জয়পুরহাটে হেযবুত তওহীদের জেলা কার্যালয় উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন হেযবুত তওহীদের রংপুর ও রাজশাহী বিভাগীয় আমির মো. মশিউর রহমান। তাঁর বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত রূপ নিম্নে তুলে ধরা হলো- যুগে যুগে ধর্ম এসেছে মানুষের মুক্তির জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য। সেই ধর্মকে মানুষের মুক্তির কল্যাণে ব্যবহার না করে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করাই ধর্মের অপব্যবহার। বর্তমানে একটি গোষ্ঠী ধর্মের অপব্যবহার করে স্বার্থ উদ্ধার করেছে, ধর্ম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে, অথচ ইসলামের কাজ করে বিনিময় গ্রহণ আল্লাহ হারাম করেছেন। আরেক দল অপরাজনীতি করছেন, জাতিবিনাশী কর্মকাণ্ড করছে। আরেকদল লোক সন্ত্রাসবাদী, জঙ্গিবাদী ঘটনা ঘটিয়ে আল্লাহ, রসুলের নামে, কেতাবের নামে চালিয়ে দিয়েছে। মাঝখানে বদনাম হয়েছে ধর্মের, বদনাম হয়েছে মুসলমানের, বদনাম হয়েছে কেতাবের এবং আল্লাহ রসুলের। এখন এই ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যদি পুরো ষোলো কোটি বাঙ্গালী যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারি তাহলে আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎও ইরাক সিরিয়া আফগানিস্তানের মত হতে পারে। এখন জোরেসোরে সেই পায়তারা চলছে।
ইসলামকে পণ্য বানিয়ে আল্লাহ ও রসুলের যে অবমাননা এই জনগোষ্ঠীর ধর্মব্যবসায়ী একটি শ্রেণি করেছেন শত শত বছর ধরে, সেটা আর কেউ করেনি। তারা মানুষের ধর্মানুভূতিকে ব্যবহার করে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষিপ্ত করে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে খুব পটু। ইসলাম যেভাবে বর্বর আরবদের চরিত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সৃষ্টি করেছিল এই ওয়াজশিল্পিরা সেটা করতে পারছেন না, তারা সমাজের অন্যায় অবিচার দূর করতে পুরোপুরি অক্ষম। এখন তারা পারেন, গুজব তুলে দিয়ে সাময়িক একটি হুজুগ সৃষ্টি করে, ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ধর্মানুভূতিকে উসকে দিয়ে একটি উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে। এই জাহেলিয়াতের, মূর্খামির অবসান তখনই হবে যখন ধর্মবিশ্বাসী সাধারণ মানুষের সামনে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা, আদর্শ সুস্পষ্ট হবে। তারা জানতে পারবে যে দাঙ্গা ও জেহাদ, যুদ্ধ কখনও এক নয়। যুদ্ধের নীতি থাকে দাঙ্গায় কোনো নীতি থাকে না। আল্লাহর রসুল যতগুলো যুদ্ধ করেছেন সবগুলোতে তাঁর সৈন্যবাহিনী থেকে প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনী ছিল কয়েকগুণ বড়। দাঙ্গায় হয় এর উল্টো। দুর্বল একটি গোষ্ঠীর উপর সংখ্যাধিক্যের শক্তিতে সংগঠিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া হয়। মানুষের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়, হত্যাকাণ্ড হলে সেটাকে গণপিটুনি বলে চালিয়ে দেওয়া হয়, উসকানিদাতা ধর্মব্যবসায়ীরা লেবাসের আড়াল নিয়ে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ সত্ত্বেও আইনের হাত থেকে পার পেয়ে যান। রাজনৈতিক নেতারাও এই ভণ্ড ধর্মনেতাদের সমীহ করে চলেন কেবলমাত্র ভোটের জন্য। এভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মের নামে এই অন্যায় আমাদের সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তথাপি চিন্তাহীনতা, যুক্তিহীনতা, কূপমণ্ডূকতা আজ মুসলিম জাতির ধর্মবোধ, ধর্মচিন্তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে তারা তাদের পালিত ধর্ম আদতে তাদের কতটুকু কাজে আসছে, আখেরাতে তা তাদেরকে জান্নাতে নিতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে চিন্তা করার, নিজের কাছে সেই প্রশ্ন উত্থাপনের সাহসিকতা ও মানসিকতাও হারিয়ে ফেলেছে। এই ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও আজ আক্রান্ত, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমতাবস্থায় কীভাবে এই জঙ্গি, উগ্রবাদী তাণ্ডব ও সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তিগুলোর ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করা সম্ভব তা গুরুতর চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাই কেবল মানবসমাজে অনাবিল শান্তি পূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এটা ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। কিন্তু সেই ধর্ম আসলে কী এবং ধর্মের প্রকৃত শিক্ষায় বা কোথায় পাওয়া যাবে? ধর্ম হচ্ছে বস্তুর অভ্যন্তরস্থ সেই নীতি যা সে মেনে চলতে বাধ্য থাকে। যেমন আগুণের ধর্ম পোড়ানো, পানির ধর্ম ভেজানো। আগুন বা পানির এই গুণ সনাতন, শাশ্বত। লক্ষ বছর আগে আগুন যেমন পোড়াত, লক্ষ বছর পরেও পোড়াবে। ঠিক মানুষেরও প্রকৃতিগত কিছু বৈশিষ্ট্য বা গুণ রয়েছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব; সেই হিসেবে মানুষের ধর্ম হলো তার মানবিক গুণাবলী। সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি, দয়া, মায়া, ভালবাসা, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সৌহার্দ্য , বিবেক, সহমর্মিতা, ঐক্য আর শৃঙ্খলা ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলী হলো মানুষের ধর্ম। যতক্ষণ একজন মানুষ অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হয়, অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হয়, অপরকে সহযোগিতা করে, আর্ত-পীড়িতের পাশে দাঁড়ায় ততক্ষণ সে ধার্মিক হিসেবেই পরিগণিত হওয়ার যোগ্য। ধর্ম এসেছে মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য। ধর্ম এসেছে মানবতার কল্যাণ, শান্তি ও মুক্তির জন্য। ধর্ম মানুষকে নিজের ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে মানবতার কল্যাণে কাজ করা শেখায়, আর এটিই হলো ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা।
ধর্মের এই প্রকৃত শিক্ষা এখন আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত নেই, এটা এখন ধর্মব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক পুঁজি এবং পার্থিব স্বার্থ হাসিলের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ধর্মব্যবসায়ীরা মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে হ্যাইজাক করে তাদের মনে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে দাঙ্গা, ফাসাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটায়। এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়ে ধর্মের নামে উন্মাদনা সৃষ্টি করে জননিরাপত্তা ও দেশকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়, দেশে এক ভয়াবহ অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এভাবে তিউনেশিয়া, ফিলিস্তিন, আলজেরিয়া, সিরিয়া, মিশর ও পাকিস্তানে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনেও কিন্তু ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার অভাবই দায়ী। আজ পৃথিবীব্যাপী মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মকে উপাসনালয়ের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ করেছে। উপাসনালয়ের চার দেয়ালের মধ্যে উপাসনায় মশগুল থাকলে স্রষ্টাকে পাওয়া যাবে না। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে ব্যবহার করে দেশ ও জাতির উন্নতি, প্রগতি ও সমৃদ্ধি সৃষ্টিতে কাজে লাগাতে হবে। আসুন, আমাদের যার যার ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে পরিচালিত করি। কোন পথে? যে কাজ করলে মানুষ শান্তি পাবে, সামগ্রিক জীবনে উপকৃত হবে, যে কাজে মানুষ মুক্তি পাবে, অভাব-অনটন দূর হবে, অনৈক্য দূর হবে, হানাহানি দূর হবে, কষ্ট-দুঃখ-দারিদ্র্য, অশিক্ষা-কুশিক্ষা দূর হবে সেই কাজ করি। সেটাই হবে প্রকৃত ইসলাম।