যারা জাতির কর্ণধার তাদেরকে অবশ্যই ন্যায়, সত্য, হকের পক্ষে দৃঢ়পদ থাকতে হবে। কারণ জাতির কর্ণধারগণ যদি অন্যায় করেন তখনই জঙ্গিবাদের মতো অন্যায়গুলোর বিস্তার ঘটে, সমাজের নির্যাতিত, নিষ্পেষিত মানুষের মধ্য থেকে অনেকেই সমাজ পরিবর্তনের জন্য ভুলপথে পা বাড়ায়। পশ্চিমা বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’ দাজ্জাল মানুষকে ভোগবাদী, উচ্চাভিলাসী, অস্বাভাবিক জীবযাপনে অভ্যস্ত ও আত্মকেন্দ্রিক করে ফেলেছে। ভোগবাদীদের অভিধানে নৈতিকতা, মানবতা ও জাত্যবোধ শব্দগুলো থাকে না। অর্থই তাদের পরমার্থ, ভোগবিলাসের জন্যই দেহধারণ। পাশ্চাত্যের সিস্টেম ও এই শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাবে আজ যে যত শিক্ষিত হচ্ছে সে তত স্বার্থপর, দুর্নীতিবাজ, তত বড় জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারী শয়তানে পরিণত হচ্ছে। তাই জাতির কর্ণধারগণকে লক্ষ রাখতে হবে, নিজ দলের বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বা আমলাদের মধ্যে কেউ যেন কোনোরূপে অর্থের জন্য পশ্চিমাদের পুতুলে পরিণত হতে না পারে। ভুললে চলবে না যে, এই শ্রেণিটি অতীতে শত শতবার খ্যাতি-অর্থের লোভে জাতিকে বিক্রি করেছে।
জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ এরা সবাই ছিলেন নবাবের আমলা, মীর জাফর আলী খান ছিলেন নবাবের অতিঘনিষ্ঠ আত্মীয়, পরম আপনজন। তাই যারাই অর্থ-খ্যাতি-আনুকূল্যের লোভে দেশের ক্ষতি করতে দু’বার চিšত্মা করে না, তাদের বিরম্নদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার পাশাপাশি জনসাধারণকেও সচেতন করে তুলতে হবে। এজন্য সর্বাগ্রে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। পূর্বেই বলেছি, বর্তমানে আমাদের দেশে (অন্যান্য মোসলেম দেশেও) প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ব্রিটিশদের তৈরি। তারা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছে যেখানে বিকৃত ইসলাম শিক্ষা দেওয়া হয়। যতদিন এই বিকৃত ইসলাম শিক্ষাদান চলবে ততদিন ধর্মব্যবসায়ী সৃষ্টি হবে, তারা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির অপব্যবহার করবে। এই বিকৃত ইসলাম শিক্ষার পথ খোলা রেখে ফতোয়াবাজি, জঙ্গিবাদ, ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতি, ধর্মান্ধতা কস্মিনকালেও নির্মূল করা যাবে না। দুষ্টক্ষতকে ব্যান্ডেজ দিয়ে যতই ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন, ভিতরে ভিতরে তা রক্তকে দূষিত করে দেয়।
শুধু জঙ্গিবাদ নয়, যে কোনো সামাজিক অপরাধ মোকাবেলায় (দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, যৌতুক, ধর্ষণ, পারিবারিক হত্যাকাণ্ড, চুরি, ছিনতাই প্রভৃতি) ধর্মহীন শুষ্ক উপদেশ উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতই অর্থহীন হবে। মানুষের আত্মিক পরিবর্তন না আসলে অপরাধ সংঘটন থেকে কেউ মানুষকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে না, আর মানুষের আত্মার উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম কেবল ধর্ম। তাই ধর্মকে বাদ দিয়ে যতই তত্ত্বকথা আর মানবতাবাদ প্রচার করা হোক না কেন, ধর্মকে পাশ কাটিয়ে যতই সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করা হোক না কেন, তা দিয়ে জঙ্গিবাদ তো বটেই, কোনো সামাজিক অপরাধও দূর সম্ভব নয়। মানুষ যেহেতু জন্মগতভাবে ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত, তাই ধর্মের শিক্ষাকেই কাজে লাগিয়ে একটি সুন্দর, সুশীল, দুর্নীতিমুক্ত, অপরাধাহীন পবিত্র সমাজ গঠন করা সম্ভব। এ কথাটি আমাদের নয়, বিদ্ব্যৎসমাজের অনেকেই এখন এ বিষয়টি অনুভব করছেন। এখন নীতিনির্ধারকদের অনুভব করার সময় এসেছে। এ বিষয়ে দু’একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিচ্ছি।
