আমরা বলে থাকি যে শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা বলতে আমরা স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় অর্থাৎ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে যে শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে সেটাকেই বুঝে থাকি। কিন্তু এসব শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষিত হয়ে একটি জাতি যদি জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে, যদি তারা সুশৃঙ্খলভাবে জীবন যাপন করতে না পারে, যদি তারা আল্লাহর হুকুমের তথা ন্যায়ের আনুগত্য করতে না পারে, যদি তারা অন্যায় বর্জন করতে না পারে তাহলে ঐ শিক্ষাব্যবস্থার গতবাঁধা শিক্ষা কি জাতির মেরুদণ্ড বলে গণ্য হবে? অবশ্যই না। তাই শিক্ষার উদ্দেশ্য কী হবে সেটা আগে নির্ধারণ করে নেওয়া কর্তব্য। সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে জাতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের অনুগামী ও সম্পূরক।
আমরা জানি, পৃষ্ঠদেশ হচ্ছে মানুষের শক্তির মূল আধার। সেই পৃষ্ঠদেশে অবস্থিত মেরুদণ্ড মানুষকে ঋজু করে, উন্নতশির করে, মানুষকে মানুষের আকৃতি বা কাঠামো নিয়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্য প্রদান করে। একটি জাতিকেও দাঁড়িয়ে থাকতে হলে, অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে তারও একটি কাঠামো থাকা অপরিহার্য। সকল শ্রেষ্ঠ জাতির মৌলিক কাঠামো এক ও অভিন্ন। সেটা চিরন্তন। সুদূর অতীত থেকে আজকের দিন পর্যন্ত যে জাতির ক্ষেত্রেই এ মৌলিক কাঠামোর দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে সে জাতি যত বড়ই হোক সে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে যেতে পারে নি। এই মৌলিক কাঠামোটা কী?
সমাজবিজ্ঞানীরা জাতিসমূহের বা সভ্যতাগুলোর কাঠামো নিয়ে বহু ধরনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন কিন্তু হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুয্যামান তাঁর একটি পুস্তিকায় উল্লেখ করেছেন, “একটি জাতির মেরুদণ্ড হচ্ছে ঐ জাতির চেইন অব কমান্ড বা আনুগত্যের ধারাবাহিকতা।” উদাহরণ- পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মানে যে সমাজে পিতার আনুগত্য করা হয়, মাতৃতান্ত্রিক সমাজ মানে যে সমাজে মায়ের আনুগত্য করা হয়; অর্থাৎ আনুগত্যটা অনিবার্য। এমামুয্যামান উম্মতে মোহাম্মদীর মধ্য থেকে মহাবীর খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.), সিন্ধুবিজয়ী বীর মোহাম্মদ বিন কাসেম, স্পেনজয়ী তারিক বিন যিয়াদ প্রমুখের পাহাড়সম আনুগত্যশীলতার উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনী, জাপান সেনাবাহিনী, জার্মান সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন জাতির আনুগত্যপরায়ণতার উদাহরণ টেনে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে চেইন অব কমান্ড অটুট থাকার উপরই নির্ভর করে একটি জাতির অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। তাই এটাই জাতির প্রকৃত মেরুদণ্ড। জাতির প্রত্যেক সদস্যকে সম্মিলিতভাবে এই মেরুদণ্ডকে নিরাপদ ও সকল আঘাত থেকে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট থাকা জরুরি।
