প্রশ্ন: মাহদী (আ.), ঈসা (আ.) ও দাজ্জাল প্রসঙ্গে হেযবুত তওহীদের বিশ্বাস ও করণীয় কী?
উত্তর: রসুলাল্লাহ (সা.) এর বহু হাদিসে দাজ্জালের কথা এসেছে, তিনি বলে গিয়েছেন দাজ্জাল আসবে। আমরা হেযবুত তওহীদ বলছি, পৃথিবীময় চলা বর্তমানের যন্ত্রভিত্তিক ধর্মহীন পাশ্চাত্য সভ্যতাই দাজ্জাল। আমাদের এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেকেরই বক্তব্যের পার্থক্য থাকে, অনেকেই আমাদের মতের বিরোধিতাও করেন। তারা বলে থাকেন, কোনো এক সময় এক দানব আসবে, যে দানবের নানা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য তার এক চোখ কানা হবে। এই কথাটি রসুলাল্লাহই (সা.) বলেছিলেন। অনেকেই তাঁর এ কথার ভাবার্থ নিয়ে চিন্তা না করে একে শাব্দিকভাবে ধরে নিয়ে বসে আছেন এক অতিকায় দানবের জন্য।
কিন্তু আমরা মনে করি রসুলাল্লাহ (সা.) এ কথাগুলো রূপক অর্থে বলেছেন। দানব (Giant) বলতে বোঝায় দানবীয় শক্তি, প্রচণ্ড শক্তিধর কিছু। আমরা মনে করি, আল্লাহর রসুল বর্তমানের এই সভ্যতা যা প্রচণ্ড শক্তিধর। আকাশ, জমিন, পানির সবকিছু তার করায়ত্ব। হাদিসে বলা হয়েছে, দাজ্জাল আল্লাহকে প্রভু বলে অস্বীকার করবে এবং নিজেই প্রভুত্বের দাবি করবে। বর্তমানের যান্ত্রিক সভ্যতায় আল্লাহর তৈরি জীবন-ব্যবস্থাকে তথা আল্লাহর দীনকে মানবজীবনের জাতীয় পর্যায়ে থেকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর দেওয়া জীবন-ব্যবস্থার পরিবর্তে মানবজীবনে মানুষের তৈরি জীবন-ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মতে বর্তমানে চলমান সভ্যতাই, দাজ্জাল।
আমরা সকলেই মনে করি, বিশ্বাস করি যে, দাজ্জাল আসবে। ঈসা (আ.) এসে সেই দাজ্জালকে ধ্বংস করবেন ইত্যাদি। কারণ রসুলাল্লাহ এর ভবিষ্যৎ বাণী করে গিয়েছেন; যা প্রকৃতপক্ষেই সত্য। দাজ্জাল আসবে, তারপর ঈসা (আ.) এসে দাজ্জালকে ধ্বংস করে চলে যাবেন। ঈসা (আ.) ও দাজ্জালের ঘটনা শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দাজ্জাল যখন আবির্ভূত হবে, তখন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটবে বলে কোর’আন হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে- ইয়াজুজ মাজুজ এর কথা পবিত্র কোর’আনে উল্লেখ করা হয়েছে। ইয়াজুজ মাজুজ প্রকাশিত হলে মূলত ব্যাপক খাদ্যে সংকট সৃষ্টি হবে। হাদিসে মালহামার (Al-Malhama Al-Kubra, or the Great Battle) কথা উল্লেখ রয়েছে। মালহামার সময় দাজ্জালের সন্ত্রাসী কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, রক্তপাত, জুলুম, খাদ্যের সংকট ইত্যাদির সৃষ্টি হবে। দাজ্জাল আবির্ভাব হওয়ার পর গাজওয়াতুল হিন্দ, মালহামা, ইয়াজুজ মাজুজ ইত্যাদি বিষয়গুলো সংগঠিত হবে, এই বিষয়গুলো মৌলিক। এই বিষয়গুলো কখন হবে, কবে হবে, এই শতাব্দীতে হবে কিনা তা আমি বলতে চাই না।
ধরুন উপরের বিষয়গুলো আমাদের জীবদ্দশায় সংঘটিত হলো, তখন আমরা কী করব? আমাদের প্রস্তুতি কী হবে?