গত ২২ নভেম্বর, ২০১৪ খ্রি. তারিখে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কলে ধর্ম, শান্তি এবং আন্তর্জাতিক বিষয় কেন্দ্র এবং ওয়ার্ল্ড ফেইথস ডেভেলপমেন্ট ডায়ালগের উদ্যোগে ‘সেক্যুলারিজম অ্যান্ড ফেইথ ইন্সপায়ার্ড ডেভেলপমেন্ট: আন্ডারস্ট্যান্ডিং কনটেস্টেশন অ্যান্ড কোলাবরেশন’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক কর্মশালায় বক্তারা বলেন, “সমাজের মধ্যে ধর্মের প্রভাবকে বিবেচনায় নিয়েই উন্নয়নের চিন্তা ও পরিকল্পনা করতে হবে। বিশ্বজুড়ে ধর্ম নিয়ে যে উত্তেজনা এবং মৌলবাদী তৎপরতা চলছে, তা বন্ধ করতেও ধর্মের নানা দিক বুঝতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মকে বাদ দেওয়া বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি- এই দুই পথকেই সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখতে হবে।” ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অধ্যাপকবৃন্দ ছাড়াও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান, জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হোসে ক্যাসানোভা ও ক্যাথরিন মার্শাল, ভারতের সেন্টার ফর স্টাডিস অব ডেভেলপিং সোসাইটির রাজীব ভাগার্ভা, ব্র্যাকের হিউম্যান রাইট অ্যান্ড লিগ্যাল এইড বিভাগের পরিচালক ফস্টিনা পেরেরা, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেনপ্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। (প্রথম আলো ২৩ নভেম্বর ২০১৪)
এছাড়া ২২ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি কনফারেন্সে বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) এর প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি প্রফেসর ড. পিটার অ্যাইগেন একটি দেশের দুর্নীতি প্রতিরোধে সুশীল সমাজ, দেশের গণমাধ্যম ও বিশ্বাসভিত্তিক সংগঠনের অপরিহার্যতার কথা উলেস্নখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “We feel that very often, even if the top of a country– a president or prime minister — is extremely strong and committed to fight corruption, they cannot do it alone. They need civil society, media and faith-based organizations to change the culture (of corruption).” অর্থাৎ “আমরা মনে করি, একটি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়, একজন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তিনি অত্যন্ত ক্ষমতাধর এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও এটা একা করা সম্ভব নয়। দুর্নীতির এই সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে চাইলে তাদের প্রয়োজন সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম এবং ধর্মবিশ্বাসভিত্তিক সংগঠন।”
