অরাজনৈতিক আন্দোলন হেযবুত তওহীদের এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম। জঙ্গিবাদ, ধর্মান্ধতা, সন্ত্রাসবাদ, ধর্মব্যবসা, উগ্রবাদ, অপরাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর বজ্রকণ্ঠ সকল শ্রেণির মানুষের কাছে বেশ আলোচিত। গত ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে বরিশালের শিল্পকলা একাডেমীতে হেযবুত তওহীদের স্থানীয় সদস্যদের একটি কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চরমোনাই পীরের অনুসারীরা সন্ত্রাসী হামলার হুমকি দিয়ে প্রশাসনকে বাধ্য করে অনুষ্ঠান স্থগিত করার জন্য। এ বিষয়ে হেযবুত তওহীদের শীর্ষনেতা দেশেরপত্রের সঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন দেশেরপত্রের প্রতিনিধি শামীমা অবন্তি।
দেশেরপত্র: আমাদের জানা মতে, বরিশালে চরমোনাই পীরের অনুসারীরা বহু আগে থেকেই হেযবুত তওহীদের বিরোধিতা করে আসছে। বরিশালে কর্মীসভায় তাদের হামলা হতে পারে বা বাধার মুখে পড়তে পারেন, এমন কোনো আশঙ্কা কি আপনাদের ছিল?
হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম: এমন আশঙ্কাতো ছিলই। কেননা আমি চরমোনাইদের ভালোভাবেই চিনি। তারা কতটা জঘন্য ষড়যন্ত্র করতে পারে সে ব্যাপারে আমি যথেষ্ট অবগত ছিলাম। বরিশালে কর্মীসভা করার ১৫/২০ দিন আগে পার্শ্ববর্তী এলাকার তিনটি মসজিদে আমাদের কর্মীসভা বানচাল করার জন্য অপপ্রচার চালানো হয়েছে। চরমোনাই পীরের অনুসারীরা হামলা করার জন্য সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন মিথ্যাচার করে উস্কে দিয়েছে। কিন্তু তারা সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেনি। কারণ সাধারণ মানুষ ইতোমধ্যেই আমাদের বক্তব্যও শুনেছে, ফলে তারা হুজুরদের ডাকে হুজুগে মাতেনি। কর্মীসভার কয়েকদিন আগে সেখানে আমাদের একটি মিটিং হয়েছে এবং চারজন লোক নতুন যোগদান করেছেন। তবে চরমোনাই পীরের অনুসারীরা এলাকার কিছু মানুষের কাছ থেকে এলাকার অধিকার খাটিয়ে গণস্বাক্ষর নিয়েছে যে এখানে আমাদের কোনো কার্যক্রম করতে দেওয়া হবে না। থানা পুলিশ আমাদের কাছে সেটি নিয়ে এসেছেন এবং তখন সেখানে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে একটু উত্তেজনা ছিল। সেজন্য এটা আমার ধারণার মধ্যে ছিল যে তারা কোনো একটি ঝামেলা করতে পারে। আবার এভাবে ভাবিও নি, কারণ কর্মীসভা হওয়ার কথা ছিল শিল্পকলা একাডেমির হলের ভিতরে যা ছিল সিটি কর্পোরেশনের মূল প্রাণকেন্দ্র। ফলে একদিকে যেমন ভেবেছি নিরাপদেই অনুষ্ঠান শেষ করা যাবে, অপরদিকে তাদের সামগ্রিক অপতৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে সমস্যার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে পারিনি।
দেশেরপত্র: প্রশাসনের মধ্যে কি চরমোনাইয়ের অনুসারী আছে বলে আপনি মনে করেন?
হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম: বরিশালের ঘটনার দুইদিন আগেই আমরা লিখিত ও মৌখিকভাবে বিষয়টি প্রশাসনের নজরে এনেছিলাম। প্রশাসনের দারোগা থেকে শুরু করে কমিশনার পর্যন্ত একটি কথাই বলেছি যে দেখেন, চরমোনাই পীরের অনুসারীরা অনেক অসভ্য, অনেক বিশৃঙ্খল, উচ্ছৃঙ্খল ও এদের সংখ্যা অনেক বেশি। এরা আসলে কোনো কথা মানে না, প্রশাসনের কাছে কোনো অনুমতিও নেয় না, এদের যা খুশি তাই করে। এখানে এক সপ্তাহ আগে হিন্দুদের কোনো একটি মিষ্টির দোকানে ১০ টাকার জন্য তারা একটি অনর্থক পরিস্থিতি, বিরাট একটি গণ্ডগোল সৃষ্টি করে দিয়েছিল। এখন এখানে আমরা যদি কর্মীসভা করতে চাই, তাহলে তারা এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এদের মাদ্রাসার স্টুডেন্ট আছে, কিছু অনুসারী আছে, সবমিলেয়ে জায়গাটা রণক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। চরমোনাইয়ের পীরের অনুসারী প্রশাসনের ভিতরে আছে কিনা বা প্রশাসনের কেউ তাদের সমর্থন করে কিনা তা আমরা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। কিন্তু কিছু কিছু কর্মকর্তার আচার-আচরণে এধরনের কথা মনে হয় যে চরমোনাই পীরের অন্ধ অনুসারী প্রশাসনের ভিতরে আছে।
দেশেরপত্র: অনেক গণমাধ্যমে এসেছে যে আপনারা বরিশালে চরমোনাইয়ের মুখোমুখি হয়েছে। এখন বরিশালে আপনাদের কাজের কৌশল কী হবে?
হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম: বরিশালে আমাদের কাজের স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল বরাবরই একটিই। আর সেটা হচ্ছে হেযবুত তওহীদ একটি আদর্শিক আন্দোলন, আমাদের কাজ হচ্ছে আমাদের বক্তব্য জনগণকে জানানো। সেটা জনগণ গ্রহণ করবে কিনা সেটা তাদের ব্যাপার। আমাদের কৌশল সবসময় একই থেকেছে। মাঝখানে আমাদের বৈধ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সেগুলো আমরা মোকাবেলা করেছি। তবে আমাদের মূল কাজ হল সাধারণ জনগণের কাছে আমাদের বক্তব্য পৌঁছে দেওয়া। কেননা আমরা মনে করি, যতক্ষণ সাধারণ জনগণ আমাদের সম্পর্কে না জানবে, ততক্ষণ চরমোনাইয়ের মত গোষ্ঠীরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার দূরভিসন্ধি করতে পারে। যদি জনগণ আমাদের কথা জানতে পারে, তবে আমরা কী করি, আমাদের লক্ষ্য কী, উদ্দেশ্য কী, আমরা কারা, আমাদের অভিপ্রায় কী, আমরা কি ইসলাম চাই নাকি অন্যকিছু চাই- এসব জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। তখন ধর্মব্যবসায়ীরা আর হালে পানি পাবে না, জনগণের মধ্যে তাদের আর জায়গা হবে না। তাই আমাদের কৌশল একটিই, আমাদের বক্তব্য যেকোন মূল্যে জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে।
দেশেরপত্র: যেহেতু চরমোনাই আপনাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তাই বলা যায় তারা আপনাদের বিরুদ্ধশক্তি। আপনি বিরুদ্ধ শক্তিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন? বরিশালে হেযবুত তওহীদ আসলে কতটুকু শক্তিশালী চরমোনাইয়ের তুলনায়?
হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম: আসলে অতীতে এদের মোকাবেলা কেউ করে নি। মোকাবেলা না করলে তো আপনি বুঝতে পারবেন না যে আপনি আসলে কতটুকু শক্তিশালী। একজন খেলোয়াড় জাতীয় নাকি আর্ন্তজাতিক মানের তা খেলার মাঠে কোনো প্রতিপক্ষের বিপরীতে না দাঁড়ালে তো প্রমাণিত হয় না। তাদের অন্ধত্বের সামনে আজ পর্যন্ত কেউ দাঁড়ায় নি। কারণ ধর্ম একটি সেনসেটিভ ইস্যু, এই ইস্যুটাকে মোকাবেলা করার মত হিম্মত নিয়ে কেউ দাঁড়াতে পারে নি। যারা এখন মাঠে রাজনীতি করছেন, তারা আসলে সেকুলার রাজনীতি করছেন। তারা ধর্মের অঙ্গনে যেতে চান না, ঘাঁটতে চান না। তাছাড়া ধর্মের বিষয়ে মোল্লা শ্রেণির বিপক্ষে যথাযথ উত্তর দেওয়ার মত প্রস্তুতি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নেই, তাদের আদর্শও এটা না। এজন্য চরমোনাইয়ের মোকাবেলা কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ করে নি।
হেযবুত তওহীদ একটি ইসলামিক আন্দোলন এবং ইসলামের আদর্শের দল। হেযবুত তওহীদই প্রথম চরমোনাইয়ের মোকাবেলা করতে দাঁড়িয়েছে। হতে পারে তাদের বিরাট সংখ্যা আছে। তবে আমি মনে করি বিশৃঙ্খল, ঐক্যহীন, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক সংখ্যার কোনো মূল্য নেই। সংখ্যার কথা বলতে গেলেও গত কয়েক মাসে প্রমাণিত হয়েছে যে সাধারণ জনগণের সমর্থন হেযবুত তওহীদের পক্ষে। আর চরমোনাই যদি সংঘাত চায় সেটা ভিন্ন বিষয়। সংঘাত মোকাবেলায় প্রথমেই আমরা প্রশাসনকে জানাবো, সরকারকে অবগত করব। তারপরে তো সর্বশেষ আমাদের আছে আত্মরক্ষার অধিকার। আমার বাড়ি-ঘর, অফিস, কার্যালয়, কল-কারখানা, ফ্যাক্টরি ও দোকান-পাটে যদি তারা হামলা করতে আসে তাহলে আমরা প্রতিরোধ করব। এই হচ্ছে আমাদের নীতি।
দেশেরপত্র: গত ২৩ জানুয়ারি বরিশালের কাশিপুরে একটি ওয়াজ মাহফিল হয়েছে, যার প্রধান অতিথি ছিলেন চরমোনাই নেতা ফয়জুল করিম। এই মাহফিলের আগে আপনারা আশঙ্কা থেকে প্রশাসনের কাছে একটি দরখাস্ত দিয়েছিলেন যে এখানে হামলা হতে পারে। তো সেই মাহফিলের বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম: হমলার আশঙ্কা যে ছিল তো একেবারে নিশ্চিত, কেননা এটাই তাদের চরিত্র। আমাদের কর্মীসভার (১৪ জানুয়ারি) আগের দিন তারা তা পণ্ড করে দেওয়ার জন্য ও অবরোধ করার জন্য অফিসের সামনে সন্ধ্যার দিকে লাঠি নিয়ে অবৈধ সমাবেশ করেছে এবং হামলার তোড়জোড় করেছে। আমাদের শক্ত অবস্থান ছিল, প্রশাসনও চায়নি কোনো ঘটনা ঘটুক। ফলে তারা সেখানে টিকতে পারেনি। তাহলে দুদিন পরেই সেখানে তারা মাহফিলের নামে উগ্রবাদি, সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড ঘটানোর জন্য পরিকল্পনা করবে এটা স্বাভাবিক কথা। ফয়জুল করিমের অতীতের রেকর্ড কিন্তু এটাই। হুমকি, উস্কানি, মিথ্যাচার ছাড়া তার আসলে কোনো বক্তব্য নেই। এরা