ইসলাম এসেছে সমস্ত পৃথিবীর মানুষের জন্য, আর পৃথিবীর সব ভৌগোলিক পরিবেশে ও আর্থ-সামজিক পরিস্থিতিতে একই পোশাক উপযোগী হতে পারে না। তাই আল্লাহ আরবীয় পোশাককে ইসলামে বাধ্যতামূলক করেন নি। করলে মেরু অঞ্চলের মানুষের সেই হুকুম মান্য করা সম্ভব হতো না। এমনকি আমাদের দেশের মতো কৃষিপ্রধান নদীমাতৃক দেশের ধানচাষী ও পাটচাষীদের সারাক্ষণ কাঁদা, হাঁটুপানি-কোমর পানিতে নেমে লুঙ্গি কাছা দিয়ে কাজ করতে হয়। আরবীয় জোব্বা পরে সেটা কি সম্ভব?
ধর্ম আর ধর্মব্যবসাকে গুলিয়ে ফেলার কারণে অধিকাংশ মানুষ ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে ভাবে- ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলছি না তো? ধর্মব্যবসায়ীদেরকে ত্যাগ করতে গিয়ে ভাবে ধর্মকে ত্যাগ করছি না তো? এই বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পেতে ধার্মিক ও ধর্মব্যবসায়ীর মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সীমারেখা তাই আমাদের টানতে হবে। একটি সূত্র সবাইকে মনে রাখতে হবে, সেটা হচ্ছে ধর্ম মানুষকে মুক্তি দেয়। এটা যেমন ব্যক্তিকে তেমনি সমাজকেও যাবতীয় অন্যায়-অনাচার থেকে মুক্তি দেয়; যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেয়, উন্নতি ঘটায়। অপরপক্ষে ধর্মব্যবসা ধর্মকেই ধ্বংস করে দেয়, ধর্মের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করে দেয়। ধর্মব্যবসা চূড়ান্ত বিচারে মানুষকে অন্যায় অবিচারের যাঁতাকলে পিষ্ট করে, তার জীবন ও আত্মার স্বাধীনতাকে হরণ করে।
ধর্ম এবং ধর্মব্যবসা আলাদা করার অন্যতম কষ্টিপাথর হলো- কর্মটিতে ব্যক্তিগত স্বার্থ আছে কি না তা পরখ করে দেখা। ধর্মের কাজ হয় নিঃস্বার্থভাবে, মানবতার কল্যাণে। ধর্মের কাজ করতে গেলে স্বার্থ ত্যাগ করতে হয় এবং বিনিময় কেবল আল্লাহর নিকট থেকে আশা করতে হয়। যখনই দেখা যাবে কেউ ধর্মের নাম দিয়ে ব্যক্তিগত বৈষয়িক স্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধার করছে তখনই বুঝতে হবে – এটা ধর্মব্যবসা।
ধর্মব্যবসায়ীরা হয় ভোগী আর ধার্মিকরা হয় ত্যাগী। ধর্মব্যবসায়ীরা দান গ্রহণ করে আর ধার্মিকেরা দান করেন। ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মকে ব্যবহার করে আর ধার্মিকরা ধর্মকে ধারণ করেন। ধর্মব্যবসায়ীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে হয় নীরব, কাপুরুষ আর ধার্মিকরা হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। ধর্মব্যবসায়ীরা যেটুকু ধর্ম পালন করে তা কেবল মানুষকে দেখানোর জন্য আর ধার্মিকরা ধর্ম পালন করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য।
অর্থাৎ ধার্মিক আর ধর্মব্যবসায়ীর প্রভেদ তাদের বেশ-ভূষা, ভাবমূর্তির মধ্যে খুঁজলে হবে না। খুঁজতে হবে তাদের চরিত্রে এবং তাদের কাজে। আল্লাহর রসুল বলেছেন, “কেয়ামতের দিন মিজানের পাল্লায় সবচেয়ে ভারি বস্তু হবে মো’মেনের উত্তম চরিত্র (হাদিস – তিরমিযি)। প্রতারণা করার জন্য বেশভূষা গুরুত্বপূর্ণ ছদ্মবেশ। তাই যারা ধার্মিক সেজে ধর্মব্যবসা করে তারা বেশভূষায় একেবারে নিখুঁত থাকার চেষ্টা করে যেন কেউ তাদের বাহ্যিক অবয়বে, চালচলনে ভুল ধরতে