মানুষের জাতীয় জীবনের দিকনির্দেশনা দানে খ্রিষ্টধর্মের ব্যর্থতার পরিণামে জন্ম হয় ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের। তারপর ধীরে ধীরে ঔপনিবেশিকদের হাত ধরে ধর্মহীন জীবনব্যবস্থা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। কখনো আকারে ইঙ্গিতে কখনো বা সরসরি ধর্মকে বর্জনের পক্ষে ইউরোপের সমাজচিন্তক, শিক্ষাবিদ, লেখক জ্ঞানীগুণী দার্শনিকেরা তাদের যুক্তি তুলে ধরতে থাকেন। ইউরোপীয় শাসকদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মকে বা বাস্তব জীবনে অপ্রয়োজনীয় এবং আদ্যিকালের কুসংস্কার হিসাবে তুলে ধরা হতে থাকে। রাজনীতিকরা সমন্বিতভাবে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, তারা ধর্মের অংশগ্রহণ ছাড়াই একটি শান্তিপূর্ণ, বৈষম্যহীন, ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজকাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম। বেশকিছুদিন এ ধারণার ভিত্তিতে রাজতন্ত্র, সামন্তবাদ, ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্র দিয়ে বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালিত হলো। কিন্তু সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির পরিণামে যে সীমাহীন আর্থিক বৈষম্য সমাজে সৃষ্টি হয় তার নিষ্পেষণে সমাজের দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের আত্মা ত্রাহিসুরে ক্রন্দন করতে লাগলো। তাদের মুক্তির গান গেয়ে এগিয়ে এলো কার্ল মার্কসের সমাজতন্ত্র যার মূলসুর সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা ও শ্রেণিহীন সমাজ গঠন। মার্কসবাদ বিশ্বমানবের চিন্তার জগতে অবিস্মরণীয় আলোড়ন তুলতে ও সুদিনের স্বপ্ন দেখাতে শুরম্ন করল। ধর্মকে বাদ দিয়েই জীবন পরিচালনার ধারণা সর্বত্র গৃহীত হয়ে গেল। এর বাইরে সকলকেই রক্ষণশীল (Conservative) বলে আখ্যা দেওয়া হলো।
সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার দরম্নন আবার এলো পুঁজিবাদী বহুদলীয় গণতন্ত্রের জোয়ার। এ দুটি জীবনব্যবস্থাই মরিয়া হয়ে মানবজাতিকে আদর্শিকভাবে পর্যায়ক্রমে অজ্ঞেয়বাদ, নাস্তিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে ধর্মহীনতার দিকে ঠেলে দিতে চাইল। এ প্রচেষ্টা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলল গত শতাব্দীজুড়ে। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে মানুষের মনুষ্যত্বের সম্পর্ক, আত্মার সম্পর্ক, নীতি-নৈতিকতার সম্পর্ক। একে বাদ দিলে মানুষের আত্মাকে বাদ দিতে হয়, সেই সঙ্গে সঙ্কটে পড়ে মনুষ্যত্ব, নীতি-নৈতিকতা, মানবতার অনুভূতিগুলি। মানুষ আর দশটা প্রাণীর মত উদরসর্বস্ব নয়, তার আত্মা আছে। তার মানসিক অবস্থার উপর সমাজের শান্তি-অশান্তি সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। মানবসমাজে শান্তি বজায় রাখার জন্য পারস্পরিক মমত্ববোধ, দরিদ্রের প্রতি দয়া, গুরুজনকে শ্রদ্ধা, পরিজনকে প্রতিপালন, সততা, সমাজচিন্তার প্রয়োজন পড়ে যেগুলি পশুর সমাজে প্রয়োজন হয় না। এগুলো আছে সকল ধর্মবিশ্বাসগুলোর মধ্যে। আজও মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের যে অংশটুকু টিকে আছে তা ঐ ধর্মগুলোরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব। যেহেতু সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি জীবনব্যবস্থা কেবল মানুষের আর্থনীতিক ও রাজনীতিক জীবনের সমস্যা নিয়ে কাজ করে তাই মানবচরিত্রে মনুষ্যত্বের সৃষ্টি-বিকাশ ও সংরক্ষণের বিষয়ে সৃষ্টি হয় বিরাট শূন্যতা।