ধর্মব্যবসার প্রয়োজনে ধর্মান্ধ মানুষকে মুগ্ধ করার জন্য কিছু আরবি আয়াত, দোয়া-কালাম বলে, কওমি মাদ্রাসায় পড়ে কিছু পরিভাষা জেনেছে। অজ্ঞ অন্ধ অনুসারীদের মুগ্ধ করতে সেটাই তারা কাজে লাগায়। আপনি মেডিকেল কলেজে পড়লে মেডিকেলের কিছু পরিভাষা শিখবেন, সামরিক কলেজে পড়লে কিছু মিলিটারি পরিভাষা জানবেন, কওমিতে পড়লে সেখানে কিছু পরিভাষা জানবেন। অন্যদের থেকে আপনার ভাষার মধ্যে সেসব পরিভাষার ব্যবহার বেশি হবে। এটা দেখেই সবাই ভাবে কি না কি। এদের আসলে ইসলামের কোনো জ্ঞান নেই, তাদের বক্তব্যের মধ্যে কোনো সারবস্তু নেই। টেনে টেনে সুর করে যা বলেন ওয়াজের নামে সেটাই মানুষ শোনে।
এরা এখন রাজনীতি করে। রাজনীতিতে যেমন মাঠ গরম রাখার জন্য, কর্মীদের চাঙ্গা রাখার জন্য একটি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতে হয়, উস্কানি দিতে হয়, প্রতিপক্ষকে হামলা করতে হয় বা একটি ইস্যু দরকার হয় ফয়জুল করিমের পলিসিও ঠিক তেমনই। সুতরাং, এই মাহফিলটা ছিল উস্কানিমূলক, হামলার প্রস্তুতিমূলক। আমরা এই খবর পেয়েছি প্রকাশ্য বা গোপন সূত্রে, যেভাবে হোক। তখন আমরা প্রশাসনকে জানিয়েছি। কারণ রাষ্ট্রকে জানাতে হবে। আমাদের আশঙ্কা যে সঠিক তা পরে প্রমাণিত হয়েছে। তাদের ওয়াজে রাত দশটা পর্যন্ত কোনো মুসল্লি আসে নি, সামনে দশ-বারো জন বাচ্চা-কাচ্চা বসে ছিল। এতে প্রমাণিত হয় ওদের ওয়াজে মানুষ যায় না। রাত সাড়ে দশটায় ফয়জুল করিম পাঁচ-দশ ট্রাক লোক নিয়ে আসে। এই লোকগুলো কোথা থেকে আসলো? এরা কিন্তু কাশিপুরের লোক না, ট্রাকে করে তারা অনেক দূর থেকে এসেছে। তারা এসে ওয়াজের নামে কিছু কথাবার্তা বলল, তারপর মঞ্চ থেকে নামার আগে ফয়জুল করিম ঠিকই হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে একটি উস্কানি মূলক কথা বলে গেলেন। এতে প্রমাণিত হয় তাদের উদ্দেশ্য খারাপ ছিল। সেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল, গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল এবং স্থানীয় জননেতাদের বাধ ছিল বিধায় তারা সুবিধা করতে পারেনি। আমরা নিশ্চত ছিলাম সেদিন তারা ওয়াজের আড়ালে তাণ্ডব সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করেছে। বক্তব্যের শেষে ফয়জুল করিম বলেছেন যে সকল আলেম একমত হেযবুত তওহীদ কাফের। এভাবে উস্কানিমূলক বক্তব্য, মিথ্যাচার তারা করতে পারে না। তাদের কাউকে কাফের বলার অধিকার নেই। কাফেরের সংজ্ঞা আল্লাহ কোর’আনে দিয়েছেন। কাফের হচ্ছে যারা আল্লাহর হুকুমকে প্রত্যাখ্যান করে। আমরা আল্লাহ হুকুম প্রত্যাখ্যান করি নাই, আমরা আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করছি।
দেশেরপত্র: আপনাদের কি ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ এর সাংগঠনিক উচ্চপর্যায়ে পর্যায়ে যোগাযোগ করার কোনো পরিকল্পনা আছে?
হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম: আমাদের বক্তব্য পুরো মানবজাতির জন্য। বিশেষভাবে চরমোনাইয়ের সাথে আমাদের যোগাযোগ করার প্রয়োজন নেই। আমাদের বক্তব্য তাবলীগ, জামায়াতে ইসলামী, হাটহাজারী, মাইজভান্ডারী, দেওয়ানবাগী সবার উদ্দেশ্যে। নাস্তিক, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নির্বিশেষে সকলের প্রতিই আমাদের আহ্বান। পরিস্থিতির আলোকেও তাদের সাথে আমরা যোগাযোগ করার প্রয়োজন মনে করি না। কারণ এদের সাথে যোগাযোগ করে কোনো লাভ নেই। কারণ এরা কোনো আইন মানে না, সামনে কিছু ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠী পেলেই এদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। আসলে এদের কোনো ইথিকস নেই, নীতি নেই। এরা যখন যেদিকে বৃষ্টি নামে সেদিকে ছাতা ধরে। কাজেই এদের সাথে যোগাযোগ করে ফলপ্রসূ কিছু হবে বলে আমি মনে করি না। যদি রাষ্ট্র না থাকত, কোনো হস্তক্ষেপকারী কর্তৃপক্ষ না থাকত তাহলে আমরা যোগাযোগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতাম। কারণ সাধারণ জনগণের প্রাণহানি হবে। কিন্তু এখন তো মাঝখানে সার্বভৌম রাষ্ট্র আছে, প্রশাসন আছে। আমরা যোগাযোগ করব রাষ্ট্রের সাথে। ওদের সাথে যোগাযোগ করলে সরকার করুক, রাষ্ট্র করুক। আমরা কেন করব! আমাদের বক্তব্য তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য তো কর্তৃপক্ষ আছে।
দেশেরপত্র: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বলছেন যে চরমোনাই ভালো হোক অথবা খারাপ হোক, তারা একটি বাতিল ফেরকার প্রোগ্রামে বাধা দিয়ে অনেক ভালো কাজ করেছে। তারা হেযবুত তওহীদের কর্মীসভা বানচাল করার ঘটনাকে আপনাদের পরাজয় ও তাদের বিজয় হিসেবে দেখছে। পরবর্তীতেও যদি চরমোনাই হেযবুত তওহীদের প্রোগ্রামে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, তখন আপনাদের করণীয় কী হবে?
হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম: এটা তো তাদের একটি আত্মতৃপ্তি। দেখেন, ডাকাত ডাকাতি করেও কিন্তু এক ধরনের আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। ডাকাতের সেই আত্মতৃপ্তির কোনো মূল্য আছেকি? হলের ভিতরে একটি কর্মীসম্মেলন হওয়ার প্রস্তুতি আমাদের প্রায় সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল, সেখানে আমরা বাধার মুখে পড়েছি। বাধা কিন্তু চরমোনাই আমাদেরকে দেয় নি। তারা বাধা দিলেও আমরা কর্মীসভা স্থগিত করতাম না, সেখানে যাই ঘটুক না কেন। কিন্তু রাষ্ট্র যখন আমাদেরকে বলেছে যে আপনারা ওখানে যাবেন না, এমনকি আমাদের নেতৃবৃন্দ যখন প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠছিলেন তখন কমিশনার এ কথা পর্যন্ত বলেছেন যে আপনারা কি আমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করতে চাচ্ছেন! তখনই আমরা বলেছি, আপনারা তো রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তি। রাষ্ট্রের সাথে আমরা তো কোনো দ্বন্দ্বে যাব না। সেই পরিস্থিতিকে আমরা কর্মীসভা স্থগিত না করলে, রাষ্ট্রের সাথে আমাদের একটি দ্বন্দ্ব হয়ে যেত। এখানে কিন্তু চরমোনাই কোনো ফ্যাক্টর না। আর এই বিষয়টি তাদের বোঝার মত ঘিলু আছে বলে আমার মনে হয় না। প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর নোংরা রাজনীতি আমি কিন্তু আগেও দেখেছি। সাঈদী যখন তফসির মাহফিল করত, হঠাৎ করে তার মাহফিলের আগের দিন কিছু দল ঐ একই জায়গায় সমাবেশ ডাকত। দেখা যেত জামাত-শিবিরের লোকেরা তিন/চার দিন আগে এসেই মাঠ দখল করত। আর ডিসি ১৪৪ ধারা জারি করে দিত। শহরের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে যেত, সাত-আটদিন অনেক লোক দোকান খুলত না। এমনকি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে সাঈদীর মাহফিলকে কেন্দ্র করে একবার বিরাট সংঘর্ষ হয়েছিল এবং মানুষ নিহত হয়েছিল। সুতরাং, এই ধরনের নোংরা রাজনীতি এরা আগে থেকেই করে। তাই, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই যে হেযবুত তওহীদ হেরে গেছে, চরমোনাই জয়ী হয়েছে।
তাছাড়া আমরা পরবর্তীতে সমাবেশ করেছি, বিক্ষোভ মিছিল করেছি, টাউনহল ময়দানে আমাদের মানববন্ধন হয়েছে। তাই আমি তো মনে করি আমাদের আরও লাভ হয়েছে। আমরা যেটা হলের চার দেয়ালের মধ্যে করতাম, জনগণ জানত না, এখন সেটা বাহিরে বরিশালের হাজার হাজার মানুষ দেখছে। যে ঘটনাটা সাংবাদিকরা এভাবে কাভার দিত না, দেখা যাচ্ছে এখন পুরো গণমাধ্যমে ব্যাপারটা এসেছে। বরিশালের সাধারণ মানুষ ও প্রশাসন দেখতে ও বুঝতে পেরেছে যে আসলে কারা মানুষের অধিকার স্বীকার করে না, কারা মানবাধিকারের বিষয়টা খেয়াল করে না। কারা আসলে উগ্রবাদী, কারা সন্ত্রাসী, কারা অন্যদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে এই বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়েছে।
সুতরাং, যারা বলে যে তারা বাধা দিয়ে ঠিক কাজ করেছে, তাদের বোঝা উচিত যে চরমোনাই একইভাবে নারায়ণগঞ্জে আব্বাসি পীরের সুন্নী সম্মেলনে বাধা দিয়েছিল, তারা সংঘাত করেছিল দেওয়ানবাগী পীরের মুরিদদের বিরুদ্ধে এবং সেখানে মানুষ মারাও গিয়েছে। বরিশালে আটরশি সম্মেলন করতে গিয়ে একইভাবে চরমোনাইয়ের হামলার শিকার হয়েছে। অর্থাৎ মানুষের বৈধ অধিকারে হস্তক্ষেপ করাই চরমোনাইয়ের চরিত্র। এর ফলাফল হতে পারে, একদিন চরমোনাই এমনভাবে রাস্তায় আর্তনাদ করবে, তাদের আর্তনাদ আর কেউ শুনবে না। কেননা এ পর্যন্ত তাদের ট্র্যাকরেকর্ড, তাদের ৫০ বছরের সমস্ত অন্যায় যখন জমা হবে, মানুষ যখন সেসব অন্যায় সম্পর্কে জানবে তখন সমস্ত মানুষ তাদের বয়কট করবে, তাদের আর কেউ সমর্থন দিবে না। তখন এই চরমোনাইয়ের আর্তনাদ সৃষ্টির কেউ শুনবে না। তাদের সেই নিদানের কাল পর্যন্ত আমরা সবাই ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে যাব।
আমি দেখলাম, বরিশালে গণ্ডগোল সৃষ্টি করতে চরমোনাইয়ের নেতারা যেসব লোকজনকে এনেছে তাদের পায়ে ২০ টাকার স্যান্ডেল, আমি তাদের অবজ্ঞা করছি না, বোঝানোর স্বার্থে বলছি। বোঝা যাচ্ছে যে, তারা সাধারণ মানুষ, তারা বিভিন্ন এতিমখানা থেকে এসেছে, মাদ্রাসা থেকে এসছে অথবা এলাকার কিছু মুরুব্বি লোক। তাই, আমরা যদি সেখানে সংঘাত করতাম তাহলে আদতে সাধারণ মানুষ বেঘোরে মারা পড়ত, ক্ষতিগ্রস্ত হত। আর এধরনের বেআইনি কাজ হেযবুত তওহীদ করতে পারে না, এটাই আমাদের নীতি, আদর্শ। জামায়াতে ইসলামীর অনেক মিটিং চরমোনাইয়ের বাধার মুখে পণ্ড হয়ে গিয়েছে। চরমোনাই দক্ষিণ এলাকায়, ভোলায়, বরিশালে বিভিন্ন জায়গায় গুজব রটনা করে দিয়ে হিন্দুদের ওপরে, অন্যান্য মানুষের ওপরে, ভিন্ন মতবাদের ওপরে তারা বহু হামলা করেছে, দাঙ্গা সৃষ্টি করেছে। এখন আগামীর দিনগুলো চরমোনাইয়ের আর্তনাদ শোনার অপেক্ষায় আছে।
দেশেরপত্র: পরবর্তীতে অন্য কোনো জেলাতেও চরমোনাই হেযবুত তওহীদের প্রোগ্রামে বাধা দিলে আপনারা কি সেটা মেনে নিবেন বা তখন আপনাদের পদক্ষেপ কী হবে?
হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম: এটা আসলে মানা বা না মানার বিষয় না। আসল ব্যাপার হচ্ছে আমাদের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে, সেখানে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব যেন সংঘাত না হয়, আমাদের অধিকার যেন বলবৎ থাকে। আমরা প্রশাসনকে বলব, মিডিয়াকে জানাব, দেশে সুশীল সমাজ আছে, জনপ্রতিনিধিদের অবগত করব। সেখানে আমাদের একটু ক্ষতি হলেও চেষ্টা করব কোনো সংঘর্ষ যেন না হয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে পিছু হটা কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের একটি স্ট্র্যাটেজি। এটা করা হয় সৈন্যদের পুনঃবিন্যাস করার জন্য। সেনাপতি পশ্চাৎপসরণ না করতে পারলে কোনোদিন যুদ্ধ করা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারও বহুবার সৈন্য পুনঃবিন্যাস করেছে। রসুলের (সা.) অনেক সাহাবি, এমনকি রসুল (সা.) নিজেও এই নীতি অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ এটা যুদ্ধের একটি অংশ। সুতরাং, পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরাও এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারি, সম্মেলন স্থগিত করতে পারি। কিন্তু এতে যারা ভাববে যে আমরা হেরে গেছি, তারা জিতে গিয়েছে তারা আসলে আহাম্মকের রাজ্যে বাস করে। এজন্যই আল্লাহ কোর’আনে বলেছেন, ‘কাজেই তারা কিঞ্চিৎ হেসে নিক, তারা প্রচুর কাঁদবে, তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ (সুরা আত তওবা, ৮২)।
দেশেরপত্র: ২০২০ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারি উত্তরায় রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, এই অনুষ্ঠানে তখন বাধা দিয়েছিল মামুনুল হকের অনুসারীরা। তখন আপনারা অনেক টাকার ক্ষতি স্বীকার করে সম্মেলন স্থগিত করেছিলেন। এখন বরিশালেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। তাহলে এই তিন বছরে হেযবুত তওহীদ কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম: পৃথিবীর ইতিহাসে যত লড়াই হয়েছে সবচাইতে দীর্ঘমেয়াদী, সবচাইতে ভয়ংকর, সবচাইতে বিপদসংকুল লড়াই হচ্ছে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই। ইউরোপে প্রায় ৩০০ বছর ধরে এই লড়াই হয়েছে। তারা এর নাম দিয়েছে রেঁনেসা। আরব্য ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে রসুলকেও (সা.) যুদ্ধ করতে হয়েছে। তৎকালে মক্কায় হজ করার অধিকার সকল গোত্রের ছিল, এটা ছিল তাদের মানবাধিকার এবং সেখানে রক্তারক্তি ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু রসুল (সা.) যখন চৌদ্দশ সাহাবি নিয়ে রওনা দিলেন তখন আবু লাহাব, আবু সুফিয়ান বাধা দিয়েছিল। আজকেও সেই আবু সুফিয়ানদের ভূমিকায় আছে মামুনুল হক, ফয়জুল করিম। আবু সুফিয়ানরা অনধিকার চর্চা করে তখন বলেছিল, রসুলকে (সা.) মক্কায় ঢুকতে দেওয়া যাবে না। রসুল (সা.) কিন্তু সেখানে থেমে গিয়েছিলেন, কারণ তাঁরা তখন যুদ্ধ করতে যান নি। সেখানে সবাই শপথ নিয়েছিলেন আমরণ সংগ্রাম করার, এই শপথকেই বলা হয় বায়াতে শাজারা। ঐ প্রতিবন্ধকতা কিন্তু সুস্পষ্ট বিজয় নিয়ে এসেছে এবং বিজয়ের সুরাও নাজিল হয়েছিল, সুরা ফাতাহ। উত্তরায় সম্মেলন স্থগিত করার পরে হেযবুত তওহীদের সদস্যরাও কিন্তু একটি মারাত্মক শপথ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
