতা পিছিয়ে নেই। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনী সহিংসতা। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর তথ্য মতে, ইউপি নির্বাচনের প্রথম ধাপেই নিহত হয় ১০০ এর বেশি মানুষ। সুজনের দাবি, এর আগে ১৯৮৮ সালের নির্বাচন সবচেয়ে বেশি সহিংসতাপূর্ণ ও প্রাণঘাতী ছিল। ওই নির্বাচনে ৮০ জনের প্রাণহানি হয়।
তবে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার সবচেয়ে নির্মম অধ্যায়টি রচিত হয় ২০১৫ সালে, পেট্রল বোমাবাজীর মাধ্যমে। নিরাপরাধ জনগণকে বাসের মধ্যে পেট্রল বোমা মেরে ঝলসে দেওয়ার ঘটনাগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে আছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আরেকটি কালো অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে কিনা সেটাই সুস্থচিন্তার মানুষের সামনে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে! এর শেষ কোথায় তা বুঝতে হলে ইরাক সিরিয়া লিবিয়ার দিকে তাকানোই যথেষ্ট। ক্ষমতার অধিকার নিয়ে রাজনৈতিক গোলোযোগ একটি দেশকে শেষ পর্যন্ত এমন জায়গাতেই নিয়ে যায় যে তখন আর কারো পালানোর পথ থাকে না, ইংরেজিতে একে বলে The point of no return.
রাজনীতি হবে মানবতার কল্যাণে। যে রাজনীতি মানবতার কল্যাণে করা হয় তা বড় এবাদত। অথচ বর্তমানে রাজনীতির দোহাই দিয়ে চালানো হচ্ছে অপরাজনীতি। এই অবস্থায় যতই নির্বাচন করা হোক না কোন নির্বাচনই জনগণকে শান্তি দিতে পারবে না। কারণ আমাদের গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাই ভুল পথে চালিত হচ্ছে। সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, সেটা দ্বারা ব্যক্তিও প্রভাবিত হতে বাধ্য। কাদামাটি দিয়ে মাইলের পর মাইল পথ চলবেন, কিন্তু গায়ে কোনো কাদার ছিটা লাগবে না- তা কি সম্ভব? কাজেই গায়ের কাদা পরিষ্কার করার চেয়েও বেশি প্রয়োজন রাস্তা মেরামত। রাষ্ট্রব্যবস্থা হচ্ছে ওই রাস্তার মত, সেখানে পরিচ্ছন্নতা না থাকলে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতায় ফল হবার নয়, নোংরা-আবর্জনার ছিটা লাগবেই।
ফলে একটি মানুষ সৎ ভাবে জীবন যাপন করতে চাইলেও সে করতে পারে না। বরং সৎ থাকতে গেলে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে সবচেয়ে বেশি ঝুকির মধ্যে থাকতে হয় তাকে এবং তার পরিবারকে। এইরকম একটি মৃত সমাজব্যবস্থায় যতই সুষ্ঠ নির্বাচন করা হোক না কেন তার ফলাফল শেষ পর্যন্ত শূন্য। কারণ গলদ গোড়াতেই।
বাকা পথে আপনি চাইলেও সোজা করে গাড়ি চালাতে পারবেন না। আবার রাস্তা যখন সোজা হবে কেউ চাইলেও বাকা করে গাড়ি চালাতে পারবেনা। আমাদের সমাজে একটি কথা চালু আছে, আগে নিজে ভালো হোন তারপর দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। এই কথাটি সম্পূর্ণ অমূলক। কারণ একটি জীবনব্যবস্থায় মানুষের সামষ্টিক জীবনের গুরুত্ব সর্বাধিক। ব্যক্তি কখনও সামষ্টিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে পথ চলতে পারে না। বিশাল এক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি যমুনা নদীর তুলনায় এক টুকরো শোলার মতো।
শেষ রসুল হুজুরে পাক (সা.) আল্লাহর দেওয়া নীতি অনুযায়ী এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা আরবে প্রতিষ্ঠিত করলেন যেখানে একা একটি যুবতী স্বর্ণালংকার পরিহিত অবস্থায় সানা থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত প্রায় তিনশ মাইল রাতের অন্ধকারে হেঁটে যেত কিন্তু তার মনে এক আল্লাহ ও বন্য জন্তুর ভয় ছাড়া আর কোন ভয় কাজ করত না। আদালতে মাসের পর মাস বিচার সংক্রান্ত কোন মামলা আসত না। রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমানোর প্রয়োজন হতো না। উটের পিঠে খাবার বোঝায় করে ঘুরে বেড়ানো হতো অথচ খাবার নেওয়ার মতো কোন লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। এমনই একটি জীবনব্যবস্থা দিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বনবী। এমনই অনাবিল শান্তি বিরাজ করেছিল আরবে। আজ এমন একটি জীবনব্যবস্থা আমাদের কাছে অলীক কল্পনার মতো মনে হয়।
অষ্টম হেনরীর সময় ইংল্যান্ডের প্রথম যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে সার্বিক জীবন থেকে ধর্মকে বাদ দিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে নির্বাসিত করা হলো তখন মানুষ নিজে তার সার্বিক জীবন পরিচালনার ভার তার হাতে তুলে নিল। জন্ম হলো ধর্ম নিরপেক্ষতার। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত একের পর এক মানুষের তৈরী জীবনব্যবস্থা মানুষ তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিসহ সামষ্টিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে আসছে। কিন্তু কোন জীবনব্যবস্থাই কাঙ্খিত শান্তি দিতে পারেনি। শান্তির জন্য পাগলপারা জনগণ একের পর এক জীবনব্যবস্থা প্রণয়ন করছে, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন নতুন আইন রচনা করা হচ্ছে, আইনের সংশোধন করা হচ্ছে, বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা শান্তির জন্য সভা-সমাবেশ করছে, আলোচনা করছে, শান্তিসংঘ খুলছে কিন্তু শান্তি নেই। কোথাও শান্তি নেই। রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ সহ একে একে সকল তন্ত্র মন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। কেউ শান্তি দিতে পারে নি। মানুষ আজ হারে হারে ভোগ করছে ভুল সমাজব্যবস্থার পরিণতি। প্রত্যেকটা দেশে ক্ষমতার কামড়া কামড়ি, রাজনৈতিক সহিংসতা। বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। বিশ্বের রাজনৈতিক পরিবেশ এখন টালমাটাল। যেকোনো সময় যুদ্ধের শঙ্খ বেজে উঠবে। মানুষ আজ সভ্যতার ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষ লক্ষ অ্যাটম বোম বানিয়ে রাখা হয়েছে মানবজাতিকে বিনাশ করে দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশকে নিয়েও চলছে গভীর ষড়যন্ত্র। এরমধ্যে আবার সারাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে চারদিকের পরিবেশ ঘোলাটে। ভয়াবহ সঙ্কট ধেয়ে আসছে। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ধর্মকে বাদ দিয়ে এখন পর্যন্ত মানবজাতি শান্তি স্থাপন করেছে এমন কোন জীবনব্যবস্থার নজির দেখাতে পারে নি। অতএব এটাই প্রমাণিত হয় যে ধর্মকে বাদ দিয়ে জাতীয় জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব না।