উম্মতে মোহাম্মদীর চেইন অব কমান্ড কী ছিল সেটাও তিনি সপ্রমাণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর প্রদত্ত ব্যাখ্যার ভিত্তি হচ্ছে রসুলাল্লাহর একটি হাদিস যেখানে তিনি বলেছেন, “আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের আদেশ করেছেন, আমিও তোমাদেরকে সেই পাঁচটি কাজের আদেশ করছি। (১) তোমরা ঐক্যবদ্ধ থাকবে (ঐক্য), (২) তোমরা তোমাদের নেতার আদেশ মনোযোগ সহকারে শুনবে (শৃঙ্খলা), (৩) তোমাদের নেতার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে (আনুগত্য), (৪) সকল শেরক ও কুফরকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে (হেজরত), (৫) আল্লাহর সত্যদীন পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন ও সম্পদ কোরবান করে সর্বাত্মক সংগ্রাম করবে (জেহাদ)।
যারা এই পাঁচটি কাজের ঐক্যবন্ধনী থেকে আধ হাত পরিমাণও দূরে সরে যাবে তাদের গলদেশ থেকে ইসলামের বন্ধন, রশি খুলে যাবে যদি না সে তওবা করে পুনরায় ঐক্যবন্ধনীর মধ্যে অর্থাৎ কর্মসূচির মধ্যে ফিরে আসে। আর যে বা যারা জাহেলিয়াতের যুগের কোনো কিছুর (ভিন্ন কর্মসূচির) দিকে আহ্বান করে তারা সালাহ (নামাজ) কায়েম করলেও, সওম রাখলেও, নিজেদেরকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করলেও জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হবে” [হাদিস, হারিস আল আশয়ারি (রা.) থেকে তিরমিজি, আহমদ, বাব-উল-ইমারত, মেশকাত]।
রসুলাল্লাহর জীবনীতে আমরা দেখতে পাই, তিনি তাঁর সমগ্র জীবন সংগ্রাম করে গেছেন এই কর্মসূচি মোতাবেক। সবচেয়ে বড় কথা তিনি তাঁর হাতে গড়া তওহীদভিত্তিক জাতিটিকে এই কাঠামো অনুযায়ী গড়ে তুলেছেন। এই কাঠামোটা তিনি কোথায় পেয়েছেন তা তিনি হাদিসের শুরুতেই বলেছেন যে, “আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের আদেশ করেছেন।” অর্থাৎ এই কাঠামো যেহেতু স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত তাই মুসলিম দাবিদার জাতিকে এই কাঠামোর মধ্যেই জীবনধারণ করতে হবে আর এর থেকে আধ হাত সরলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। যে সরবে সে ব্যক্তিগতভাবে ইসলাম থেকে বহির্গত হয়ে যাবে, আর সামষ্টিকভাবে সরে গেলে গোটা জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে ও তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
হাদিসটিতে যে পাঁচটি কাজের আদেশ করা হয়েছে সেটাই হচ্ছে সমগ্র দুনিয়ায় আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার পবিত্র কর্মসূচি। এই পাঁচটি দফার সবগুলোই গুরুত্বপূর্ণ ফরদ কারণ পবিত্র কোর’আনে বহুবার এ কাজগুলোর হুকুম স্বয়ং আল্লাহ করেছেন। পবিত্র কোর’আনের বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে জাতির সদস্যদের মধ্যে এই ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, হেজরত ও জেহাদ প্রতিষ্ঠার তাগিদ। এগুলোকেই সূত্রাকারে সাজিয়ে রসুলাল্লাহ উপরে বলে আসা হাদিসটির মধ্যে বর্ণনা করেছেন।
অত্যন্ত সহজ ভাষায় বর্ণিত এ হাদিসটি একবার পড়লেই আমাদের চোখের সামনে জাতির যে কাঠামোটি ভেসে উঠবে তা হলো-
