শিরোনাম পড়ে অনেকের মনে খটকা লাগতে পারে যে এ আবার কেমন কথা? আমরা মুসলমানরা তো সবাই উম্মতে মোহাম্মদী, মোহাম্মদ (সা.) এর অনুসারী। তাহলে এমন প্রশ্ন আসলো কী করে? এই প্রশ্নটি আসলো, কারণ আমাদের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। রসুলাল্লাহ যে জাতিটিকে নিজে হাতে গড়ে তুলেছিলেন সেই জাতির আকিদা, দৃষ্টিভঙ্গি আর আমাদের এই বর্তমানের ১৬০ কোটি মার খাওয়া মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। এজন্যই বড় প্রশ্নটি উঠেছে যে, রসুলাল্লাহ (সা.) তাঁর তৈরি জাতিকে নিয়ে কী করে গিয়েছেন এবং আমরা নিজেদেরকে নবীর উম্মত দাবি করে কী করছি? আসুন দেখা যাক।
রসুলাল্লাহ সকল নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নবী এবং তিনি সারা পৃথিবীর নবী। নবুয়্যত প্রাপ্তির পর তিনি কী করলেন? রসুলাল্লাহর কর্মক্ষেত্র পুরো দুনিয়া। তিনি পুরো পৃথিবীপশ আল্লাহ প্রদত্ত জীবন-ব্যবস্থা তথা দীনুল হক প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটা উম্মাহ তৈরি করলেন, যার নাম উম্মতে মোহাম্মাদি। তিনি উম্মাহ তৈরি করলেন। আরবের সেই লোকগুলোকে, যারা মদ খেয়ে পড়ে থাকতো, হাটে-বাজারে মাতলামি করতো। যারা অন্য গোত্রের নারীদেরকে লুট করে নিয়ে আসত, যার কোনো বিচার হতো না। চুরি-ডাকাতি করত, এক গোত্রের সথে আরেক গোত্রের হানাহানি-রক্তপাত শত শত বছর ধরে চলত। বাবা মারা গেল সৎ ছেলেরা সৎ মাকে বিয়ে করত। কন্যা সন্তানদের জীবিত কবর দিত। দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনাই ছিল স্বাভাবিক রীতি। আল্লাহর রূহধারী সেরা জীব মানুষ হয়েও তারা কাঠ-পাথরের মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়ে থাকত। তাদের কোনো নেতৃত্ব ছিল না, কেউ কারো কথা কেউ শুনে না।
ওই মানুষগুলোকে রসুল একজন একজন করে বুঝালেন, তুমি আল্লাহর খলিফা। তুমি ইবলিসের খেলাফত করো না। তুমি লাত, মানাত, ওজ্জার দাস না। তুমি আল্লাহর খলিফা, আল্লাহর দাস। আসো, তুমি আল্লাহর খেলাফত করো। রসুলাল্লাহ মানুষকে বললেন, বলো, লা ইলাহা ইলল্লাল্লাহ, আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই। এইভাবে একে একে মানুষগুলোকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর উপর তিনি ঐক্যবদ্ধ করলেন। সেটা কেমন ঐক্য? সীসাগলানো প্রাচীরের ন্যায় ঐক্য। ঐক্যবদ্ধ যখন করলেন, তখন তারা জাহেলি সমাজ থেকে আলাদা হয়ে গেলেন এবং আলাদা একটি জাতি তৈরি হলো। আলাদা করে তিনি তাঁর তৈরি জাতিকে শৃঙ্খলা শিক্ষা দিলেন। তাদেরকে আনুগত্য করা, যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা দিলেন, অনুপ্রেরণা দিলেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে রসুল সংগ্রাম করলেন, সংগ্রামের যাবতীয় কষ্ট ভোগ করলেন। তাদের দুঃখে দুঃখী হলেন, সুখে সুখী হলেন। তিনি তাদের দুঃখ-দুর্দশা শুনতেন। তাদের উপর অত্যাচার হলে তাদেরকে সবর ধারণ করার নসিহত করতেন, আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতেন। অর্থাৎ রসুল তাদেরকে আশা