হাদিসে বলা আছে মালহামা, ইয়াজুজ-মাজুজ, গাজওয়াতুল হিন্দ ইত্যাদি যখন সংঘটিত হবে তখন ঈসা (আ.) তার অনুসারী তথা মো’মেনদেরকে নিয়ে এক পাহাড়ের উপর আশ্রয় নিবেন। এ ক্ষেত্রে তুর পাহাড়ের নামও আমরা হাদিসগ্রন্থে পাই। আমি মনে করি, বিষয়গুলো যে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে তেমন নয়। যেকোনো উঁচু জায়গা, মূলত কোনো নিরাপদ একটি জায়গায় ঈসা (আ.) তিনি তার অনুসারী মো’মেনদেরকে নিয়ে আশ্রয় নিবেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করে তাঁর অনুসারী তথা মো’মেনদের জন্য সাহায্যে চাইবেন। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, তখন এক ধরনের লম্বা গলাওয়ালা এক প্রাণী এসে সমস্ত মৃতদেহ সরিয়ে দিবে, বৃষ্টিপাত হবে, জমিন পরিষ্কার হয়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি (সহীহ মুসলিম)।
পরবর্তীতে ঈসা (আ.) আল্লাহর জমিনে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন-ব্যবস্থা তথা সহজ-সরল দীনুল হক প্রতিষ্ঠা করবেন। যার ফলে শান্তি, ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা হবে। এমনই শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে যে, বাঘ আর মহিষ এক ঘাটে পানি খাবে, বাচ্চারা সাপ নিয়ে খেলবে, একটি আনার ফল পরিবারের সবাই মিলে খাবে, এ ধরনের কথাও হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ যেরকম অভাব হয়েছিল, সেরকম প্রাচুর্য্য হবে। যে রকম খুনাখুনি-রক্তপাত হয়েছিল, ঠিক সে রকম ঐক্য হবে। যে ধরনের শত্রুতা হয়েছিল, ঠিক বিপরীত ভ্রাতৃত্ব হবে।
আমি বলতে চাই, ইবলিস আল্লাহর সাথে তার চ্যালেঞ্জ অনুযায়ী মানবজাতিকে আল্লাহর হুকুম, আল্লাহর তওহীদ, আল্লাহ প্রদত্ত কর্মসূচি থেকে মানবজাতিকে সরিয়ে রেখেছে। যার ফলে আমাদের সমাজের মধ্যে রক্তারক্তি, হানাহানি, খুনাখুনি, রাহাজানি ইত্যাদির সৃষ্টি হয়েছে।
তাহলে, পাল্টা অনৈক্যের বিপরীতে ঐক্য, স্বার্থপরতার বিপরীতে স্বার্থহীনতা, শত্রুতার বিপরীতে ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি কীভাবে হবে? কোথা থেকে হবে?