সমাজের নীতিনির্ধারক থেকে শুরম্ন করে প্রতিটি মানুষের চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তার পদ্ধতি (Way of thinking) হয়ে পড়ে আত্মাহীন ও জড়বাদী। সমাজ থেকেও হারিয়ে যায় মানবতা, প্রতিটি মানুষ হয়ে পড়ে বন্ধুহীন, সহায়হীন, একাকী। সে সর্বদা দারিদ্র্যের ভয়ে ভীত কারণ টাকাই তার বিপদের বন্ধু, মানুষ বন্ধু নয়। এটাই আজ আমাদের সমাজের চিত্র। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে স্রষ্টার দেওয়া জীবনব্যবস্থা যাকে আমরা সরল অর্থে ধর্ম বলে থাকি। ধর্ম মানুষকে বুঝতে শেখায় কোন কাজটি উচিত, কোনটা অনুচিত; সামষ্টিক স্বার্থের তুলনায় ব্যক্তিস্বার্থকে ছোট করে দেখার শিক্ষা মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার ও সংস্কার থেকেই পায়। রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তাকে যখনই অস্বীকার করা হয়, তখনই এর প্রভাবে মানুষের ব্যক্তিগত ঐ চারিত্রিক গুণাবলী বিলীন হতে বাধ্য হয়। মানুষে ক্রমেই স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক হতে হতে এক সময় পশুপর্যায়ে অধঃপতিত হয়, সমাজ অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতিতে সয়লাব হয়ে যায়। এমনই একটি অন্যায়, অবিচারপূর্ণ সমাজে আজ আমরা বসবাস করছি যাকে যাকে অনায়াসে পশুর সমাজের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি মতবাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে চালাতে যখন আমরা প্রায় ধ্বংসের প্রান্তসীমায় এসে পৌঁছেছি তখন সৌভাগ্যক্রমে কিছু চিন্তাশীল ব্যক্তির দৃষ্টি খুলছে। তারা সমাজের উন্নয়নের জন্য ধর্মের অনুশাসনের সহায়তাগ্রহণ ও ধর্মভিত্তিক সংগঠনের মাধ্যমে সমাজসংস্কারের প্রতি সমাজকাণ্ডারিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে বাদ দেওয়ার যে নীতি বিশ্বময় চলছে তার বিরম্নদ্ধে সমাজসচেতন ব্যক্তিদের এই মতপ্রকাশ একটি যুগান্তকারী ভাবনা হিসাবে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। আমরা হেযবুত তওহীদ, যামানার এমামের অনুসারীরাও এ কথাটিই এতদিন ধরে বলে আসছি। আমরা ‘যেনতেন প্রকারে উদ্দেশ্য হাসিলের’ মানসিকতা থেকে নয়, বাস্তবতার নিরীখে ও সত্যের স্বার্থে যে, ধর্মকে বাদ দিয়ে নয় বরং বরং ধর্মের প্রকৃত শিক্ষায় মানুষকে শিক্ষিত করে তুলে সমাজ থেকে অন্যায়-অপরাধ, অশান্তি দূর করার প্রস্তাব করে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে যেন কোনো ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি হাইজ্যাক করে ভুল খাতে প্রবাহিত করতে না পারে। প্রচলিত বিকৃত ইসলাম দিয়ে অপরাধহীন, অবিচারহীন পবিত্র সমাজ গঠন করার চিন্তা হাস্যকর। সেটা সম্ভব শুধু আলস্নাহ-প্রেরিত অবিমিশ্র সত্য ধর্মাদর্শ দিয়ে; যা অনাবিল, অবিকৃত, স্বচ্ছ, হৃদয়গ্রাহী, প্রাকৃতিক, সকলের বোধগম্য; যা আলো-বাতাসের ন্যায় ধর্ম-বর্ণ, দেশ ও জাতি নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য অবারিত, উপযোগী, সহজ ও সরল; যা কোনো বিশেষ শ্রেণির কুক্ষিগত নয়। আল্লাহ অসীম দয়া করে সেই প্রকৃত ধর্মাদর্শ আবার হেযবুত তওহীদকে দান করেছেন।
এটি নতুন কোনো জীবনব্যবস্থা নয়, এটি সেই আদি চিরšত্মন সনাতন সত্য জীবনব্যবস্থার মূলরূপ যা সকল যুগে নবী-রসুল-অবতারগণের উপর আলস্নাহ অবতীর্ণ করেছিলেন। সেগুলিই আজও বিভিন্ন ধর্মের রূপ নিয়ে মানবজাতি দ্বারা চর্চিত হচ্ছে। হেযবুত তওহীদ সেই চিরকালীন ধর্মের আত্মা কী, মনুষ্যত্বের ধর্ম কী তা মানুষের সামনে উদ্ভাসিত করে তুলছে। আমরা চাই মানবজাতি একটি অন্যায় অবিচারহীন, শান্তিময় সমাজে জীবনযাপন করম্নক। এ চাওয়া প্রতিটি দেশের সরকারেরও বটে। কিন্তু সরকারগুলো চাচ্ছে জোর করে, শান্তি দিয়ে, পাহারা দিয়ে মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখতে ,আর আমরা বলছি, এটা অন্যায় দূর করার সঠিক পন্থা নয়। এটা কোনোদিনও কেউ করতে পারে নি, পারবেও না।
