মুসলিম জাতি কেন সব দিক দিয়ে পশ্চাৎপদ- এর কারণ খুঁজতে গেলে বর্তমানে এর অনুসারীদের দৃষ্টিভঙ্গি, ধ্যান ধারণা, চিন্তাধারা ও দর্শনের দিকে খেয়াল করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। ‘দুই দিনের দুনিয়া’, দুনিয়া মুমিনের জেলখানা’, ‘চোখ বন্ধ করে করে কোনোমতে পার হতে পারলেই খালাস’, ‘এটা আমার চিরস্থায়ী আবাস নয়’, ‘এখানে ভোগ নয়, ভোগ কেবল পরকালে’, ‘আনন্দ এখানে নয়, আনন্দ জান্নাতে’- এ ধরনের প্যাসিভ মানসিকতা যে জাতির মধ্যেই থাকুক না কেন, তাদের দ্বারা আদৌ সৃষ্টিশীল ও গঠনমূলক কিছু করা সম্ভব নয়। কেনই বা দুনিয়াতে দুনিয়াবি কাজে তারা এত কষ্টকর সাধনা করবে, কেন নতুন কিছু আবিষ্কারে মনোযোগী হবে? তাদের তো জীবন দর্শন হবে কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে, পরে না পরে দিন গুজরান করা।
আদতেও হয়েছে তাই। আনন্দ করাকে এরা সীমাবদ্ধ করে নিয়েছে কেবল দুটো দিনের মাঝে। মনের আনন্দে গান করা, বাদ্য বাজানো, হাততালি দেওয়াকে এরা হারাম বলে জানে। এরকম নিরস, রস-কষহীন জাতি পৃথিবীকে কী দেবে? কীই বা আশা করা যায় তাদের কাছে?
এই পৃথিবী যে নিয়মে চলে, যে ফিতরাতের উপর আমরা বাস করি তাতে করে একটু গান গাওয়া, কোনো কিছুর প্রাপ্তিতে মনখুলে একটু আবেগের প্রকাশ ঘটানো- এসবে যাদের মনে দ্বন্দ্ব তারা কি করে পৃথিবীকে কিছু দেওয়ার চিন্তা করতে পারে? অথচ প্রকৃতির দিকে তাকান। এখানে পাখি গাইছে, নদীতে ঢেউ উঠছে, সাগর গর্জন করছে, শস্যের শীষ বাতাসে ঢেউ তুলছে, ঋতুর পরিবর্তনে প্রকৃতি সাজছে অপরূপ রঙে। পাহাড়- পর্বত, বনরাজীর পাতার রঙ পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত, মেঘ ভাসছে, চাঁদের ঝিকিমিকি স্নিগ্ধ আলো দীঘির জলে খেলা করছে। কিন্তু কোনো পরিবর্তন বা হিল্লোল নেই একটা বিরাট অংশের মানুষের মনে। প্রকৃতিগতভাবেই তাদের মনে এসবের প্রভাব ফেললেও তারা তা প্রকাশে ব্যর্থ। হারাম ফতোয়ার চাবুক সব সময় তাদের দিকে ছড়ি ঘোরায়। মনের অনুভূতি প্রকাশে তারা ব্যর্থ। অন্ততপক্ষে দ্বিধাহীন নয়। সবকিছুতেই হারামের ভয় তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এই যদি হয় অবস্থা তবে এর যে স্বাভাবিক ফল পাওয়ার কথা তারা তাই পাচ্ছে। মৃতচিন্তার ধর্ম, নির্জীব থাকার ধর্ম তাদেরকে আরো নির্জীব করে দিচ্ছে। তাদের এই মৃত চিন্তা অন্যদের উপর প্রভাব ফেলছে না, আকর্ষণ করছে না।
অথচ অন্য ধর্মের উৎসবগুলোর দিকে তাকান। কত রঙের ছড়াছড়ি! আনন্দ প্রকাশের কত ধারা! হারামের চাবুক তাদেরকে দাবড়ে বেড়ায় না। এত সীমারেখা চাপিয়ে দিয়ে মানুষকে আবদ্ধ করা হয় না। শিল্পকলা, সংস্কৃতি, আনন্দ বেদনা প্রকাশের পক্ষে রয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা। তারা জয় করে নিচ্ছে বিশ্ববাসীর মন। দেশ থেকে মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে সর্বত্রই তারা গৃহিত হচ্ছে।
