পথ মানুষকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যায়। এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় না। আজকে ক্ষমতার মোহে পড়ে, ক্ষমতার চর্চা করতে গিয়ে সেক্যুলার দলগুলো যে সব দুষ্কর্ম করছে সেই দুষ্কর্মগুলোতে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোও লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছে। কারণ প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে এছাড়া উপায় নেই। কিন্তু এদেরকে এই দুষ্কর্মগুলো করতে হচ্ছে ইসলামের নাম দিয়ে, হেকমতের দোহাই দিয়ে। বিষয়টি একটু পরিষ্কার করছি। প্রকৃত ইসলাম তেরশ’ বছর আগে হারিয়ে গেছে। আজ ‘মুসলিম’ অমুসলিম সব জাতিগুলোই পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, আইন-কানুন, দর্শনের প্রভাবাধীন। ইহুদি খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’র প্রচণ্ড প্রভাব সমস্ত পৃথিবীকে এমন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে যে, পৃথিবীর সমস্ত জাতিগুলি ব্যক্তিজীবনে যাই বিশ্বাস করুক সমষ্টিগত জীবনে অন্ধভাবে ঐ সভ্যতার নকল করছে। শুধুমাত্র মুসলিম জাতির মধ্যে কতকগুলি সংগঠন ছাড়া অন্য কোনো জাতি ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার সমষ্টি জীবনের ব্যবস্থা অর্থাৎ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইন-কানুন ইত্যাদি প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে না।
এই মুসলিম জাতির ভেতর যে সংগঠনগুলো সে চেষ্টা করছে সেগুলোর কোনো কোনোটির অনুসারী কোটির উপরে, আবার কোনো কোনোটি খুবই ছোট। কিন্তু ছোট বড় কোনোটাই ঐ ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার জীবন-দর্শনের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সাম্যবাদ, অর্থাৎ কমিউনিজম যখন মহাপরাক্রমশালী, তখন ইসলামকে প্রতিষ্ঠার জন্য যে সব প্রচেষ্টা করা হয়েছিল তাতে সাম্যবাদও সমাজতন্ত্রের সাথে ইসলামের সাদৃশ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করা হতো। ঐ প্রচেষ্টায় কোর’আনের বিশেষ বিশেষ আয়াতগুলিকে প্রধান্য দেয়া হতো, যেগুলোতে আল্লাহ নিজেকে আসমান-জমীনের সব কিছুর মালিক বলে ঘোষণা করছেন। উদ্দেশ্য-সব কিছুর মালিকানা যখন আল্লাহর তখন সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের মতো ইসলামেও ব্যক্তি মালিকানা নেই। বিশ্বনবীর (দ.) লক্ষ সাহাবাদের মধ্য থেকে বেছে নেয়া হলো আবু যরকে (রা.) একমাত্র আদর্শ বলে, কারণ, তার ব্যক্তিগত মতামতের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের দর্শনের কিছুটা মিল ছিল। সমাজতন্ত্রের সাথে ইসলামের এত যখন মিল তখন সৃষ্টি করা হলো ইসলামিক সমাজতন্ত্র। প্রায় তিনটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেই এই ইসলামিক সমাজতন্ত্রের সংগঠন হয়েছিল এবং পাকিস্তানের যুলফিকার আলী ভুট্টোর ইসলামিক সমাজতান্ত্রিক (পি.পি.পি) দলসহ কয়েকটি দেশে কিছু দিনের জন্য সরকারও গঠন করেছিল।