সনাতন ধর্মশাস্ত্রে উল্লেখিত বিষ্ণুর অবতার পরশুরামের জীবনের একটি উদাহরণ এখানে দেওয়া যায়। কাশীর রাজকন্যা অম্বা গুরু পরশুরামের কাছে গেলেন মহামহিম ভীষ্মের বিরুদ্ধে নালিশ করতে। পরশুরাম বললেন, ‘দেবী, এত দুর্গম স্থানে আসার এমন কিসের প্রয়োজন তোমার?’ অম্বা বললেন, ‘ন্যায়ের খোঁজে এসেছি ভগবান। সবাই বলে আপনি অসংখ্য ক্ষত্রিয়ের বিনাশ করেছেন।’
পরশুরাম বললেন, ‘একুশবার এই ধরার ওপর আততায়ী ও দুষ্ট ক্ষত্রিয়দের বিনাশ করেছি, বিধ্বংস করেছি। কিন্তু অবশেষে আমি এই জ্ঞান লাভ করেছি যে, কমণ্ডলু (জলপাত্র) উল্টে দিলেই তার ভেতরের রিক্ততা দূর করা যায় না। তাতে জল ভরে দিলেই তার রিক্ততা দূর হতে পারে। মনুষ্যের হৃদয়ে ন্যায় স্থাপন করলেই অন্যায় দূর হতে পারে।’
পরশুরাম ছিলেন বিরাট ক্ষমতাবান যোদ্ধাপুরম্নষ। তিনি একুশবার এ পৃথিবী থেকে দুষ্ট ক্ষত্রিয়দের বিনাশ সাধন করেছিলেন। কিন্তু ধরাপৃষ্ঠ থেকে অন্যায়-অবিচার দূর করতে পারেন নি। অতঃপর তিনি একটি চিরšত্মন সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মানবহৃদয়ে ন্যায় স্থাপন করা গেলে অন্যায় আপনিই দূর হবে। এরপর তিনি নিজ আশ্রমে জ্ঞানার্থীদেরকে ন্যায়, ধর্ম, মানবতা এবং অবশ্যই অস্ত্র ও যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলেন। কারণ শুধুমাত্র উপদেশ দিয়েও সমাজে শান্তি আসবে না, সমাজে কিছু মানুষ সর্বদাই থাকে যারা নিতাšত্ম অপরাধমনস্ক। তাদের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ না করে উপায় থাকে না। মহারথ ভীষ্ম, গুরম্ন দ্রোণাচার্য, মহাবীর কর্ণ সকলেই ছিলেন পরশুরামের শিষ্য যাঁদের প্রত্যেকেই ভারতসাহিত্যে বীর যোদ্ধা হিসাবে অমর হয়ে আছেন।
এখনো কত প্রাসঙ্গিক মহাভারতের এই উক্তি! মানুষের ভেতর থেকে অন্যায় দূর করতে হলে তার ভেতরে ভরে দিতে হবে ন্যায়, দিতে হবে প্রকৃত শিক্ষা। তা না দিয়ে মানুষকে বিনাশ করে দেওয়ার মধ্যে সমাধান নেই। সেই বিনাশ থেকে জন্ম নেবে আরেক বিনাশী। ক্রসফায়ার কোনো সমাধান নয়, হত্যার বদলে হত্যাও কোনো সমাধান নয়। একমাত্র সমাধান শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সঠিক শিড়্গার প্রসার ঠিক যা করেছিলেন পরশুরাম।
কিন্তু এখন তো পরশুরামের মতো কোনো গুরু নেই। সব ‘গুরু’ এখন শিক্ষাবাণিজ্যে ব্যস্ত। কে দূর করবে মানুষের রিক্ততা? কে দেবে মানুষকে প্রকৃত শিক্ষা? দেবে রাষ্ট্র। নাগরিকদের মানবিক ও সংস্কৃতিসম্ভূত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার দায় রাষ্ট্রের। জনগণ ন্যায়বান হলেই একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আমরা হেযবুত তওহীদ আমাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে মানবহৃদয়ে ন্যায় স্থাপন করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। তবে যেহেতু দুর্নীতি, ধর্মব্যবসা, জঙ্গিবাদ, সামাজিক অপরাধ ইত্যাদি আমাদের জাতীয় সমস্যা, তাই এগুলোর মোকাবেলায় জাতির দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যত দ্রুত এই মহাসত্য উপলব্ধি করে যথাযথ কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করবেন তত দ্রুত জাতি মঙ্গলের দিকে ধাবিত হবে ইনশা’আল্লাহ।