‘বিশ্বনবী একদিন সাহাবাদের সামনে একটি সোজা লাইন টানলেন (বোধহয় মাটির উপর), তারপর বললেন, এই হচ্ছে সহজ সরল পথ, সেরাতুল মোস্তাকীম। তারপর সেই সরলরেখা থেকে ডান দিকে কতকগুলি ও বাম দিকে কতকগুলি রেখা টেনে বললেন এইগুলি সেই সব পথ যেগুলির দিকে শয়তান তোমাদের ডাকতে থাকবে। এই বলে তিনি কোর’আন থেকে সেই আয়াত পড়লেন যেটায় আল্লাহ বলছেন- নিশ্চয়ই এই হচ্ছে আমার সহজ সরল পথ। কাজেই এই পথে চল এবং থাক। অন্য কোন পথে (মহানবী (দ.) ডাইনে বায়ে যে লাইনগুলি টানলেন সেগুলি) যেও না, গেলে তোমরা আমার পথ থেকে বিচ্যুত, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তিনি (আল্লাহ) তোমাদের আদেশ করছেন যাতে তোমরা অন্যায় থেকে বেঁচে ন্যায়ে থাকতে পারো।’ (হাদীস- আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ (রা.) থেকে, আহমদ, নিসায়ী- মেশকাত)
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, সেই সহজ-সরল পথে আমরা খুব বেশিদিন থাকতে পারি নি। দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি ও তার ফলে অনৈক্য করতে করতে এই জাতি সত্যের মহাসড়ক থেকে বহু আগেই বিচ্যুত হয়ে মিথ্যার অন্ধকার অলি-গলিতে ঢুকে পড়েছে, শয়তান বহু শতাব্দী আগেই আমাদেরকে সেরাতুল মোস্তাকীম ভুলিয়ে দিয়ে ডাইনে-বাঁয়ের লাইনগুলোতে ছিটকে দিয়েছে।
কিন্তু সেরাতুল মোস্তাকীম হারিয়ে বিভিন্ন ফেরকা, মাহজাব, তরিকা ইত্যাদির কানাগলিতে ঢুকে পড়েও এই জাতির প্রত্যেকেই ভাবছে একমাত্র তারাই সঠিক পথে আছে, অন্যরা পথভ্রষ্ট। আজ একজন ইহুদিকে মুসলিম বানানো বা মুসলিমকে খৃষ্টান বানানো যতটা কষ্টসাধ্য, একজন শিয়াকে সুন্নি বানানো, সুন্নিকে শিয়া বানানো তার চেয়েও বেশি কষ্টসাধ্য। সুতরাং ইসলামের নামে তৈরি হওয়া সমস্ত ফেরকা-মাজহাব-তরিকার মানুষ কোনো একদিন নির্দিষ্ট কোনো ফেরকায় প্রবেশ করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে, সবাই সুন্নি হয়ে যাবে অথবা সবাই শিয়া হয়ে যাবে, সবাই হানাফি হয়ে যাবে বা সবাই হাম্বলি হয়ে যাবে, সবাই এক পীরের মুরিদ হয়ে যাবে বা সবাই এক দলের অনুসারী হয়ে যাবে- এমন আশার পালে কস্মিনকালেও যে হাওয়া লাগবে না তাতে সন্দেহ নেই।
যেটা সম্ভব হতে পারে তা হচ্ছে- একটি সাধারণ বক্তব্যের ভিত্তিতে সবাইকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসা, কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ব্যক্তিগত আচার-প্রথা, ব্যক্তিগত মতবাদের দিকে না তাকিয়ে জাতীয় স্বার্থের কথা ভেবে সবাইকে একটি কথার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা। আর তেমন সর্বজনগ্রাহ্য ঐক্যসূত্র একটিই আছে, সেটা এই দ্বীনের মূলমন্ত্র, ভিত্তি- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আমরা আল্লাহর হুকুম ছাড়া অন্য কারো হুকুম মানি না। এই ঐক্যসূত্র দিয়ে আল্লাহর রসুল আরবের দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত আইয়্যামে জাহেলিয়াতের মানুষগুলোকে যখন শত্রুতা ভুলিয়ে একে অপরের ভাই বানাতে পেরেছিলেন তখন আমরাও এই আশায় বুক বাঁধতে পারি যে, বর্তমানের অনৈক্য-সংঘাতে জর্জরিত মানুষগুলোও তওহীদের এই বৈপ্লবিক ঘোষণার মধ্য দিয়েই হারিয়ে ফেলা সেরাতুল মোস্তাকীমে ফিরে আসতে সক্ষম হবে ইনশা’আল্লাহ।