না পারে। দাড়িতে টিকি টুপিতে, পৈতে নামাবলি গেরুয়ায় তারা নিখুঁত। কারো কপালে সেজদার দাগ, কারো কপালে চন্দন। কিন্তু যারা ধর্মব্যবসা করে তাদেরকে বেশভূষা আর লোক দেখানো আমল বিচার করে দীনের ধারক-বাহক মনে করা মস্ত বড় পথভ্রষ্টতা। কারণ এ বিষয়ে আল্লাহর রসুল (সা.) জাতিকে সাবধান করে গেছেন এই বলে যে, যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, কোনো মানুষের ঈমান সঠিক হতে পারবে না যতক্ষণ না সে সৎ ও বিশ্বাসী হয়। আমি তোমাদেরকে হেদায়েত করছি যে তোমরা কোনো ব্যক্তির অধিক সালাহ আদায় ও অধিক সিয়াম পালন করা দেখে ভুল করো না, বরং লক্ষ্য করো সে যখন কথা বলে সত্য বলে কি না এবং তার কাছে রাখা আমানত বিশ্বস্ততার সাথে ফিরিয়ে দেয় কিনা। এবং নিজের পরিবার পরিজনের জন্য হালাল উপায়ে রোজগার করে কিনা। যদি সে আমানতদার ও সত্যবাদী হয় এবং হালাল উপায়ে রেযেক হাসিল করে তাহলে নিশ্চয়ই সে কামেল মো’মেন। (রসুলাল্লাহর ভাষণ, সিরাত বিশ্বকোষ ১২ খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
অথচ বর্তমানে মুসলিম চেনার জন্য চারিত্রিক মাহাত্ম্য নয় বরং দাড়ি, টুপি, বেশভূষাকেই মানদণ্ড হিসাবে ধরা হয়। কারণ দীর্ঘদিন থেকে ওয়াজে-খোতবায়, তালিমে এসবের ফজিলতই প্রচার করা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি মাদ্রাসা বসিয়ে এগুলোর গুরুত্বই বৃহৎ করে তোলা হয়েছে। দাড়ি, টুপি নেই এমন কেউ যদি আজ প্রকৃত ইসলামের সত্যগুলো এবং প্রচলিত ইসলামের বিকৃতিগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরতে যান, এমন কি তিনি যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য শহীদ হতেও পণ করেন তখনও প্রথম যে প্রশ্নটির মোকাবেলা তাকে করতে হবে সেটা হচ্ছে, “আপনি ইসলামের কথা বলছেন, কিন্তু আপনার সাড়ে তিন হাত শরীরেই তো ইসলাম নাই? আগে তো নিজেদের শরীরে ইসলাম কায়েম করতে হবে। ইসলামের আপনি কী বুঝেন, মাদ্রাসায় পড়েছেন?” খুব আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে সম্পূর্ণ যুক্তিহীন ও হাস্যকর এই প্রশ্নটি করা হয়। আজ থেকে এক শতাব্দী আগেও পরিস্থিতি এমনই হতাশাজনক ছিল। ধর্মের নামে এই যুক্তিহীনতা ও অন্ধত্বের চর্চার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম। এজন্য তাকেও মৌলবী শ্রেণি কাফের ফতোয়া দিয়ে সমাজচ্যুত করতে চেয়েছিল। আমার কৈফিয়ৎ কবিতায় তিনি সেই ফতোয়ার কথা উল্লেখ করেছেন – ফতোয়া দিলাম কাফের কাজী ও, কিন্তু শহীদ হইতে রাজি ও।
একজন ব্যক্তির শুধুমাত্র মাদ্রাসায় না পড়া অথবা দাড়ি-টুপি ধারণ না করার অপরাধে তার সকল সত্য ও ন্যায়সঙ্গত বক্তব্যকেই যারা তুড়ি দিয়ে বাতিল করে দিচ্ছেন, আজ যদি তাদেরকে পাল্টা প্রশ্ন করা হয় যে, দাড়ি, টুপি, পাগড়ি ধারণ না করলে ইসলামের কথা বলা যাবে না এমন কোনো কথা নির্দিষ্ট করে পবিত্র কোর’আন-বা হাদিসে উল্লেখ আছে কি? এমন কোনো শর্ত তো আল্লাহ বা রসুল (স.) দেন নি। সুতরাং এগুলো ইসলাম হিসাবে পালন করতে কেউ কারো উপর জোর করতে পারে না। করলে সেটা হবে দীনের মধ্যে সংযোজন। তাহলে আজ ইসলামের কথা বলতে গেলেই আপনার দাড়ি কই, টুপি কই, জোব্বা কই- এমন সব প্রশ্ন উঠছে কেন?