আল্লাহর হুকুমের পক্ষে একটি জাতি ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ হবে। তাদের সবার জীবনের লক্ষ্য হবে একটি- আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করে সমগ্র মানবজাতির জীবনে শান্তি, ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। সেই জাতির একজন নেতা (এমাম) থাকবেন। তিনি কখন কী হুকুম দেন সে বিষয়ে জাতির প্রতিটি সদস্য থাকবে সজাগ ও সচেতন। তিনি যে হুকুমই দিবেন জাতির প্রতিটি সদস্য বিনাপ্রশ্নে, বিনা বাক্যব্যয়ে সে আদেশ পালন করবে। এই হচ্ছে জাতির চেইন অব কমান্ড। জাতির এমাম জাতিকে রসুলাল্লাহ যে লক্ষ্য জাতির সামনে নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছেন সেই লক্ষ্যপানে পরিচালিত করবেন। উম্মতে মোহাম্মদী যতদিন এই পাঁচদফা কর্মসূচির ভিতরে থেকে সংগ্রাম চালিয়ে গেছে ততদিন এ জাতি ছিল অপরাজেয়, প্রবল, দুর্ধর্ষ। তাদের সামনে ঝড়ের মুখে তুলোর মতো উড়ে গিয়েছিল কিংবদন্তীতুল্য রোমান সাম্রাজ্য, পারস্য সাম্রাজ্যসহ আরো বহু রাজশক্তির সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী। এই কর্মসূচি যতদিন অটুট ছিল, জাতির মেরুদণ্ড ছিল ঋজু, মস্তক ছিল উন্নত। যখনই জাতির নেতৃত্বস্থানীয়রা ক্ষমতার জন্য রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে জাতির ঐক্যকে খণ্ডিত করে ফেলল, পণ্ডিতগণ মাসলা মাসায়েল আবিষ্কার করার নেশায় দীনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, অতিব্যাখ্যা অতিবিশ্লেষণ করে জাতিকে বহু মাজহাব ফেরকায় বিভক্ত করে ফেলল তখনই জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে গেল। জাতির মধ্যে আর একক বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অস্তিত্ব রইল না। বহু নেতা গজিয়ে উঠল। কেউ রাজনৈতিক কেউবা ধর্মতাত্ত্বিক কেউ বা আধ্যাত্মিক তরিকাপন্থী। বহু নেতা মানেই বহু জাতি। এক জাতির অস্তিত্ব আর রইল না। উপরন্তু এই বহু নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হলে তাদের অনুসারীরাও পরস্পরের বিরুদ্ধে শত্রুতায় মেতে উঠল। জাতি তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই হারিয়ে ফেলল। তখন তারা নামে মুসলিম, সংখ্যায় বিপুল হয়েও শত্রুর কাছে পরাজিত হতে লাগল। এক সময় মেরুদণ্ডহীন জাতি অন্যান্য সকল জাতির দ্বারা সামরিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে দাসজাতিতে, গোলাম জাতিতে পরিণত হলো। সেই গোলামি থেকে আজও তারা মুক্ত হয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের দিকে প্রত্যাবর্তন করেনি। তাদের মধ্যকার সেই বিভক্তি, অন্তর্কলহ, দ্বন্দ্ব, শত্রুতা আরো লক্ষগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো জাতির সদস্যরা আজ ভুলেই গেছে উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটিকে কী কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল আর রসুলাল্লাহ জাতিকে কোন কাঠামোর উপর গঠন করেছিলেন। তারা এই পাঁচদফার প্রতিটি দফাই ত্যাগ করে দিয়েছে।
ইতোপূর্বে বলেছি আল্লাহর দীনের আর সকল বিধানের মতো, আল্লাহর প্রতিটি হুকুমের মতো এই চেইন অব কমান্ড বা আনুগত্যের ধারাবাহিকতাও প্রাকৃতিক নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত। এটি যে কেবল উম্মতে মোহাম্মদীর কাঠামো তা-ই নয়, যে কোনো জাতি যদি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে চায় তার ভিতরে এই চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। অতীতের সকল বিজয়ী ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী জাতি নিজেদের চরিত্রে ও কাজে এই চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করার দরুনই শক্তিশালী হয়ে উঠতে পেরেছিল। যে কোনো জাতির মধ্যে যখন তার চেইন অব কমান্ডে দুর্বলতা দেখা যাবে, তখন সেই জাতি ধ্বংস হবে। এটা পরিবারের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের ক্ষেত্রে যেমন সত্য – তেমনি সত্য রাষ্ট্রের ব্যাপারে। জীবনের যে কোনো অঙ্গনে যেখানেই চেইন অব কমান্ড দুর্বল, সেখানেই ব্যর্থতা আসতে বাধ্য। অথচ বর্তমানে এ জাতির মধ্যে কোনো চেইন অব কমান্ডের অস্তিত্বই নেই।