আর এরা? এরা প্রভাবহীন, এদের দিকে মানুষ ফিরে তাকায় না। একটা একঘেয়ে, প্রাণহীন জীবনধারা কাকেই বা টানে? যেহেতু মানুষের ফিতরাত বৈচিত্র চায়, একঘেয়েমি পছন্দ করে না, যেহেতু মানুষের স্বভাব আনন্দ প্রকাশের, অনুভূতি প্রকাশের, আবেগ প্রকাশের, সেহেতু এই বিধিনিষেধ তাদেরকে আটকেও রাখতে পারে না। অর্থাৎ মনের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকায় নিজেরা সৃষ্টিশীল কিছু না করতে পারলেও অন্যদের সৃষ্টিশীলতা দেখে ঠিকই মুগ্ধ হয়। চুরি করে হলেও সেগুলো পরখ করে। যে ছেলেটি গান-বাদ্য, শিল্পকলার বিপক্ষে প্রতিনিয়ত তর্ক করে, হাদিসের উদ্ধৃতি দেয় সেও ঠিকই গান পছন্দ করে, একা হলে গায়, লুকিয়ে সিনেমা দেখে। অনেকে আবার এগুলোকে অযৌক্তিক মনে করে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে পুরো ধমর্টাকেই এড়িয়ে চলে।
এই যে সম্পূর্ণ পরকালমুখী, দুনিয়াবিমুখ দর্শন- এটাই কি ইসলাম শিক্ষা দেয়? এ ধর্মে কি আনন্দ নেই? এত রস-কষহীন একটি দর্শনের উপর নির্ভর করে ইসলাম কি তৎকালীন অর্ধ দুনিয়ায় গৃহিত হয়েছিল? এই রস-কষহীন একটি আদর্শই কি দুনিয়াতে একটা রেনেসাঁ নিয়ে এসেছিল? এটা কি আদৌ সম্ভব? এর উত্তর হচ্ছে, না। এমন দর্শন মানুষের কাছে কখনোই গ্রহণীয় হতে পারে না। এমন দর্শন পুরনো সভ্যতাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে নতুন সভ্যতা তৈরি করতে পারে না। এমন পশ্চাৎপদ দর্শনের অধীন মানুষ শিক্ষা-সংস্কৃতি, নতুন নতুন আবিষ্কার, দুঃসাহসিক অভিযান, চিকিৎসাবিদ্যা, সমরবিদ্যা ইত্যাদিতে শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। উল্টো তারা নিজেরাই এক অন্ধকার যুগে ডুবে থাকে। সমস্যা হচ্ছে, তারা যে অন্ধকারে ডুবে থাকে তা উপলব্ধি করতে পারে না। তাদের কাছে কেউ আলোর ঝলকানি নিয়ে কেউ হাজির হলেই গেলেই ‘গেলো’, ‘গেলো’ বলে তেড়ে আসে। কেবল আরো অন্ধকার, আরো অন্ধকার তাদেরকে ঘিরে ধরে। সেটাই তাদের কাছে ভালো লাগে।
একটি সভ্যতার বিকাশে কতগুলো মৌলিক অনুষঙ্গের মাঝে গান, কবিতা, শিল্পকলা অপরিহার্য। এগুলো ছাড়া কোনো সভ্যতা সৃষ্টি হয় না। এগুলো ছাড়া সভ্যতা মৃত, প্রাণহীন। সে সভ্যতা বিকশিত হওয়ার আগেই মারা যায়। ইসলামী সভ্যতার বিকাশ এগুলোর সমন্বয়েই হয়েছিল। সভ্যতা রচনার প্রাণপুরুষ এদিক নিয়ে সজাগ ও সচেতন ছিলেন। তিনি এগুলো নিয়ে মগ্ন না থাকলেও, মগ্ন না থাকার সুযোগ পেলেও এগুলোকে উৎসাহিত করেছেন এবং নিজেও সমঝদার ছিলেন। গান গাইতে যাওয়া মেয়েদের ধমক দিয়ে থামিয়ে দেওয়া মৃত চিন্তাকে তিনি উল্টো ধমক দিয়ে বলেছেন, ‘ওদেরকে গাইতে দাও।’ তিনি হাতে কলমে, ধমক দিয়ে, নিজে বিনোদনের অনুষ্ঠানে স্ত্রীসহ হাজির থেকে এসবের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি আয়েশার (রা) ঘরে দুজন গায়িকার গান গাওয়ার অনুমতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘যাতে করে ইহুদিরা এটা জেনে নেয়, আমাদের দ্বীনের মাঝেও নিশ্চয় প্রশস্ততা রয়েছে এবং আমাকে উদারতাসহ প্রেরণ করা হয়েছে।’