এই প্রশ্ন ওঠার কারণ ইসলামের বিষয়গুলোর মধ্যে গুরুত্বের ওলট-পালট। ইসলামের মূল বিষয়বস্তুকে বাদ দিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন যদি জিজ্ঞেস করা হয় ইসলামের উদ্দেশ্য কী? তাহলে ১৬০ কোটি মুসলিমের কাছে অন্তত কয়েক লক্ষ ভিন্ন ভিন্ন উত্তর পাওয়া যাবে। তাই পোশাক আশাকের বিষয়টি সম্যকভাবে বুঝতে হলে আগে আমাদেরকে ইসলামের উদ্দেশ্য কী সেটা সঠিকভাবে জানতে হবে। কেননা ইসলামের সব কিছুই এই দীনের মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আল্লাহ সাজিয়েছেন।
মানবসৃষ্টির সূচনালগ্নে মহান আল্লাহর সঙ্গে ইবলিসের একটি চ্যালেঞ্জ হয়। সেই চ্যালেঞ্জটির বিষয়বস্তু ছিল মানবজাতি পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করবে, নাকি মারামারি কাটাকাটি হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাতে লিপ্ত থাকবে? মানুষ যদি শান্তিতে থাকে তাহলে চ্যালেঞ্জে আল্লাহ বিজয়ী হবেন, আর যদি অশান্তি অরাজকতার মধ্যে বাস করে তাহলে ইবলিস বিজয়ী হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ নবী-রসুলদের মাধ্যমে জীবনবিধান পাঠালেন। সেটা মানুষের সামগ্রিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করলে সমাজে শান্তি আসবে। আর অন্য জীবনব্যবস্থা দিয়ে জীবন চালালে অশান্তি বিরাজ করবে। নবী-রসুলগণ এভাবে আল্লাহকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন।
সত্য দীনের ফল হচ্ছে শান্তি, এ কারণে ইসলামের শাব্দিক অর্থই হচ্ছে শান্তি। আজ ধর্মের নামে বহু বাহ্যিক আড়ম্বর করা হয়, উপাসনা, আনুষ্ঠানিকতার কোনো শেষ নেই, অথচ আমরা আমাদের সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করছি আল্লাহর হুকুম বাদ দিয়ে, পাশ্চাত্যের জীবনবিধান দিয়ে। পরিণামে আজ সর্বত্র ঘোর অশান্তি, যার অর্থ আজ ইবলিস বিজয়ী হয়ে আছে। আর আল্লাহর দীন, জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে আর কোনো কিছু দিয়েই আল্লাহকে বিজয়ী করা সম্ভব না। ফলে যে কাজের দ্বারা আল্লাহ বিজয়ী হন না, সমাজে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার প্রতিষ্ঠা হয় না, সে কাজের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।
এখন চিন্তা করুন, ইসলামের সাথে দাড়ি, টুপি, পাগড়ি, জোব্বার সম্পর্ক কোথায়? ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা অর্থাৎ ব্যক্তি, পরিবার, যুদ্ধনীতি, বাণিজ্যনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি সব কিছুই ইসলাম নামক জীবন-ব্যবস্থার এক একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুতরাং যারা আমাদের শরীরে ইসলাম নাই এই প্রশ্ন করেন তাদের কাছে এই প্রশ্নটি করা দরকার যে, একটি দেশের সব মানুষ যদি দাড়ি রাখে, টুপি পরে, জোব্বা গায়ে দেয় কিন্তু তাদের সামষ্টিক জীবনের ঐ অঙ্গনগুলোতে যদি আল্লাহর হুকুম না মানে, তাহলে কি সেই দেশে শান্তি এসে যাবে?