দিলেন, ভরসা দিলেন, অনুপ্রেরণা দিলেন, উদ্দীপনা দিলেন। তাদের সঙ্গে থেকে রসুল (সা.) একটা জাতি তৈরি করলেন। রসুলাল্লাহ নিশ্চয়ই এই জাতিটি একটি লক্ষ্য নিয়ে তৈরি করলেন। সেই লক্ষ্য হলো, পুরো পৃথিবীময় আল্লাহর দেওয়া জীবন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যে জীবন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলে, পৃথিবীময় মানুষ সুখে-শান্তিতে নিরাপদভাবে বসবাস করতে পারবে।
তিনি নিজে সামনে থেকে জাতিকে সংগ্রামে নেতৃত্ব দিলেন। খেয়ে না খেয়ে, পেটে পাথর বেঁধে, গাছের লতা-পাতা খেয়ে, শত্রুর আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে, রক্ত ঝরিয়ে আরব উপদ্বীপে এই দীনুল হক প্রতিষ্ঠা করলেন। ওমান, ইয়েমেন, সৈাদি আরব, কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এই অংশটিকে আরব উপদ্বীপ বলা হয়। এই আরব উপদ্বীপের মধ্যে রসুলাল্লাহ দীন-প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে আল্লাহর কাছে চলে গেলেন।
রসুলাল্লাহ সারা পৃথিবীর মানুষের নবী। তাঁর উপর দায়িত্ব পুরো পৃথিবীতে আল্লাহর দেওয়া জীবন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। পুরো পৃথিবীময় আল্লাহ প্রদত্ত জীবন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার সেই দায়িত্ব তিনি চলে যাওয়ার আগে তাঁর তৈরি সেই জাতি উম্মতে-মোহাম্মাদীদের উপর রেখে গিয়েছেন। বিদায় হজের ভাষণে স্পষ্টভাবে বলে গিয়েছেন, নারী উপর পুরুষের অধিকার, পুরুষের উপর নারীরও তেমন অধিকার রয়েছে। সাদার উপর কালোর, কালোর উপর সাদারও কোনো মর্যাদা নেই, আযমের উপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আল্লাহর কছে শ্রেষ্ঠ তিনিই, যিনি তাকওয়ায় অগ্রণী। তাকওয়াবান অর্থাৎ যিনি ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ডে, যিনি ন্যায়ের পক্ষে থাকবেন। এখানে সাদা-কালো, আরবি-আযমি, উচ্চ বংশ-নিম্ন বংশের, কোনো পার্থক্য নেই। আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি মূল্যবান, যে ব্যক্তি ডানপথ অবলম্বন করবেন। ডানপথ অর্থাৎ যে তাকওয়া অবলম্বন করবেন।
রসুলাল্লাহ চলে যাওয়ার পর তাঁর তৈরি সেই উম্মতে মোহাম্মদীগণ, সাহাবাগণ বাকি দুনিয়াতেও সীমাহীন ত্যাগ, জুলুম, নির্যাতন সহ্য করে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন-ব্যবস্থা দীন প্রতিষ্ঠা করে গেলেন। তখন কিন্তু এখনকার মতো এত দলাদলি, ফেরকা-মাজহাব, সৃষ্টি হয়নি, ঐক্য নষ্ট হয়নি, এত বাড়াবাড়ি হয়নি, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তর্ক-বিতর্ক হয়নি। আমরা ছিলাম একজাতি। নেতা ছিলেন একজন। হুকুম মেনে চলতাম আল্লাহর। তখন আমরা সেরা জাতি ছিলাম। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে, আমরা ছিলাম শিক্ষকের আসনে আসীন।