চিন্তায় যারা প্রশস্ত নয়, উদার নয় তাদের দ্বারা সত্যিকার অর্থেই সৃষ্টিশীল কিছু করা সম্ভব নয়। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, নিজেদের মাঝে সৃষ্টিশীলতা না থাকার কারণে প্রকৃতির নিয়মেই তারা অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। তারা নিজেরা কিছু করছে না অথচ অন্যদের সৃষ্টিশীলতাকে গোপনে হলেও গ্রহণ করছে। এর একটা বড় প্রমাণ হচ্ছে, গ্রামে গঞ্জে অনুষ্ঠিত মাহফিলগুলোতে যে গজলগুলো গাওয়া হয় তার অধিকাংশই মৌলিক সুরের নয়। এসবের সুর হিন্দি সিনেমার গান থেকে চুরি করা। এসব গান যদি তারা না শুনত তবে তারা সুরগুলো পেত না। আর মনে সুরের ব্যাপারে, গানের ব্যাপারে দ্বন্দ না থাকলে নিজেরাই প্রচুর পরিমাণে সুর তৈরি করতে পারত। অন্যদের দ্বারস্থ তাদেরকে হতে হত না।
দ্বিরুক্তি হলেও আবারও বলছি, দুনিয়াবিমুখ দর্শন দ্বারা কেবল শিল্প-সংস্কৃতি নয়, কোনো ক্ষেত্রেই অগ্রগতি করা সম্ভব নয়। ফলে দুনিয়াতে প্রভাববিস্তার করাও সম্ভব নয়। শ্রেষ্ঠত্বের চিন্তাও করা যায় না। বরং মনে দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে সব দিক দিয়ে গোলামি করে যেতে হয়। এ দীন কেবল দুনিয়াবিমুখ নীতির শিক্ষা দেয় না, বরং প্রবল দুনিয়ামুখী শিক্ষাও দেয়। বলে, তুমি যতক্ষণ দীনের কাজ করবে তখন মনে করবে এখনই তোমার মৃত্যু হবে। আর যখন তুমি দুনিয়ার কাজ করবে তখন তুমি মনে করবে, তুমি অমর। আমরা প্রথমটুকুকে গ্রহণ করেছি আর দ্বিতীয়টুকুকে বর্জন করেছি। এ যে আমাদের কত বড় ভুল দর্শন, কত বড় পশ্চাৎপদতা তার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে নবীজীর এই কথা- কারো হাতে যদি একটি চারা গাছ থাকে তবে কেয়ামত শুরু হয়ে গেলেও সে যেন সেটি রোপণ করে যায়। কেয়ামত শুরু হয়ে গেলে গাছের চারা লাগিয়ে লাভ কী? এ বাণীর মর্মার্থ যারা বুঝেছে তারা দুনিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। যারা এটাকে বর্জন করে দুনিয়াবিমুখ হয়েছে তারা ১৫০ কোটি হয়ে ইহুদি খ্রিষ্টানদের আবিষ্কৃত পারমাণবিক বোমার ভয়ে তাদের পায়ের তলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। সর্বদিক দিয়ে তারা আজ গোলাম। এরাই এক সময় মাইক, রেডিও, টেলিভিশন হারাম বলে ফতোয়া দিত। এখনও নতুন কিছু দেখলে তারা প্রথমে চিন্তা করে এগুলো হালাল নাকি হারাম। অথচ তাদের হাতেই হওয়ার কথা ছিল এসব নতুন নতুন যন্ত্রের আবিষ্কার। একসময় হয়েছিল তা। কিন্তু যেই তাদের মাঝে ভারসাম্যহীন দুনিয়াবিরগী ধারণা প্রবেশ করল, জাতির মগজধারীরা নিজেদেরকে অতি ধার্মিক প্রমাণে কেবল পরকালীন কাজে লিপ্ত হয়ে গেল, তখন পাল্টা সভ্যতা তাদেরকে পরাভূত করে দিল। কূপমণ্ডূকতা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে দিল। এই অন্ধত্ব নিয়ে, আত্মার অপ্রশস্ততা নিয়ে মানবজাতিকে নেতৃত্ব দেওয়া কেবল অসম্ভবই নয়, অলীক কল্পনা।