আসবে না। কারণ রসুলের (স.) আগমনের পূর্বেও আরবের মানুষগুলো দাড়ি রাখত, টুপি, পাগড়ি, জোব্বা পরত। এটা প্রাচীন যুগ থেকেই আরবীয় স্টাইল। দাড়ি কামানোর আধুনিক যন্ত্রপাতিও তখন ছিল না। মূলত দাড়ি ছিল আরবদেশে নেতা নির্ধারণের মাপকাঠি এবং পৌত্তলিকদের প্রথা (Tradition, Custom), , যা রসুলেরও নয়, কোর’আন নির্দেশিতও নয়। কথিত আছে মক্কায় ধর্মীয় নেতা নির্বাচনের সূত্র হিসাবে স্কেল দিয়ে নাকি দাড়ি পরিমাপ করা হতো। বর্তমানেও মসজিদের ইমাম নিয়োগের ক্ষেত্রে, বা ইসলামি দলের নেতা হিসাবে দাড়িহীন কাউকে চিন্তাও করা যায় না। পরবর্তীকালে যখন উমাইয়া রাজতন্ত্র চালু হয় তখন দাড়িকে ইসলামের চিহ্ন বলে এবং রসুলের সুন্নত বলে চালু করা হয়। দরবারী আলেমগণ এই আকিদার প্রসারে বেশ ভূমিকা রাখেন। খলিফার আসনে উপবিষ্ট ইয়াজিদের বেশ লম্বা দাড়ি ছিল। লম্বা দাড়ি ছিল তার পিতা মুয়াবিয়া (রা.) এবং পিতামহ আবু সুফিয়ানেরও। প্রকৃতপক্ষে দাড়ি ছিল আরবীয় ঐতিহ্য ও বিশেষত কোরায়েশ বংশীয় অভিজাত্যের প্রতীক। সুতরাং সে ঐতিহ্য যেন কায়েম থাকে সেটারই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়েছিল আমলের ফজিলতের বইতে দাড়ির গগনস্পর্শী গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে। প্রকৃত সত্য হলো, জাতির নেতৃত্ব দানকারী কথিত খলিফা ও আমিরগণ যখন সমগ্র পৃথিবীতে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ করলেন তখন সেই সংগ্রামের বিকল্প হিসাবে এই সব পোশাকী বিষয়ের গুরুত্ব বাড়িয়ে এগুলোকে ইসলামের অপরিহার্য অঙ্গ বানিয়ে ফেলা হলো। এরপর যখন মুসলমানেরা আল্লাহর গজবের শিকার হয়ে মঙ্গোল, ক্রুসেডার ও ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় তথা ব্রিটিশ, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ফরাসিদের গোলামে পরিণত হলো, তখন তারা সব হারালো। তাদের জাতীয় জীবন থেকে ইসলামের সকল বিধান বাদ গেল। কায়েম করা হলো ইউরোপীয় জীবনব্যবস্থা। তখন মুসলমানিত্বের চিহ্ন হিসাবে ঐ আরবীয় বেশভূষাটাকেই তারা আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরা হলো। জাতি এসবের মধ্যেই নিজেদের মুসলিম পরিচয় সন্ধান করতে লাগল। আর পণ্ডিতরাও এগিয়ে এলেন আত্মপক্ষ সমর্থনের বাহানা যোগাতে। পরাজিত অপমানিত দাস জাতিকে জান্নাতে নিতে ইসলামকে দাড়ি-টুপি, মেসওয়াক, কুলুকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেললেন। এর বেশি কিছু করার জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামরিক যোগ্যতাও তাদের ছিল না।
যদিও দাড়ির এত ফজিলত আর মর্তবার প্রচার, এসবের পুঁজি খুঁজতে গেলে দুই চারটা দয়িফ, জাল বা মউজু হাদিস ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোর’আনে তো এর উল্লেখমাত্রও নেই। আর থাকবেই বা কেন? পৃথিবীর কোন জীবনব্যবস্থার মূলগ্রন্থে, কোন দেশের সংবিধানেই বা দাড়ির মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সে যাই হোক প্রকৃতপক্ষে এই শেষ দীনে কোনো নির্দিষ্ট পোষাক হতে পারে না, কারণ এটা এসেছে সমস্ত পৃথিবীর মানুষের জন্য। পৃথিবীর মানুষ প্রচণ্ড গরমের দেশে, প্রচণ্ড শীতের দেশে, নাতিশীতোষ্ণ দেশে, অর্থাৎ সর্বরকম আবহাওয়ায় বাস করে, এদের সবার জন্য এক রকম পোষাক নির্দেশ করা অসম্ভব। বিশ্বনবীর (সা.) সময়ে তাঁর নিজের এবং সাহাবাদের পোষাক-পরিচ্ছদ ও তখনকার আরবের মোশরেক ও কাফেরদের পরিচ্ছদ যেমন একই ধরনের ছিল, বর্তমানেও মুসলিম আরব, খ্রিষ্টান আরব ও ইহুদি আরবরাও একই ধরনের পোষাক-পরিচ্ছদ পরে। নবী এসেছেন আরবে, তাই তিনি আরবীয় পোশাক পরেছেন। আরবীয়রা যখন বিশ্বের বুকে সম্মানিত জাতিতে পরিণত হলো, তাদের সংস্কৃতি