আল্লাহ কোর’আনে বলেন, তিনি কোনো মন্দকাজের হুকুম দেন না (আরাফ: ২৮)। কাজেই আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবার অর্থ যাবতীয় ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানি ভুলে যাওয়া এবং সাক্ষ্য দেওয়া যে, আমরা ব্যক্তিজীবনে কে কোন ফেরকায় থাকব, কে কোন মাজহাব মানব, কে তারাবির নামাজ বারো রাকাত পড়ব আর কে বিশ রাকাত পড়ব, কে আল্লাহকে সাকার বিশ্বাস করব আর কে নিরাকার বিশ্বাস করব, কে রসুলকে নুরের তৈরি বিশ্বাস করব আর কে মাটির তৈরি বিশ্বাস করব, কে দোয়াল্লিন পড়ব আর কে যোয়াল্লিন পড়ব, কে কওমীতে পড়ব কে আলীয়াতে পড়ব- এই সব বিষয়কে ব্যক্তিজীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখে সমষ্টিগত জীবনে আমরা সবাই মিলে ঘোষণা দিলাম যে, আমরা থাকব যাবতীয় ন্যায়ের পক্ষে ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। অন্যায় যদি আমার নিজের লোকও করে আমি তার বিরুদ্ধে দাঁড়াব, ভিন্নমতের মানুষও যদি ন্যায়ের পক্ষে থাকে আমি তার পক্ষে দাঁড়াব।
আজ মুসলিম পরিচয় দানকারী জাতিটিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য পৃথিবীময় যে মহাযজ্ঞ আরম্ভ হয়েছে, তা থেকে রক্ষা পেতে প্রত্যেকটি মুসলিমপ্রধান দেশের সরকার ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কেউ আমেরিকার দারস্থ হচ্ছে, কেউ রাশিয়ার দারস্থ হচ্ছে, দুর্বল দেশগুলো অধিকতর শক্তিশালী দেশের ছত্রছায়া লাভ করতে পারলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। কিন্তু তাদেরকে কে বলে দেবে যে, ‘‘তোমাদের এই সুরক্ষাদাতারাই একদিন তোমাদেরকে ধ্বংস করবে, যেভাবে তারা ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, আরাকান, ফিলিস্তিন ধ্বংস করেছে। তোমাদের সাহায্যকারী অভিভাবক আমেরিকাও না, রাশিয়াও না, সৌদি আরবও না, ইরানও না। একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামিন এবং তিনিই যথেষ্ট। কিন্তু আল্লাহ তো কোনো বিচ্ছিন্ন, খণ্ড-বিখণ্ড, নিজেদের মধ্যে হানাহানি-মারামারিতে লিপ্ত জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করেন না। আল্লাহ কেবল তাদেরকেই সাহায্য করেন যারা আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ করে এবং পর¯পর বিচ্ছিন্ন হয় না (ইমরান ১০৩)।’’ আল্লাহর সাহায্য পেতে হলে আমাদেরকেও তেমন হতে হবে।
এটা ঠিক যে, আমাদের মধ্যে আকীদাগত, ফেরকাগত হাজারো মতভেদ আছে। কিন্তু আমরা এক আল্লাহ, এক রসুল, এক কেতাবের অনুসারী তো? যেখানে আল্লাহ ও রসুল অসংখ্যবার বলেছেন, আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা হিসেবে গ্রহণ করে নিলে চুরি ও ব্যাভিচারের মত মহাঅপরাধও মানুষকে জান্নাত থেকে ফেরাতে পারবে না সেখানে দীনের মাসলা-মাসায়েল, খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে মতভেদ করতে থাকা এবং সেই মতভেদের কারণে ঐক্যবদ্ধ না হতে পেরে পুরো জাতিই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার হয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কতটা বোকামী?