এজন্য পৃথিবীর সকল আর্মি আর্টিফিশিয়াল ট্রেনিং দিয়ে টর্চার করে, নির্যাতন করে, ড্রামের ভিতরে ভরে, কাদা পানিতে নামায়, বরফের মধ্যে ডুবায়। এর কারণ হল মানুষকে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য তার হৃদয়কে নির্মম করে তুলতে হয়। এটা একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা তাঁর দীনেও মো’মেনদের জন্য এমন প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছেন। মো’মেনরা এভাবে প্রতিপক্ষের কাফেরদের, ধর্মব্যবসায়ীদের মোকাবেলা করতে করতে, তাদের ভেতরে একটি প্রচণ্ড রকমের প্রতিশোধপরায়ণতা জন্ম নিবে, এটা হল যুদ্ধ বিজয়ের অনিবার্য শর্ত। আপনার প্রিয়জন বা আপনার ফ্যামিলির ওপর যদি কেউ আঘাত করে তাকে আপনি ছাড় দিবেন না। ঠিক তেমনিভাবে আপনার অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করলে তাকেও আপনি ছাড় দিবেন না। আজকে মানুষের অধিকার হারিয়ে গেছে, এটা একটি তাত্ত্বিক কথা। এই তাত্ত্বিক কথা কিন্তু কারও গায়ে লাগে না। কিন্তু যখন আপনার কোনো ন্যায়সঙ্গত অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হবে, আপনার টাকা ও শ্রমে আয়োজিত সম্মেলনে বাধা দেওয়া হবে, অথবা আপনারা বাড়িঘর পোড়ানো হবে, আপনার ভাইকে হত্যা করা হবে তখন আপনার মধ্যে একটি প্রতিবাদ জন্মাবে।
ফলে সম্মেলনে বাধা দেওয়ার ফলে আমাদের বৈষয়িক কিছু ক্ষতি হয়। কিন্তু আমাদের আত্মিক উন্নতির কথা যদি বলি, সেটার কিন্তু অসম্ভব রকমের উন্নতি হয়েছে। সেই ঘটনার পর আমাদের অনেকগুলো নতুন শাখা হয়ে গেছে। এখান থেকে শপথ নিয়ে নতুনভাবে আমরা স্ট্রাটেজি সাজিয়েছি। এদেরকে কীভাবে মোকাবেলা করা যায় সেটার দারুণ একটি বার্তা আমরা পেয়েছি। আমাদের জানা ছিল না যে এদের ভেতরের চরিত্র কেমন। এটা আমাদের এখন জানা হয়েছে। কাজেই ওই প্রতিবন্ধকতার পরে আমরা অনেক দূরে এগিয়েছি। এভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হবে, আমরা জানি। বরিশালে আমরা দেখেছি আমাদের হাজার হাজার নিষ্ক্রিয় সদস্যরা পর্যন্ত লাঠি সোটা নিয়ে তখন চলে এসেছিল চরমোনাইয়ের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে, তাদের সম্ভাব্য হামলার হাত থেকে আমাদের অফিসকে রক্ষা করতে। এসবের ভেতর দিয়েও আলহামদুলিল্লাহ হেযবুত তওহীদ প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলেছে। এরপর থেকে আমাদের বক্তব্য আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে, আগে কিন্তু এত বেশি মানুষ আমাদের বক্তব্য ফেসবুকে দেখত না। মনোযোগ ছিল না মানুষের।
দেশেরপত্র: বিক্ষোভ মিছিলে বরিশালে মানুষের ওপর কী প্রভাব পড়ছে?
হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম: তাদের ওপর কী প্রভাব পড়েছে তা বলতে পারছি না। কিন্তু সাধারণ মানুষ, প্রশাসন, মিডিয়া ও বরিশালের মানুষ একটি মেসেজ তো পেয়েছেন যে বরিশালে মাটি চরমোনাইয়ের জন্য নয়। বরিশালের মাটি বরিশালের সাধারণ মানুষের জন্য, শান্তিপ্রিয় মানুষের জন্য। সন্ত্রাসী, উগ্রবাদী, চোর, ডাকাতের জন্য না বরিশালের মাটি না, তাদের জন্য উপযুক্ত জায়গা হচ্ছে জেলখানা।