তারপর সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার কারণে যখন সেগুলো ম্লান হয়ে গেল তখন ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্র জোরদার হয়ে উঠেছে। এখন চেষ্টা চলছে প্রমাণ করতে যে ইসলাম গণতান্ত্রিক, নাম দেয়া হচ্ছে ইসলামিক গণতন্ত্র। সেই আগের মতই কোর’আন থেকে বেছে বেছে আয়াত নেয়া হচ্ছে। ইহুদি-খ্রিষ্টান পদ্ধতির সঙ্গে আপসকে অর্থাৎ শেরক ও কুফরের সঙ্গে আপসকে যথার্থ প্রমাণের চেষ্টায় মহানবীর (দ.) মদিনায় ইহুদি ও মোশরেকদের সঙ্গে চুক্তির ঘটনা উপস্থিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে প্রয়োজনে আল্লাহর রসুলও (দ.) মদিনার ইহুদি ও মোশরেকদের সঙ্গে আপস করেছিলেন। এর নাম এরা দিয়েছেন হেকমত। যে পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সার্বভৌমত্ব আল্লাহ নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের, সেই ব্যবস্থাকে স্বীকার করে নিয়ে সেই পদ্ধতিতে রাজনীতি করে এবং সেই পদ্ধতির নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজেদের কাজকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টায় এরা এমন অন্ধ হয়েছেন যে, আপস ও চুক্তির মধ্যে বিরাট তফাৎ দেখতে পান না। আকিদা বিকৃতির জন্য ইসলামের প্রকৃত রূপ, অগ্রাধিকার এ সব এরা বোঝেন না বলে বিশ্বনবীর (দ.) ইহুদি ও মোশরেকদের সঙ্গে চুক্তিকে তাদের নিজেদের শেরক ও কুফরের সাথে আপসের সঙ্গে একই পর্যায়ে ফেলেছেন। আপস হলো কিছু দেয়া কিছু নেয়া, বিরুদ্ধ পক্ষের কিছু দাবি মেনে নেয়া ও নিজেদের কিছু দাবি বিরুদ্ধ পক্ষকে মেনে নেয়ানো। মদিনার চুক্তিতে বিশ্বনবী (দ.) বিরুদ্ধ পক্ষের অর্থাৎ ইহুদি ও মোশরেকদের পদ্ধতির (ঝুংঃবস) একটি ক্ষুদ্রতম কিছুও মেনে নেন নি, ইসলামের জীবন-ব্যবস্থার, দীনের সামান্য কিছুও তাদের উপর চাপান নি। কারণ তিনি আপস করছিলেন না। তিনি মদিনা রক্ষার জন্য শুধু একটি নিরাপত্তা চুক্তি (Security Treaty) করছিলেন। সম্পূর্ণ চুক্তিটির উদ্ধৃতি এখানে দিতে গেলে বই বড় হয়ে যাবে, শুধু প্রধান প্রধান শর্তগুলো পেশ করছি –
(ক) মদিনা শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে ইহুদি ও মোশরেকরা মুসলিমদের সঙ্গে একত্র হয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।
(খ) যুদ্ধে ইহুদি ও মোশরেকরা তাদের নিজেদের খরচ বহন করবে, মুসলিমরা নিজেদের খরচ বহন করবে, যত দিনই যুদ্ধ চলুক।
(গ) ইহুদি ও তাদের সমগোত্রের লোকজন রসুলাল্লাহর (দ.) অনুমতি ছাড়া কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে না।
(ঘ) এই চুক্তির অধীন সমস্ত গোত্রগুলির মধ্যে যে কোন প্রকার বিরোধ বা গণ্ডগোল যাই হোক না কেন সমস্ত বিচার মহানবীর (দ.) কাছে হতে হবে।
