স্বাধীনতার ৫১ বছর পূর্ণ হলো। এখন এই প্রশ্নটি তোলা অত্যন্ত যৌক্তিক যে স্বাধীনতা যুদ্ধটা কেন হয়েছিল এবং যে লক্ষ্যে হয়েছিল তা কি ৪৫ বছরে অর্জিত হয়েছে কিনা? এই স্বাধীনতা কিন্তু একদিনে অর্জিত হয় নি। ১৯৭১ সন ছিল মূলত দীর্ঘ বঞ্চনা, শোষণ, জুলুম, আমলাতান্ত্রিকতা, ধর্মান্ধতা, ধর্মব্যবসাসহ পাকিস্তান সরকারের হাজারো অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ১৯৪৭ এ যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর দেশ ভাগ হলো, কথা ছিল পাকিস্তান হবে মুসলিমদের দেশ আর সেটা ইসলামের মূল্যবোধ দিয়ে পরিচালিত হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানুষ ইসলাম পায় নি, ইসলামের প্রতিশ্রুত সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায় বিচার কিছুই পায় নি। বরং পেয়েছে সেই ব্রিটিশ কলোনি সিস্টেম। আগে মানুষ কর দিত ব্রিটিশদেরকে, সাদা চামড়ার মানুষদেরকে, ৪৭ এর পরে কর দেওয়া শুরু করল পশ্চিম পাকিস্তানীদেরকে। আবারও সেই বুর্জোয়া শ্রেণির শাসন আর জুলুমের চিরচেনা দৃশ্য।
তারপরে প্রাকৃতিক নিয়মেই পাকিস্তানী শাসনের পতনের ঘণ্টা বেজে উঠল। মানুষ সৃষ্টিগতভাবে স্বাধীন। তাকে চিরকাল শোষণ করা যায় না, দমিয়ে রাখা যায় না, তাদের মনে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয় যা একটি সময় আগ্নেয়গিরির মত ঠিকই বিস্ফোরিত হয়। ১৯৭১ সালে সেটাই হয়েছিল। সেই থেকে ৫১ বছর চলে গেল, তখন আমাদের অর্থ পাচার হয়ে যেত ব্রিটেনে, এরপর আমরা দেখলাম আমাদের কষ্টার্জিত সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানে, কিন্তু গত ৪৫ বছরে আমরা হাজার হাজার কোটি ডলার পাচার করেছি কোথায়? আজও সেই একই ধারাবাহিকতা। আর দেশের অভ্যন্তরে সেই ধর্মান্ধতা, ধর্মের নামে সংঘাত, সেই একইভাবে জাতিকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার সকল প্রক্রিয়া চলছে। কাজেই ৭১-এর যে মূল চেতনা ছিল তা মুখ থুবড়ে পড়েছে বহু আগেই। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের অত্যাচারী শাসকের দাপটে দুর্বল জনতা থর থর করে কাঁপতো, আর এখন তাদের জায়গায় নব্য হানাদাররা শুরু করেছে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, জালিয়াতি, রাজনীতির নামে লুট। আর অধিকাংশ জনতা অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। কাজেই সেই স্থবিরতা, সেই কূপমণ্ডূকতা, সেই লুটতরাজ, সেই জুলুম, সেই অন্যায় বহু বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন বৃদ্ধ লোককে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে যিনি ব্রিটিশ যুগ দেখেছেন পাকিস্তান যুগ দেখেছেন আবার স্বাধীন বাংলাদেশও দেখেছেন, তিন কালের মধ্যে পরিসংখ্যান করলে যে চুরি-ডাকাতি, খুন, রাহাজানী বেড়েছে না কমেছে? নিশ্চয়ই তিনি বলবেন বেড়েছে। তাহলে আমাদের অর্জন কোথায় গেল? হ্যাঁ, বস্তুগত উন্নয়ন হয়েছে। ব্রিজ কালভার্ট, দালানকোঠা হয়েছে। কিন্তু আমাদের আত্মা পচে গেছে, মানবতাবোধ হারিয়ে গেছে, দুই বছরের শিশু ধর্ষিত হচ্ছে, আর আমাদের আত্মা পর্যন্ত পাশ্চাত্যের ঋণের জালে বন্দী। এককেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থা যেভাবে চলছে তাতে সাম্রাজ্যবাদী দানবদের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করাই হবে আগামী দিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এতো গেল দেশের অবস্থা। পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর যে নৃশংসতা চলছে আমরা তার বিরুদ্ধে মৌখিক প্রতিবাদ ছাড়া কিছুই করতে পারছি না, কারণ এই আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের কিছু করার থাকে না। কেউ কেউ উদ্বাস্তু শিবিরে গিয়ে শীতবস্ত্র, খাদ্য সামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু মূল সমস্যা তাতে দূর হবে না। তাদের দরকার হচ্ছে পায়ের নিচের মাটি, তাদের পূর্ব পুরুষের বাসস্থান, প্রয়োজন একটি আত্মপরিচয়, আত্মমর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। বিশ্ব-সম্প্রদায়ের সবাই মিলে মায়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করে সেটার ব্যবস্থা করতে না পারলে উদ্বাস্তুরা ক্রমেই মাদকব্যবসা, দেহব্যবসা, জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন অন্ধকার পথে পা বাড়াতে বাধ্য হবে। এই চাপ প্রয়োগ করা অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত, কারণ যেখানেই মানবতা বিপন্ন সেখানেই মানবিক সাহায্যের জন্য যে কোনো পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘসহ অন্যান্য জাতিরাষ্ট্রগুলো অঙ্গীকারাবদ্ধ। রোহিঙ্গারা যদি মুসলমান না হয়ে খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠী হতো তাহলে হয়তো আমরা তাদের বিষয়ে বিশ্ব-সম্প্রদায়ের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পেতাম। ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীকে স্বার্থান্বেষীরা বহুভাবে ব্যবহার করে থাকে। যে অবর্ণনীয় দুঃসহ মর্মান্তিক ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে তাদের জীবন যাচ্ছে তাতে ঐ সমাজের প্রতি তাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকবে। তাদের সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ যে কোনো নৃশংস ঘটনার মাধ্যমে তারা ঘটাতে পারে, এটা মনস্তত্ত্ববিদদের, সমাজবিজ্ঞানীদের, রাষ্ট্রনায়কদের অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। এখন চাল ডাল শীতের কাপড় যারা দিচ্ছেন তারা মহৎ কাজ করছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু এতে করে নৃশংসতা বন্ধ হবে না, মানবতা প্রতিষ্ঠা হবে না। কারণ চলমান বিশ্বব্যবস্থাটাই মানবতাহীন, বস্তুবাদী, স্বার্থবাদী, নির্মম। তারা মানবতা শব্দটিকেও ছল, চাতুরি ও প্রতারণার কাজে ব্যবহার করছে।
এখন মানবজাতিকে যদি রক্ষা পেতে হয় তাহলে দরকার আরেকটা রেনেসাঁ ঘটানোর। ইউরোপে রেনেসাঁ হয়েছিল প্রাচীন চিন্তার স্থবিরতা, জড়ত্ব, ধর্মের নামে অধর্ম, রাজা ও সামন্ত প্রভুদের যাঁতাকলের নি®েপষণের বিরুদ্ধে। মানুষের অপার চিন্তাশক্তিকে জাগিয়ে তুলেছিল সেই রেনেসাঁ। ইউরোপের মানুষ যখন বিকৃত ধর্মের চোখ রাঙানি ও অত্যাচারীর চাবুককে উপেক্ষা করে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ হলো তারা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে নব নব আবিষ্কার করতে সক্ষম হলো, তারা শিল্পকলায় বিস্তর উন্নতি করল, বহু রাজনৈতিক মতবাদ আবিষ্কার করল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটি উদার শান্তিময় স্বর্গীয় পৃথিবী। কিন্তু রেনেসাঁর ধারকরা দুনিয়াটাকে নিজেদের উপনিবেশ বানিয়ে শোষণ করতে শুরু করল।
তাদের কাজের ফলে জন্ম নিল একটি আত্মাহীন, মানবতাবর্জিত, বস্তুতান্ত্রিক, ভোগবাদী সভ্যতা, যার একমাত্র লক্ষ্য হলো যান্ত্রিক প্রগতি ও বৈষয়িক উন্নতি। এটা আসলে প্রকৃত সভ্যতাই নয়। গত শতকে পরপর দুটো বিশ্বযুদ্ধ হওয়ার মাধ্যমেই প্রমাণ হয়ে গেল যে এই সভ্যতা মানুষকে অনেক উন্নত যন্ত্র উপহার দিতে পারলেও শান্তি ও মানবাধিকার দিতে পারে নি এবং পারবেও না। তখন থেকে চলছে শুধু পারমাণবিক শক্তির শাসন, তার সামনে সবাই স্রেফ বোবা, কালা অন্ধ। সেখানে চলছে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, সরলের উপর ধূর্তের বঞ্চনা, দরিদ্রের উপর ধনীর শোষণ, শাসিতের উপর শাসকের জুলুম। নরকযন্ত্রণা কি এর থেকেও কঠিন?
তবুও আমরা যুগের পর যুগ সেই অন্তঃসারশূন্য পশ্চিমা সভ্যতাকেই অন্ধের মতো অনুকরণ, অনুসরণ করে যাচ্ছি, শান্তির জন্য বিকল্প চিন্তা করতে পারছি না। আমাদের মস্তিষ্কগুলো আবারও সেই ইউরোপের রেনেসাঁপূর্ব সময়ের মত জড়ত্ব আর স্থবিরতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কথিত সভ্যতার আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার বেড়াজালে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, শোষিত হচ্ছে, উদ্বাস্তু হচ্ছে। কিন্তু মানুষ অসহায়, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে – তাদের কিছুই করার নেই। অর্থাৎ মানবজাতি অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, সে স¤পূর্ণ আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর জীবনযাপন করছে। এখানেই মানুষ হিসাবে মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।
এ অবস্থায় অনিবার্য হয়ে পড়েছে আরেকটি রেনেসাঁ, যা মানুষের চিন্তার স্থবিরতা, দৃষ্টির অন্ধত্ব দূর করবে আর হৃদয়ের উপলব্ধি ক্ষমতা জাগ্রত করবে, অবশ হওয়া হাত দুটোকে মুষ্ঠিবদ্ধ করে প্রতিবাদে আসমানের দিকে উত্থিত করবে। মানুষের সেই জাগরণই পারবে আসন্ন ভয়াবহ ধ্বংস থেকে পৃথিবীকে, মানবজাতিকে উদ্ধার করতে। প্রযুক্তির জাগরণ কম হয় নি, এবারের জাগরণ হবে মানবিকতার। প্রযুক্তির সাথে মানবতা যোগ হলেই মানুষ প্রকৃতপক্ষে সভ্য হবে, উন্নত হবে।