আজ একটা মহাসত্য আমাদের এই ষোল কোটি বাঙালিকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে; সেটা হলো আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ এক ঘোরতর সংকটে নিমজ্জিত। আমাদের অমূল্য সম্পদ ধর্মবিশ্বাস অর্থাৎ ঈমানকে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বার বার ভুলপথে প্রবাহিত করে একাধারে ধর্মকে কালিমালিপ্ত করছে ও জাতির অকল্যাণ সাধন করছে। তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সরলপ্রাণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তির আশায় ধর্মের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে না ব্যক্তি উপকৃত হয়েছে, না জাতি উপকৃত হয়েছে, এর দ্বারা ধর্মবিশ্বাসী মানুষগুলো ইহকাল ও পরকাল- উভয়জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধর্মব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক সব কর্মকাণ্ডের কারণে দুর্নাম হচ্ছে ধর্মের। এক শ্রেণির মানুষ ধর্মের নামে এসব অন্ধত্ব দেখে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখছেন, তারা ধর্মকেই অচল, অপ্রয়োজনীয়, পরিত্যাজ্য বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
আমরা বলতে চাই আমাদের ধর্মবিশ্বাস অর্থাৎ ঈমান আমাদের একটা শক্তিশালী চেতনা, জাতীয় সম্পদ; আমরা এই শক্তিতে বলীয়ান। এই ঈমানকে দেশ জাতি এবং সমাজের কল্যাণে, জাতির ঐক্য উন্নতি প্রগতিতে কাজে লাগানো সম্ভব। আজ ধর্ম ও এবাদতের মানে কেবল উপাসনা-আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখায় এ থেকে ধর্মব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও জাতি কিছুই পাচ্ছে না। মানুষ কেবল দেহসর্বস্ব প্রাণী নয়, তার একটি আত্মাও আছে। তার কেবল জাগতিক জীবন নয়, একটি পরকালীন জীবনও আছে। কাজেই সকল ধর্মই মানুষের উভয় জগতের কল্যাণ সাধনের জন্যই এসেছে, কেবল দুনিয়া বা কেবল পরকালের জন্য নয়। ধর্মের শিক্ষা হচ্ছে, রাত জেগে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের জন্য প্রার্থনা করা, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া যেমন সওয়াবের কাজ, তেমনি মানুষ যেন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে, নির্ভয়ে চলাচল করতে পারে, দুষ্কৃতকারীরা ধ্বংসাত্মক কাজ না করতে পারে সে লক্ষ্যে রাত জেগে পাহারা দেওয়াও বড় সওয়াবের কাজ। এক কথায় মানুষকে সুখ-শান্তি, নিরাপত্তার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোই মানুষের প্রকৃত এবাদত। এই এবাদত করলেই সে পরকালে জান্নাত পাবে। কিন্তু জাতীয়-সামাজিক উন্নয়নের কাজকে আজ ধর্মীয় কাজ বলে কোথাও শিক্ষা দেওয়া হয় না, ধর্মের এ দিকটিকে ঢেকে ফেলা হয়েছে। ধর্মের কোনো বাস্তবমুখী, জীবনমুখী চর্চা আমাদের সমাজে নেই, আছে কেবল সংকীর্ণতা, আত্মকেন্দ্রিক পরকালমুখিতা, সহিংসতা, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ। জাতির ঐক্য নষ্ট করা যে কুফর তা শেখানো হয় না, ষোল কোটি মানুষ প্রায় সকলেই ধর্মবিশ্বাসী হলেও সর্বত্র চলে অনৈক্যের শিক্ষা, অপরের বিষোদগার ও ষড়যন্ত্র করে জয়ী হওয়াই যেন এক শ্রেণির রাজনীতিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের লক্ষ্য। আজ কেবল মসজিদে, মাদ্রাসায় দানকেই বলা হয় আল্লাহর রাস্তায় দান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে রাস্তায় মানুষ চলাচল করে সেই রাস্তা নির্মাণের জন্য দান করাও আল্লাহর রাস্তায় দানের অন্তর্ভুক্ত। এই শিক্ষা দেওয়া হয় না। এই শিক্ষা না থাকায় কেউই জাতীয় উন্নয়নের কাজে অংশ নেওয়াকে এবাদত বলে মনে করছেন না। আজ যদি ধর্মের এই প্রকৃত উদ্দেশ্য ও শিক্ষাকে মানুষের সামনে তুলে ধরা যায় তাহলে আমাদের দেশে যে সম্পদের প্রাচুর্য আল্লাহ দান করেছেন, তা দিয়েই আমরা উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারব। ধর্মবিশ্বাসের মতো এত বড় সম্পদ আজ পচে গলে নষ্ট হচ্ছে। কাজেই ধর্মবিশ্বাস বা ঈমানকে অবজ্ঞা করা নয়, খাটো করা নয়, জাতির উন্নয়নে লাগাতে হবে।
