৫৭০ খ্রিষ্টাব্দ। আরবে তখন আইয়ামে জাহেলিয়াত, অজ্ঞানতার যুগ, অন্ধত্বের যুগ। ইবরাহীম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.) যে তওহীদের শিক্ষায় জাতিকে আলোকিত করে গিয়েছিলেন, সেই আলো আর নেই। শিরক, কুফর, আর অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত সমগ্র আরব সমাজ। এই অজ্ঞতা আর অন্ধত্বে ভরা আরবের মাটিতে মুক্তির আলোকবর্তিকা হাতে আবির্ভূত হলেন বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.)।
আল্লাহর রসুলের নবুয়্যত লাভ
আল্লাহর রসুল সর্বদা সমাজের অসঙ্গতি ও দুর্দশা নিয়ে ভাবতেন, ব্যাকুলচিত্তে খুঁজতেন সমাধানের রাস্তা। যখন তাঁর বয়স ৪০ বছর পূর্ণ হলো, জিব্রাইল (আ.) এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর নিকট পাঠালেন সমস্ত অন্যায়, অবিচার, অশান্তি থেকে মুক্তির একমাত্র পথনির্দেশ, হেদায়াহ, তওহীদ। তিনি সমস্ত মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর প্রেরিত রসুল।’ (সুরা আরাফ: ১৫৮) মানুষকে ডাক দিলেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ্’Ñকলেমার দিকে। আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দিয়ে বললেন, ‘তিনিই তাঁর রসুলকে সঠিক পথনির্দেশ ও সত্যদ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, অপর সমস্ত দীনের উপর এটাকে জয়যুক্ত করার জন্য। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা সফ ৯, তওবা ৩৩, ফাতাহ্ ২৮)
সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কেন প্রয়োজন?
এটি সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় কোনো আদর্শ যত নির্ভুলই হোক, সেটাকে প্রতিষ্ঠা করা না গেলে ওই আদর্শের কোনো মূল্য থাকে না। শেষ ইসলামের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আল্লাহ তাঁর আখেরী নবীকে দুইটি মহামূল্যবান সম্পদ দান করলেন, হেদায়াহ্ ও সত্যদীন, যা সূর্যের মতো আলোকময়। এই সত্যের আলোয় সারা পৃথিবী আলোকিত হবে, কেটে যাবে অজ্ঞানতার অন্ধকার, বন্ধ হবে দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা, শাসিতের উপর শাসকের অবিচার, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, এটাই লক্ষ্য। কিন্তু সেই সত্য যদি প্রতিষ্ঠাই না পায় তাহলে এই মহামূল্যবান সম্পদ দুনিয়াতে থাকা আর আসমানে থাকা সমান কথা হয়ে যায়। সুতরাং আল্লাহ যখন তাঁর রসুলের দায়িত্বের কথা বললেন তখন সুস্পষ্টভাবে বলে দিলেন তিনি তাঁকে হেদায়াহ্ ও দীনুল হক্ব দিয়েছেন এই জন্য যে, বিশ্বনবী যেন সেটা সারা পৃথিবীতে অন্যান্য সমস্ত দীনের উপর জয়যুক্ত করেন, প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইতিহাস সাক্ষী আল্লাহর রসুল এক মুহূর্তের জন্যও সেই দায়িত্বের কথা বিস্মৃত হননি।
আল্লাহর রসুলের বিপ্লবী জীবন
হেরা গুহায় নব্যুয়ত লাভের মুহূর্ত থেকে ওফাত পর্যন্ত আল্লাহর রসুলের ২৩ বছরের জীবন- সংগ্রাম ও বিপ্লবের জীবন। অত্যাচারী শাসকদের ধারালো তলোয়ারকে উপেক্ষা করে বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দিতেন- ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম চলবে না’। নিশ্চিত মৃত্যুঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়েও তিনি শত্রুকে পরোয়া করেননি, সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে এক চুলও সরে দাঁড়াননি। তিনি বলেছেন, ‘‘আমার এক হাতে চন্দ্র আর এক হাতে সূর্য এনে দিলেও আমি সত্য প্রচারে পিছপা হবো না, এতে হয় আমার ধ্বংস নয়তো বিজয়!’’ (সিরাতে রাসুলুল্লাহ্, ইবনে ইসহাক) ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বন্ধুর পথে তিনি ছুটে চলেছেন সুস্থির লক্ষ্য অভিমুখে। কত বাধা, কত প্রতিবন্ধকতা, নির্মম নির্যাতন, অপমান, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, হুমকি, প্রলোভন, রক্তপাত ও যুদ্ধের সাইক্লোন বয়ে গেছে তাঁর পথের উপর দিয়ে। কিন্তু তিনি থেকেছেন অটল, অনড়, আপোসহীন, অবিচল, হানিফ (একাগ্র)!