এই কয়টিই হলো মহানবীর (দ.) ও মদিনার ইহুদি-মোশরেকদের মধ্যে চুক্তির প্রধান প্রধান (ঝধষরবহঃ) বিষয়, যে চুক্তিটাকে মদিনার সনদ বলা হয়। চুক্তির ঐ প্রধান প্রধান বিষয়গুলির দিকে মাত্র একবার নজর দিলেই এ কথায় কারো দ্বিমত থাকতে পারে না যে, বিন্দুমাত্র ত্যাগ স্বীকার না করেও মহানবী (দ.) এমন একটি চুক্তিতে ইহুদি ও মোশরেকদের আবদ্ধ করলেন- যে চুক্তির ফলে তিনি কার্যত (De Facto) মদিনার ইহুদি ও মোশরেকদের নেতায় পরিণত হলেন। তাদের নিজেদের যুদ্ধের খরচ নিজেরা বহন করে মহানবীর (দ.) অধীনে মুসলিমদের সঙ্গে একত্র হয়ে যুদ্ধ করার, মহানবীর (দ.) বিনা অনুমতিতে কারো সঙ্গে যুদ্ধ না করার ও নিজেদের মধ্যেকার সমস্ত রকম বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারের ভার মহানবীর (দ.) হাতে ন্যস্ত করার শর্ত্তে আবদ্ধ করে তিনি যে চুক্তি করলেন তা নিঃসন্দেহে একাধারে একটি রাজনৈতিক, কুটনৈতিক ও সামরিক বিজয়। মদিনা রক্ষার ব্যবস্থা তো হলোই, তার উপর তিনি কার্যত মুসলিম-অমুসলিম সকলের নেতায় পরিণত হলেন। যারা ‘হেকমতের’ দোহাই দিয়ে রসুলাল্লাহ ও আসহাবগণের করে যাওয়া সর্বাত্মক সংগ্রামের পথ ‘জেহাদ’ ত্যাগ করে পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক পদ্ধতি গ্রহণ করে মিটিং, মিছিল, শ্লোগান দিয়ে, মানুষের সার্বভৌমত্বের সংগঠনের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন, কিন্তু বিনিময়ে অপর পক্ষ থেকে বিন্দুমাত্র প্রতিদান বা ত্যাগস্বীকার পান নি, তারা কেমন করে তাদের ঐ শেরক ও কুফরের কাজকে বিশ্বনবীর (দ.) ঐ মহা বিজয়ের সঙ্গে একই পর্যায়ে ফেলে তাকে ছোট করেন তা বোঝা সত্যিই মুশকিল।
রাজনৈতিক ইসলামের নেতৃবৃন্দের হেকমতের কোনো শেষ নেই। তারা মাঠে ময়দানে যাদের বিরুদ্ধে গলা ফাটান, ইসলমাবিরোধী, তাগুতশক্তি ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে থাকেন, ভিতরে ভিতরে সেই প্রতিপক্ষের নেতৃবৃন্দের সাথে গভীর আত্মীয়তা ও ব্যবসায়িক সম্পর্কও তৈরি করেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, যেন ক্ষমতার পালাবদলে তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন না হয়। বিশেষ বেকায়দায় পড়লে প্রতিপক্ষের দলে যোগদান করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। প্রয়োজনে দলে নামও পাল্টে ফেলেন, আদর্শের মধ্যেও রদবদল করেন। এহেন ধাপ্পাবাজির রাজনীতিকে ‘ইসলাম’ বলে চালিয়ে দেওয়া আল্লাহ ও রসুলের উপর ন্যাক্কারজনক অপবাদ আরোপ ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব কর্ম অন্যদের বেলায় খাটে, কিন্তু ইসলামের বেলায় খাটে না। এবং আল্লাহ বলেন, তার চেয়ে বড় জালেম কে যে আল্লাহর উপর অপবাদ আরোপ করে (সুরা ইউনুস ১৭)? তারা আজ যেটাকে ‘পাক্কা হারাম’ বলছেন কাল সেটাকেই রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ‘হালাল’ বানিয়ে ফেলেন। আজকে তারা যাকে ‘যুগের ফেরাউন’ বলেন, কালই তার সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন বা নির্বাচন করেন। তাদের দলে অনেক জনপ্রিয় খ্যাতিমান মোফাসসিরে কোর’আন, মুহাদ্দিস, মুফতি ও ইসলামী বিশেষজ্ঞ থাকেন যারা দলের প্রয়োজনমাফিক শরিয়তের নবতর ব্যাখ্যা হাজির করতে খুব পারদর্শী। তাদের ব্যাখ্যা জনগণ কতটুকু গ্রহণ করে জানি না, তবে দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা সেগুলোকেই ‘ইসলাম’ বলে অন্ধভাবে মেনে নেন।