ধর্মব্যবসায়ীদের অপব্যাখ্যার শিকার হয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনও, কারণ তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে সকল প্রকার শিল্প-সংস্কৃতির চর্চাকে নিষিদ্ধ করে রেখেছে। তারা কেবল একটি নির্দিষ্ট পোশাক, আচার আচরণ, নির্দিষ্ট ভাষা ও সংস্কৃতিকেই অন্য জাতিগোষ্ঠীর উপরে ‘ধর্মীয় সংস্কৃতি’ বলে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। অথচ প্রতিটি জাতির মধ্যে ভিন্ন সংস্কৃতি সৃষ্টির পেছনে ধর্মের অবদানই মুখ্য। এটা উপলব্ধি না করে তারা একচেটিয়াভাবে চিত্রাঙ্কন, সিনেমা, নাটক, সঙ্গীত ইত্যাদির চর্চাকে না-জায়েজ বলে ফতোয়া দিয়ে মানবজাতির প্রগতির পথ, সাংস্কৃতিক বিবর্তনের স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করতে চাচ্ছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে যে কোনো সুকুমার বৃত্তি যা মানুষের ইতিবাচক মানসিক বিকাশ সাধন করে, মানুষকে আনন্দিত করে, তাকে সৃষ্টিশীল হতে, মানবতার কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করে তা কোনো ধর্মেই নিষিদ্ধ নয়। ধর্মের চিরন্তন উদ্দেশ্য হচ্ছে শান্তি। যা কিছু মানুষের জাগতিক শান্তির পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করে সেটাই ধর্মে নিষিদ্ধ, এর বাইরে একটি জিনিসও নিষিদ্ধ নয়। যে কোনো অশ্লীলতার বিস্তার সমাজে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি করে এটা সমাজবিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেন। তাই কোনো প্রকার অশ্লীলতাকেই ধর্ম বৈধতা দেয় না, সেটা চলচ্চিত্রেই হোক বা পোশাকেই হোক বা সাহিত্যেই হোক। এখন পশ্চিমা অশ্লীল সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের দেশের শিল্পাঙ্গনেও অশ্লীলতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। তরুণ সমাজ এর দ্বারা নৈতিক অবক্ষয়ের স্বীকার হচ্ছে।
হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী এই সত্যটি মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি নিজেও ছিলেন শুদ্ধ সংস্কৃতির একজন অনুরাগী ও পৃষ্ঠপোষক। রাগ সংগীতে তাঁর ছিল অগাধ জ্ঞান ও দখল। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কীর্তিকে অমর করে রাখার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত নজরুল একাডেমী’র অন্যতম উদ্যোক্তা ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন এমামুয্যামান। তরুণ বয়সে তিনি ছিলেন একজন শিকারী, ফুটবলার ও মোটর সাইকেল স্ট্যান্ট। এছাড়াও তিনি ১৯৫৬ সনে রায়ফেল শ্যুটার হিসাবে অবিভক্ত পাকিস্তানের পক্ষ থেকে মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। আমাদের যুব সমাজকে সুস্থ দেহ ও মনের অধিকারী করার জন্য এবং লুপ্তপ্রায় জাতীয় খেলা কাবাডিকে পুনর্জীবন দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন তওহীদ কাবাডি দল। আমরা তাঁর অনুসারী হিসাবে বলতে চাই, আমাদের প্রিয় এই মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রগতি, প্রগতির শিখরে পৌঁছানোর দায়িত্ব আমাদের সকলের। অপরাজনীতি, অনাচার, অসহিষ্ণুতা, জঙ্গিবাদসহ যাবতীয় অপশক্তির কবল থেকে সমাজের মানুষকে মুক্ত করে ন্যায় সুবিচার শান্তির মধ্যে রাখার লক্ষ্যে কাজ করা একাধারে আমাদের এবাদত ও সামাজিক কর্তব্য। একাত্তর সনে শিল্পীরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছেন, এখনো তেমনিভাবে শিল্পীরা অন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে যদি এই এ জাতিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগানোর জন্য প্রচেষ্টা চালান সেটাও তাদের এবাদত হিসাবে গণ্য হবে। আমরা দেশের সকল সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্পী, সংস্কৃতিমনা ও ক্রীড়ামোদী মানুষকে আহ্বান করছি, আসুন, আমরা যার যার অবস্থান থেকে শতধাবিভক্ত এই জাতিকে ন্যায়ের পক্ষে বজ্রকঠিন ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ভূমিকা রাখি।