নব্যুয়তের ১৩তম বছরের ঘটনা। মক্কা তাঁর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করায় এই সময় তিনি মদিনায় হিজরত করলেন। মদিনার মানুষ সত্যকে আলিঙ্গন করে নিলো। আল্লাহর রসুলকে নিজেদের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নিজেদেরকে সমর্পণ করলো আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি। যেহেতু তারা তওহীদের চুক্তিতে ঐক্যবদ্ধ অর্থাৎ আল্লাহর হুকুমের প্রতি সমর্পিত, কাজেই আল্লাহ পবিত্র কোর’আনের মাধ্যমে যা হুকুম/বিধান নাজেল করলেন, সেটা তারা একবাক্যে মেনে নিতে লাগলো এবং আল্লাহর হুকুম মেনে নেওয়ার ফলে তাদের সমাজ থেকে মুছে যেতে লাগলো সমস্ত অন্যায়, অবিচার ও অশান্তির ছাপ। মদিনা- যেখানে যুদ্ধ রক্তপাত ও অনিরাপত্তাই ছিল নিত্যদিনের ঘটনা, সেই মদিনা হয়ে উঠলো আরবের মধ্যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার ‘মডেল’।
কিন্তু আল্লাহর রসুল তো কেবল মদিনার জন্য আবির্ভূত হননি। আল্লাহ তাঁকে পাঠিয়েছেন সমস্ত পৃথিবীর জন্য, সমস্ত পৃথিবীর আর্ত-মানবতার মুক্তির জন্য। যতদিন সমস্ত পৃথিবী থেকে অন্যায় ও অশান্তি নির্মূল না হবে, ততদিন তিনি সংগ্রাম চালিয়ে যেতে আদিষ্ট হয়েছেন।
ওই আদশ পালন করতে বারবার রণাঙ্গনে ছুটে যেতে লাগলেন আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবীরা। মাত্র ১০ বছরে করলেন ৭৮টি/ততোধিক যুদ্ধ। এমন একটি জাতি তিনি গড়ে তুললেন যাদেরকে ‘জাতি’ না বলে ‘দুর্ধর্ষ সামরিক বাহিনী’ বলাই যুক্তিসঙ্গত হয়। ওই জাতিকে দৈহিক, মানসিক ও আত্মিকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে এমনভাবে গড়ে তুললেন ও আকিদা শিক্ষা দিলেন যেন তারা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার উপর আল্লাহর অর্পিত দায়িত্বের কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে না যায় এবং নেতার অবর্তমানেও তাঁরই মতো করে সংগ্রাম চালিয়ে সারা পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করে সমস্ত মানবজাতিকে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার উপহার দিতে পারে।
কীভাবে সংগ্রামের মাধ্যমে দীন প্রতিষ্ঠা করতে হবে তা নিজে করে দেখিয়ে, মাত্র ১০ বছরের মধ্যে সমগ্র আরব উপদ্বীপে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করে, বাকি পৃথিবীতে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দায়িত্ব উম্মাহর উপর অর্পণ করে তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন- তাঁর সুন্নাহ (সংগ্রাম) যারা ত্যাগ করবে তারা তাঁর কেউ নয়, তিনিও তাদের কেউ নন। এর পরের ইতিহাস যেন ইতিহাস নয়, রূপকথা! আজও মানবজাতি আল্লাহর রসুলের তৈরি করে যাওয়া ওই উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটির বিজয়-অভিযানের কাহিনী পড়তে গিয়ে বারবার বিস্মিত হয়!