এজন্য একটা আদর্শ লাগবে, একটা শিক্ষা লাগবে। এই শিক্ষাটিই মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য সংগ্রাম করছি আমরা হেযবুত তওহীদ। হেযবুত তওহীদ যে আদর্শ প্রচার করছে। সেই আদর্শ যদি আপনারা বুঝেন, নিজের চরিত্রে ধারণ করেন। ইনশা’আল্লাহ, তবেই পাল্টা অনৈক্যের বিপরীতে ঐক্য, স্বার্থপরতার বিপরীতে স্বার্থহীনতা, শত্রুতার বিপরীতে ভাই-ভাই সৃষ্টি হবে, ইনশাআল্লাহ। কিন্তু তার আগে একটি ঘটনা রয়েছে।
ভালো কিছু পেতে হলে, কিছু অর্জন করতে হলে নিশ্চই কোনো না কোনো খারাপ কিছুর সম্মুখীন হয়েই যেতে হয়। সেক্ষেত্রে আমাদেরও ভয়াবহ ঘটনার মোকাবিলা করতে হবে। সেই ঘটনাটি তবে বলা যাক। মানবজাতির আল্লাহর অবাধ্যতার পরিণাম, শিরিক-কুফুরের পরিণাম, জাহিলিয়াতের পরিণাম, অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্বের পরিণাম, স্বার্থপরতার পরিণাম, হানাহানির পরিণাম, সুদ-ঘুষ রাহাজানির পরিণাম আমাদের ভোগ করতে হবে।
সুতরাং একটি ভয়াবহ ঘটনা আছে সামনে। ওই ঘটনা হবে মো’মেনদের ঈমানের পরীক্ষা, মহা পরীক্ষা। কয়জনের ঈমান থাকবে? আল্লাহই জানেন। সে কয়জন ঈমানদারকে নিয়েই পরবর্তী বিশ্বসভ্যতা তৈরি হবে, ইনশা’আল্লাহ। যারা হেদায়াতে থাকবেন, তারা ঈসা (আ.) ও মাহদি (আ.) এর সাক্ষাৎ পাবেন, যদি তাদের জীবদ্দশায় তাঁরা আসেন।
একটি হাদিস আছে, দাজ্জাল চিনবে কেবল মো’মেনরা। মাহাদি (আ.), ঈসা (আ.) কে কারা চিনবেন কারা? কেবল মো’মেনরা। মো’মেনরা ছাড়া অন্য কেউই চিনবেন না। আল্লাহর রসুল যিনি পুরো পৃথিবীর জন্য যিনি রহমাতাল্লিল আলামিন, তাঁকে মক্কার জাহেলরা কেউ কি চিনেছিল? যারা মো’মেন ছিলেন তারাই চিনেছেন, ঈমান এনেছেন, শহীদ হয়ে গিয়েছেন। জীবন দিয়ে ইসলামের আকাশে তারার মতো জ্বলজ্বল করছেন তাঁরা। যারা জাহেল, তারা তো জাহেল হিসেবেই মৃত্যুবরণ করবেন। কাজেই ঈসাও (আ.) আসবেন, দীন প্রতিষ্ঠাও হয়ে যাবে, হেদায়াতে মানবজাতিকে উঠাবেন। কিন্তু এই ধর্মান্ধ, ধর্মব্যবসায়ী, জালেম-জাহেল, দাজ্জালের অনুসারী, শিরিক-কুফুরে নিমজ্জিত, এই জাহেলরা মাহাদি (আ.) কেও পাবে না, ঈসা (আ.) কেও পাবে না। যদি তারা পেয়ে থাকেন তাহলে তারা তো আর দাজ্জালের পথকে অনুসরণ করবে না।
রসুলাল্লাহ বলেছেন, দাজ্জালের পায়ে সমগ্র মানবজাতি সেজদাহ করবে, দাজ্জালকে রব বা প্রভু বলে মেনে নিবে। বর্তমানে পুরো মানবজাতি কিন্তু এই মানুষের তৈরি জীবন-ব্যবস্থা তথা দাজ্জালের সেজদাহ করছে, দাজ্জালকে প্রভু বলে মানছে।
শেষ কথা হচ্ছে, মো’মেনরাই দাজ্জাল চিনবেন, আল্লাহর সাহায্যে পাবেন, মাহাদি (আ.), ঈসা (আ.) এর দেখা পাবেন। মো’মেন না হলে কাউকেই আল্লাহর সাহায্যে পাবে না, মাহাদি (আ.), ঈসা (আ.) এর দেখা পাবেন না, দেখা পেলেও তাদের প্রতি বিশ্বাস বা ঈমান আনবেন না। মক্কার কাফেরদের মতোই তাদেরকে অবজ্ঞা করবেন। সুতরাং আমাদের জন্য একটাই কাজ, সেটা হলো- মো’মেন হওয়া।