প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থাতেও আমরা দেখে থাকি যে, যখন কোনো বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হয় তখন গণতান্ত্রিক দেশগুলো গণতন্ত্র ভুলে গিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করে এবং সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়ে দেয়। এর কারণ হলো, জরুরি সময়ে মত পাল্টা মতের ‘গণতন্ত্র চর্চা’র সুযোগ থাকে না। তখন প্রয়োজন পড়ে আদেশের সঙ্গে সঙ্গে আনুগত্যের। সারাবছর পিটি প্যারেড করে, ঊর্ধ্বতনের আদেশ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে এই আদেশ পালনের মহামূল্য চরিত্র অর্জন করেছে কেবল সেনাবাহিনী। তাই তাদেরকে জরুরি অবস্থায় তলব করা হয় নিমজ্জমান জাতির অস্তিত্ব টেকানোর জন্য। প্রাকৃতিক নিয়মগুলো আল্লাহরই প্রণিত আর তাই তিনি যখন জীবনবিধান প্রদান করেছেন সেই প্রাকৃতিক নিয়মগুলোর সাপেক্ষেই তা প্রণয়ন ও প্রদান করেছেন। তাই তিনি উম্মতে মোহাম্মদী জাতির মধ্যে কোনো সামরিক-বেসামরিক ভাগ করেন নি। গোটা জাতিকেই চেইন অব কমান্ডের অধীনে নিয়ে আসতে বলেছেন যেন শান্তিতে বা সংগ্রামে বা যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং তারা তাদের নেতার হুকুম ঠিক সেভাবেই মান্য করে যেভাবে একজন সৈনিক করে থাকে।
প্রচলিত রাষ্ট্রকাঠামোতে এই সামরিক বাহিনী ও বে-সামরিক নাগরিকের পৃথকীকরণের ফলে সাধারণ মানুষ সারাজীবন ঐক্যহীনতার চর্চা করে যায়, স্বেচ্ছাচারিতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। গণতন্ত্রে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করাকে উৎসাহিত করা হয়, তর্ক-বিতর্ক করাকে বলা হয় এটা হলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। একটি শক্তিশালী দল রাখা হয় কেবল সরকারের বিরোধিতা করার জন্য, ছিদ্রানুসন্ধান করার জন্য। এভাবে পুরো জাতিই সরকারের অবাধ্যতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, সরকার যে কোনো হুকুম দিলে সেটাকে অমান্য করাকেই কৃতিত্বের কাজ মনে করে। এর ফলে জাতির উন্নয়নযাত্রা সাংঘাতিকভাবে ব্যহত হয়। জাতি একতাবদ্ধ থাকলে যতটুকু অগ্রগতি হতো তার এক শতাংশও অর্জিত হয় না। জাতি যখন কোনো সংকটে পড়ে তখন এর কুফল ভয়ানক মূর্তি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। সরকারপ্রধান যা-ই বলুক না কেন, জনগণ তার কোনো আনুগত্যই করে না। আনুগত্য লংঘন শুরু হয় সরকারের আমলাদের দ্বারা যারা সরকারের হাত-পায়ের মতো কাজ করে, যাদের ছাড়া সরকার অচল। সেই আমলাগণ, জনপ্রতিনিধিগণ যখন সরকারের আহ্বানে সাড়া দিতে পরাঙ্মুখ হয় বা দায়সারা গোছের কাজ করেন তখন রাষ্ট্রনায়ক অসহায় হয়ে পড়েন। তার কোনো আদেশই আর কার্যকর হয় না।