আর পোশাক-আশাকও মানুষের কাছে সাদরে গৃহীত হলো। কারণ মানুষ শাসকদের ও মহান ব্যক্তিদের সবকিছুই অনুকরণ করে থাকে। মুসলিমরা যখন শ্রেষ্ঠ জাতি ছিল, তাদের সবকিছুই মানুষের কাছে অনুকরণীয় ছিল। মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্র বাগদাদ, কর্ডোভা ও মিশরের বড় বড় মাদ্রাসা অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে জ্ঞান আহরণ করে যখন ইউরোপে জ্ঞানের চর্চা শুরু হলো, সেখানে মধ্যযুগীয় বর্বরতার অবসান হলো। সেখানেও গড়ে উঠতে লাগল মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি, তখন ইউরোপীয় ছাত্ররা মুসলিম সভ্যতার মহান দার্শনিকগণ যে ধরনের পোশাক পরতেন, তারাও সেই পোশাক পরিধান করাকেই গৌরবের পরিচায়ক বলে মনে করতেন। আজও পাশ্চাত্যের অনুকরণে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যারা স্নাতক বা গ্রাজুয়েট হন তারা সনদ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যে বিশেষ গাউনটি পরেন সেটা আরবীয় পোশাকের অনুকরণেই তৈরি। মুসলিম স্বর্ণযুগের মহান চিকিৎসক ইবনে সিনার পোশাকের অনুকরণেই ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গ্রাজুয়েটদের জন্য এই ধরনের গাউনের প্রচলন ঘটিয়েছিল। আজকের মুসলমানদের মধ্যে অনেকে পাশ্চাত্যের অনুকরণ-অনুসরণ করাকেই শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন ভাবছেন এবং মুসলিম পরিচয় দিতে হীনম্মন্যতায় ভুগছেন তাদের এই হীনম্মন্যতার কারণ নিজ জাতির গৌরবের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
পরিশেষে আবারও বলছি, আল্লাহ কিন্তু আরবীয় পোশাককে ইসলামে বাধ্যতামূলক করেন নি। করলে মেরু অঞ্চলের মানুষের সেই হুকুম মান্য করা সম্ভব হতো না। এমনকি আমাদের দেশের মতো কৃষিপ্রধান নদীমাতৃক দেশের ধানচাষি ও পাটচাষিদের সারাক্ষণ কাঁদা, হাঁটুপানি-কোমর পানিতে নেমে লুঙ্গি কাছা দিয়ে কাজ করতে হয়। আরবীয় জোব্বা পরে সেটা কি সম্ভব? না। মরুপ্রধান আরবে রৌদ্রের খরতাপ ও ধুলোবালি থেকে আত্মরক্ষা করতে সেখানকার নারী-পুরুষ, ইহুদি-মুসলিম খ্রিষ্টান নির্বিশেষে সব মানুষই লম্বা পোশাক পরেন, মাথায় পাগড়ি বাঁধেন, নাক-মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন। আল্লাহ সেটা জানেন বলেই আরবের পোশাক তিনি সকল এলাকার মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক করেন নি বা উৎসাহিতও করেন নি।
কিন্তু ঘটনা হয়েছে কি, পূর্বের ফকীহ, ইমাম, মুফাসসিরগণ রসুলাল্লাহর সমস্ত আচরণকেই ইসলামের মাসলা মাসায়েলের মধ্যে, বিধি-বিধানের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন। তাদের যুক্তি হলো আল্লাহ রসুলকে অনুসরণ করার হুকুম দিয়েছেন। আলেম ওলামারা এই অনুসরণের মানে করেছেন যে রসুলের দাড়ি ছিল, তিনি খেজুর খেতেন, তিনি পাগড়ি, জোব্বা পরিধান করতেন – তাই এগুলোও করতে হবে। এগুলোকেও তারা শরিয়তের বিভিন্ন স্তরের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। সেখানেও আছে বিস্তর মতভেদ। ফকীহ-মুফতিদের কেউ বলছেন এগুলো ওয়াজিব, কেউ বলছেন সুন্নত। সেই সুন্নতের মধ্যেও আছে প্রকারভেদ। কেউ বলছেন সুন্নতে মোয়াক্কাদা, কেউ সুন্নতে যায়েদা ইত্যাদি। এখন আরবের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক ইত্যাদি ইসলামের এতই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে গেছে, ঐ লেবাস না থাকলে এখন কারো ইসলামের কথা বলার অধিকারই থাকে না। এই যে শরিয়ত ও প্রথার প্রচলন করা হলো, এটা কিন্তু কোর’আনের শিক্ষা নয়, ইসলামেরও শিক্ষা নয়, এটা আলেম-ওলামা, বিভিন্ন মাজহাবের ইমামদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তৈরি করা শরিয়ত।