মানব ইতিহাসের গত ১৪০০ বছরের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো অধিকার করে রয়েছে মুসলিমরা। আর মুসলিমদের ইতিহাসে যে জিনিসটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে তাহলো তাদের সংগ্রামী জীবন। সমস্ত পৃথিবী থেকে অন্যায়-অবিচার নির্মূল করে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই হলো তাদের জাতীয় কাজ। তাদের এই সংগ্রামী ইতিহাস সর্বজনস্বীকৃত। মুসলিমদের কোনো কিছুই যারা ভালো দেখেন না সেই তারাও ঐ ইতিহাসকে অস্বীকার করতে পারেন নি। শুধু তাই নয়, শত্রুতার বশবর্তী হয়ে তারা মুসলিমদের দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং মানুষের দলে দলে ইসলামে প্রবেশের ইতিহাসকে ‘তলোয়ারের জোরে ইসলাম প্রচার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এখানে মনে রাখতে হবে, পরাশক্তি হিসেবে মুসলিমদের উত্থানকে কোনভাবেই যখন অস্বীকার করা যায় নি তখনই কেবল তারা ঐ অপরাজেয় শক্তিকে কলুষিত করার চেষ্টায় এই মতামত দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই মুসলিম নামধারী জাতির, যারা এই তাদের সংগ্রামী জীবনকে ইতিহাসে যেন দেখতেই পান না। ইতিহাসের ঝড় তোলা মুসলিম জাতির সামরিক চরিত্রকে তারা ধামাচাপা দিয়ে সুফি বলে প্রচার করছেন। যে কাজ করার কথা ছিল অমুসলিমদের সেই কাজ অর্থাৎ মুসলিমদের সংগ্রামী জীবনকে ধামাচাপা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছে মুসলিম নামধারী এই জাতিটিই। আর এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এই জাতির আলেম-মাওলানা দাবিদার শ্রেণীটি। তাদের ঐ ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ সফল হওয়ার ফলেই ইসলামের পৃথিবীময় বিস্তারকে মোজাহেদদের সংগ্রামের ফলের বদলে সুফীদের প্রচারের ফল হিসাবে যেমন লেখাও হয়েছে তেমনি তা বিশ্বাসও করা হয়েছে এবং এখন এই মিথ্যাই সর্বত্র গৃহীত। এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখতে গেলে আলাদা বই-ই হয়ে যাবে, কাজেই শুধু কয়েকটি বুনিয়াদি সত্য লেখা ছাড়া উপায় নেই।
পৃথিবীর যে অংশে আমি বাস করি শুধু সেইটুকুর কথাই বলছি। এই দেশে শেষ ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বখতিয়ার খিলজীর তলোয়ারের শক্তিতে। উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশে হয়েছে শাহজালালের (র.) তলোয়ারে, যে তলোয়ার আজও উপেক্ষিত হয়ে পড়ে আছে। দক্ষিণ বাংলায় হয়েছে খান জাহান আলীর (র.) তলোয়ারে। উত্তর বাংলায় হয়েছে সুলতান মাহমুদ মাহি সওয়ারের (র.) তলোয়ারের শক্তিতে, পশ্চিম বাংলায় হয়েছে শাহ সফী উদ্দিন (র.), শাহ সুলায়মান (র.), সৈয়দ দেওয়ান চন্দন শহীদ (র.) দের মতো অনেক মোজাহেদদের তলোয়ারের জোরে। অবশ্য আমার এ কথার অর্থ এই নয় যে, শুধু মোজাহেদদের সর্বাত্মক সংগ্রামের ফলেই এদেশে আজ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী এই দেশ অস্ত্রের বলে জয় করার আগেও আরব ও অন্যান্য মুসলিমরা ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে এ দেশের বন্দরগুলিতে এসে স্থানীয় লোকজনের সংস্পর্শে আসেন। তখনকার ঐ মুসলিম ব্যবসায়ী ও বণিক মুসলিমরা এখনকার মতো মৃত মুসলিম ছিলেন না। তাঁরা যেখানেই যেতেন সেখানেই তাদের জীবন-বিধান দীন প্রচারের চেষ্টা করতেন। তাদের সে চেষ্টা যে সম্পূর্ণ বিফল হয়েছে তা আমি বলি না। নিশ্চয়ই মানুষের মধ্যে সব সময়ই এমন মন থাকে যা সত্য গ্রহণ করে এবং অনেক মানুষই নিশ্চয় তাদের হাতে মুসলিম হয়েছিলেন। কিন্তু প্রধান কারণ হলো মোজাহেদদের সর্বাত্মক সংগ্রাম। এই দেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পেছনে যাদের অবদান সর্বশ্রেষ্ঠ, তাঁদের