আজকে যে করোনাদুর্যোগ চলছে তার মোকাবেলার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো একটি সিদ্ধান্ত বা উদ্যোগও ফলপ্রসূ হয় নি এটা দৃশ্যমান বাস্তবতা। এর কারণ জাতির মধ্যে কোনো চেইন অব কমান্ড নেই যা কিনা জাতির সত্যিকার মেরুদণ্ড। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিচ্ছে, হাজার হাজার মেট্রিক টন খাদ্য ত্রাণের জন্য বরাদ্দ দিচ্ছে কিন্তু সরকারের আদেশ আদেশের মধ্যেই বন্দী থেকে যাচ্ছে, যাদের সেসব ত্রাণ বা অর্থ প্রাপ্য ছিল সেগুলো তাদের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে না। দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও আমলারা সেগুলো সাবাড় করে দিচ্ছে। সরকার লক ডাউন বা সামাজিক দূরত্বের যে সব নীতিমালা দিয়েছে সেগুলো কোনোটাই জাতি মানে নি। ঈদের আগে রাজধানী ত্যাগ বা রাজধানীতে প্রবেশ নিয়ে সকল কঠোর সিদ্ধান্তই বাতিল করতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছে সরকার। ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী গুজব রটিয়ে বা মানুষের ধর্মানুভূতিকে উত্তেজিত করে সামাজিক দূরত্বের নিয়মকে লঙ্ঘন করেছে, মানুষকেও লঙ্ঘন করতে উৎসাহিত করেছে। সরকার কোনো কঠোর পদক্ষেপই নিতে পারে নি। কারণ একটাই- চেইন অব কমান্ডের অনুপস্থিতি। সরকার জানে যে তার নাগরিক বিশৃঙ্খল, তারা সরকারের কোনো কথা শুনবে না।
রাষ্ট্র কর্তৃক নির্মিত জাতির মধ্যে বিরাজিত সকল ব্যবস্থাই যে ভেঙে পড়েছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাস্থ্য বিভাগ অচল, মানুষ কোনো কিছুরই চিকিৎসা পাচ্ছে না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, কর্মসংস্থান হারিয়ে ফেলেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শতবার নির্দেশ দিয়েছেন, স্বল্প সুদে ঋণের ঘোষণা দিয়েছেন কিন্তু কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেই, ওদিকে ঋণের টাকা যে প্রকৃত উদ্যোক্তা বা কৃষকের কাছে যাবে না তা চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়। প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর এই ব্যর্থতা ও মুখ থুবড়ে পড়ার বিবরণ দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, ওসব বিবরণ দৈনিক পত্রিকায় চোখ বুলালেই জানা যাবে। আমরা এই ভেঙে পড়া সিস্টেমের কাঠামোগত ত্রুটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যেন চূড়ান্ত ধ্বংসের পূর্বে জাতি তার ভুলটা জানতে পারে এবং সচেতন হলে বাঁচার শেষ একটা সুযোগ লাভ করতে পারে। সেই বাঁচার পন্থা হচ্ছে, উপরে বর্ণিত আল্লাহ প্রদত্ত পাঁচদফা কর্মসূচির ভিত্তিতে জাতির কাঠামো নির্মাণ করা। জাতিকে এই শিক্ষায় শিক্ষিত করা যে, আমরা এক জাতি। আমাদের এক নেতা। সেই নেতার কোনো ভুল ত্রুটি আমরা দেখব না, তিনি যোগ্য কি অযোগ্য দেখব না। কারণ চুলচেরা বিচার করলে কোনো মানুষকেই ত্রুটিহীন বলে রায় দেওয়া যাবে না। তথাপি সফলতার জন্য একজন নেতার আনুগত্য আমাদের করতেই হবে। আমরা সামরিক বাহিনীর মতো গোটা জাতি নেতার আদেশে নিজেদের জীবন সম্পদ যা লাগে সব কোরবান করব। আমাদের নেতা আমাদেরকে যে আদেশ করেন বিনা প্রশ্নে বিনা দ্বিধায় বিনা বাক্যব্যয়ে সে আদেশ মান্য করব। আমরা যদি আমাদের জাতির মধ্যে এই ঐক্য, শৃঙ্খলা ও আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারি তাহলে করোনা কেন যে এর চেয়ে কঠিন সংকটেও আমাদের মেরুদণ্ড থাকবে পাহাড়ের মতো অনড়, আমাদের মস্তক থাকবে উন্নত, শক্তি হবে বজ্রের সমান। হেযবুত তওহীদ এমন জাতি নির্মাণের জন্য চেষ্টা করছে এবং যারা হেযবুত তওহীদের সদস্য নয় তাদের প্রতিও উদাত্ত আহ্বান ও প্রস্তাবনা পেশ করছে যেন তারা আল্লাহর দেখানো পদ্ধতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে হলেও এক নেতার আনুগত্যে অবিচল সুশৃঙ্খল জাতি গঠনের জন্য সচেষ্ট হয়।