কিন্তু পরবর্তী ইতিহাস অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। রসুল চলে গেলেন, সাহাবারা চলে গেলেন, তাবে-তাবেয়ীনরাও চলে গেলেন। দুই-চারশত বছর চলে গিয়েছে। এরপর থেকেই শুরু হয়ে গেল বিকৃতি। আমরা উম্মতে মোহাম্মদী জীবনের লক্ষ্য ভুলে গেলাম, কর্মসূচি হারিয়ে ফেললাম, ঐক্য নষ্ট করলাম, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করলাম, যে বিষয়ের কোনো গুরুত্ব নেই, সেটাকে মহাগুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে এক নাম্বারে নিয়ে আসলাম। যেমন- আপনি খেতে বসেছেন, আপনার খাওয়ার জন্য লাগবে ভাত। ভাতের খবর নেই, আপনার সামনে একবাটি লবণ নিয়ে আসা হলো। এরকমভাবে আমরা গুরুত্বহীন বিষয়কে মহাগুরুত্বপূর্ণ আর মহাগুরুত্বপূর্র্ণ বিষয়কে একেবারেই গুরুত্বহীন বানিয়ে ফেলেছি। ইসলামের ক্ষেত্রে বলা যায়, দীন প্রতিষ্ঠা করতে লাগবে সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম নাই, দাড়ি, টুপিকেই প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত করা হলো। যে কারণে আমরা নিজেদেরকে নবীর উম্মত দাবি করেও রসুলাল্লাহ যা করে গিয়েছেন, তার পুরো বিপরীত কাজটিই আমরা করছি।
রসুলাল্লাহ (সা.) তাঁর পুরো জীবনজুড়ে পুরো পৃথিবীময় মানবজাতিকে তওহীদের উপর ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন। আর আমরা নিজেদেরকে নবীর উম্মত দাবি করেও, আমরা আল্লাহর তৈরি জীবন-ব্যবস্থা জীবনের সর্ব অঙ্গনে না মেনে মানুষদের তৈরি জীবন-ব্যবস্থা মেনে চলছি। আজ আমরা নিজেরাই এক মাজহাব আরেক মাজহাবকে, এক আলেম আরেক আলেমকে অমুক কাফের, অমুক খ্রিষ্টান, অমুক ইহুদি, অমুক বেনামাযি ইত্যদি সর্বত্র বলে, নিজেদেরকে নবীর উম্মত হিসেবে দাবি করছি। নিজেদেরকে আখেরি নবী বিশ্বনবীর উম্মত দাবি করে আমরা অন্তত এই কথাগুলো বলতে পারি না। আমাদের দৃষ্টি সংকীর্ণ হলে চলবে না।
এক আল্লাহ, এক রসুল, এক কেতাবের অনুসারী হয়েও মুসলমান জাতি আজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। জাতি হিসেবে আজ সর্বপর্যায়ে আমরা অন্যান্য জাতিগুলোর হাতে পরাজিত হচ্ছি। গত কয়েক শতাব্দি ধরে তাই চলছে। পরবর্তীতে আমরা হালাকু খানের হাতে মার খেয়েছি, কচুকাটা হয়েছি, রুখে দাঁড়াতে পারি নাই। ইউরোপিয়ানদের হাতে মার খেয়েছি, তারা চলে যাওয়ার পর আমাদেরকে একটি বিকৃত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জীবনধারা দিয়ে গিয়েছে। যে ব্যবস্থাই আমরা সর্বত্র মেনে চলছি। আল্লাহর তৈরি জীবব্যবস্থা না মেনে ইউরোপীয়ানদের তৈরি জীবন-ব্যবস্থা মেনে চলে আমরা আজ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি। এখন জাতি এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে। সকল মানুষের উদ্দেশে আমরা হেযবুত তওহীদ বলতে চাই, যে কোনো মূল্যে, যেকোনো ভাবে জাতিটাকে রক্ষা করতে হবে, ঈমানে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, তওহীদে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সেই ঐক্যের ভিত্তি হলো “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই। এই কথার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে মানবজীবনে এই সত্যদীনটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।