কয়েকটি মাত্র নাম উল্লেখ করলাম। তাঁদের জীবনী পড়লে দেখা যায় যে, সংগ্রামেই তাদের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে। সিলেটের শাহ জালালের (র.) মতো অনেকের হাতের তলোয়ার আজও রক্ষিত আছে। তারা যে আধ্যাত্মিক সাধকও ছিলেন না তা আমি বলছি না, তাদের আধ্যাত্মিক সাধনাও অবশ্যই ছিলো। কারণ তাদের জীবন প্রকৃত মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদীর মতই ভারসাম্যযুক্ত ছিলো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের জীবনের সংগ্রামের ভাগটুকু ছেটে ফেলে তাদের কেরামতির ভাগটাকেই শুধু প্রধান নয় একমাত্র ভাগ বলে প্রচার করা হয়েছে। ঐ প্রচারের চেষ্টায় নানা অসত্য, অর্ধসত্য কল্পকাহিনী এমনকি সম্পূর্ণ মিথ্যাও তাদের পবিত্র জীবনীগুলোতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্বনবীর (দ.) প্রকৃত উম্মাহ, ইসলামের সন্ন্যাসী এই মহাযোদ্ধাদের খানকাবাসী সুফী প্রমাণের জন্য যে সমস্ত বই লেখা হয়েছে তাদের মধ্য থেকে একটি বই নিন- গোলাম সাকলায়েনের লেখা- বাংলাদেশের সুফী সাধক। দেখুন, এই যোদ্ধাদের সুফী প্রমাণ করার জন্য লেখক লিখেছেন- “ফলত বাংলাদেশে মুসলিম যে আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ তার জন্য দেশী ও বিদেশী বহু পীর দরবেশ ও সুফীসাধকদের সাধনা ও কর্ম তৎপরতাই প্রধানত দায়ী। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে কোন কোন সময় কোন কোন ধর্মোন্মক্ত মুসলিম বাদশাহ বা শাসক ক্ষাত্রশক্তির সাহায্যে এদেশে ইসলাম বিস্তারের চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সফলকাম হয় নি। মুসলিম ক্ষাত্রশক্তি যেখানে পরাজিত ও বিধ্বস্ত হয়েছে দরবেশ ও সুফী সাধকদের নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক শক্তি সেখানে অত্যাশ্চর্যরূপে জয়লাভ করেছে। এই কথা তিনি লিখলেন বইটার প্রথমদিকে-৮৭ পৃষ্ঠায়। তারপর বহু “সুফী-সাধক”দের বহু যুদ্ধ, বহু করবানি বহু শাহাদাত ও বহু গাজিত্বের বর্ণনার পর বইয়ের শেষ দিকে লিখছেন- “প্রকৃতপক্ষে তুর্কি শাসকদের দ্বারা বাংলাদেশ বিজিত হওয়ার পর সুফী-সাধক এদেশের চিন্তা জগতে অভিনব ও বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূত্রপাত করে।” (২৫৫পৃ.) অর্থাৎ গোলাম সাকলায়েন সাহেব প্রথমে ভুল কথা লিখে পরে নিজের অজান্তেই শেষ দিকে সত্য কথা লিখে ফেলেছেন।
আরও প্রকৃত সত্য এই যে, প্রথম দিকে ইসলামের মোজাহেদদের সংগ্রামের ফলে এই দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ভারসাম্যহীন, অস্ত্রহীন, তসবিহধারী সুফীদের সময়ে দেশ ব্রিটিশদের গোলামে পরিণত হয়। শুধু ‘দরবেশের” সংখ্যাই যদি ধরা হয় তবে প্রথম দিকের ঐ যোদ্ধা দরবেশরা যখন এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন তখন তাদের যে সংখ্যা ছিলো, পরবর্তীতে যখন ব্রিটিশরা এসে মুসলিমদের হাত থেকে দেশ ছিনিয়ে নিলো, তখন “দরবেশ”দের সংখ্যা বহু বেশি। অর্থাৎ যোদ্ধারা ক্ষাত্রশক্তি বলে এদেশে ইসলাম আনলেন আর দরবেশদের, সুফীদের আমলে ব্রিটিশরা এদেশ মুসলিমদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ঐ সুফী দরবেশসহ সমস্ত মুসলিম জাতিটাকেই গোলাম বানিয়ে দিলো। কাজেই একথা বলা যায় যে, ইসলামে সুফিবাদের স্থান রয়েছে তবে তা জেহাদের বিপরীতে নয়। সমস্ত পৃথিবীতে সত্যদীনকে প্রতিষ্ঠিত করাই হলো মুসলিমদের প্রথম এবং প্রধান কাজ। অতঃপর এই প্রধান দায়িত্ব পালনের পর যদি সময় থাকে তবেই সেখানে সুফিবাদের চর্চা করা সমীচীন হবে। জেহাদকে প্রত্যাখ্যান করে, মুসলিমদের সংগ্রামী চরিত্রকে আড়াল করে বর্তমানে যে সুফিবাদের চর্চা করা হচ্ছে তার কোন যথার্থতা ইসলামে নেই। এর পরিণাম অতি ভয়াবহ হওয়া-ই স্বাভাবিক।