উম্মতে মোহাম্মদীর বিস্ময়কর বিজয় অভিযান
আল্লাহর রসুলের ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে সেই জাতি ঘরবাড়ি, খেত-খামার, আত্মীয়-স্বজন এক কথায় পার্থিব সমস্তকিছু উজাড় করে দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামে বেরিয়ে পড়ল। আরবের মাটি থেকে বেরিয়ে সরাসরি তৎকালীন পৃথিবীর দুই সুপার পাওয়ার, রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলো এবং এক এক করে নয়, একই সাথে দুইটি বিশ্বশক্তিকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করলো। এই বিজয়-অভিযান চলল প্রায় ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত এবং ততদিনে অর্ধেক পৃথিবী এই জাতির কর্তৃত্বের অধীনে এসে পড়লো। অর্ধেক পৃথিবীতে আল্লাহর রসুলের আনিত দীন প্রতিষ্ঠিত হলো। নিরাপত্তা, আত্মিক পরিশুদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নতির চরম শেখরে পৌঁছে গেল ওই উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটি।
আল্লাহর দেওয়া সত্যদীনে শান্তি ও সমৃদ্ধির অনন্য দৃষ্টান্ত
এমন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে মানুষ রাতে ঘুমানোর সময় ঘরের দরজা বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতো না, রাস্তায় ধনসম্পদ ফেলে রাখলেও তা পরে যেয়ে যথাস্থানে পাওয়া যেতো। চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানি প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। আদালতে মাসের পর মাস কোনো অপরাধ সংক্রান্ত মামলা আসতো না। কেউ অপরাধ করে ফেললেও নিজেই নিজের বিচার দাবি করতো। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রতিটি মানুষ এমন স্বচ্ছল হয়েছিল যে, তারা যাকাত ও সদকা দেওয়ার জন্য টাকা পয়সা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো কিন্তু সেই টাকা গ্রহণ করার মতো লোক পাওয়া যেতো না। শহরে নগরে লোক না পেয়ে মানুষ মরুভূমির অভ্যন্তরে যাকাত দেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াতো। শত্রু হয়ে গেলো ভাই, স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক মানুষ হয়ে গেলো মানবতার কল্যাণে জীবনÑসম্পদ উৎসর্গীকৃতপ্রাণ সংগ্রামী মোজাহেদ। জ্ঞান-বিজ্ঞানে যারা ছিল সবচেয়ে পশ্চাৎপদ, সেই জাতিটিই ইসলামের পরশপাথরে এতখানি পরিবর্তিত হয়ে গেল যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষকের আসন লাভ করল। সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অভিনব অগ্রগতি সাধন করে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সেই জাতিটি পৃথিবীর ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এক রেনেসাঁর জন্ম দিল। উম্মতে মোহাম্মদীর সেই রেনেসাঁই পরবর্তীতে স্পেন ও ফ্রান্স হয়ে ইউরোপীয় রেনেসাঁর উপাদান যুগিয়েছিল এ কথা পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকরাও স্বীকার করেন।
এরপর ঘটলো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা
আল্লাহর রসুলের ইহলোক ত্যাগের ৬০-৭০ বছর পর পর্যন্ত সমস্ত পৃথিবীতে মানবাধিকার, শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাবার পর, পরবর্তীতে জাতি তাদের লক্ষ্য অর্থাৎ উম্মাহর উপর রসুলাল্লাহর (স.) অর্পিত দায়িত্বের কথা ভুলে গেলো। একজাতি একদেহ হয়ে অন্যসমস্ত দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে কেবল দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার যেই নজির রসুলাল্লাহর আসহাবগণ দেখিয়েছিলেন সেটা থেমে গেলো। যখনকার কথা বলছি, তখন কিন্তু রসুলাল্লাহর কাছে থেকে যারা সরাসরি ইসলাম শিখেছিলেন অর্থাৎ রসুলের আসহাবগণ, তাঁরা পৃথিবীতে নেই। ততদিনে তারা একে একে প্রায় সবাই ইন্তেকাল করেছেন। আকিদা ভুলে যাবার মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটলো তাদের পরবর্তী প্রজন্মে এবং এর পরিণতি দাঁড়ালো ভয়াবহ। খেলাফত পর্যবসিত হতে লাগলো সাম্রাজ্যে। শাসকরা পৃথিবীর অপরাপর রাজা-বাদশাহর মতো ভোগ বিলাসিতার সঙ্গে রাজত্ব করতে লাগলো। জাতিটিকে যে উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল সেটাই যখন তারা ভুলে গেল তখন তাদের দৃষ্টি ছড়িয়ে পড়ল অন্যান্য দিকে। তাদের একটি বড় অংশ, আলেম, পণ্ডিত শ্রেণি তাদের ক্ষুরধার মেধা খাটিয়ে দীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে লক্ষ লক্ষ মাসলা মাসায়েল রচনা করতে লাগলো। ছোটখাটো বিষয়গুলো নিয়ে ফতোয়া, পাল্টা ফতোয়া দিতে দিতে হাজার রকমের ফতোয়ার ধারা উপধারার পাহাড় গড়ে উঠলো। আর তার উপর ভিত্তি করে তর্ক-বাহাস করে এক উম্মতে মোহাম্মদী হাজারো ফেরকা আর মাজহাবে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গেলো। অন্যদিকে জাতির মধ্যে জন্ম নিলো একটি বিকৃত সুফিবাদী গোষ্ঠী। তারা উম্মতে মোহাম্মদীর সংগ্রামী জীবনটাকে উল্টিয়ে একেবারে অন্তর্মুখী করে দিলো। যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামী, প্রতিবাদী দুর্দান্ত গতিশীল ইসলামকে তারা সংসারত্যাগী, বৈরাগী, সাধু-সন্ন্যাসীর ধর্মে পরিণত করলো। সমাজে নিরাপত্তা, ন্যায় প্রতিষ্ঠিত আছে কিনা সে বিষয়ে উদাসীন হয়ে তারা নিজেদের আত্মার উন্নতিকেই জীবনের মূল কাজ বানিয়ে নিলো। আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায় নির্দেশ করতে গিয়ে এই আধ্যাত্মিক সাধকগণ শত শত তরিকা সৃষ্টি করলেন। আর বিরাট সংখ্যক সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ হাজারো মতভেদের উপর গড়ে ওঠা ফেরকা-মাজহাব-তরিকায় বিভক্ত হয়ে গেলো। ব্যস! এক আল্লাহর বান্দা, এক নবীর উম্মত, এক কিতাবের অনুসারী জাতি হাজার হাজার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লো।
সময় যত গড়িয়েছে জাতি সংখ্যায় বেড়ে কোটি কোটি হয়েছে। কিন্তু কর্মফল হিসেবে জাতি তখন শিয়া, সুন্নী, শাফেয়ী, হাম্বলী, হানাফী, চিশতিয়া, কাদেরিয়া, নক্শ্বন্দিয়া ইত্যাদি মাজহাবে তরিকায় বিভক্ত। ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া বাদ দিয়ে তারা নিজেরা একে অপরকে দোষারোপ, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তর্ক-বাহাস, মারামারি, হানাহানি করতে লাগলো। কী দুর্ভাগ্যজনক! উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক যে ক্বাবা, সেই ক্বাবায় গিয়েও প্রধান চার মাজহাবের অনুসারীরা একত্রে সালাহ্ (নামাজ) করতে পারেনি বহু বছর। অপর মাজহাবের প্রতি ঘৃণা আর নিজ মাজহাবের অহংকারকে ভিত্তি করে তারা ক্বাবার চার কোণে চারটি মেহরাবসহ তাবু স্থাপন করে নিজ নিজ মাজহাবের ইমামের পেছনে নামাজ পড়েছেন শতাব্দীর পর শতাব্দী। কী নির্মম পরিহাস!
আল্লাহর সতর্কবাণী সত্য হলো
আল্লাহ কোর’আনে বারবার সতর্কবাণী করেছেন ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ করলে মর্মন্তুদ শাস্তি দেওয়া হবে’, আল্লাহর রসুল বলেছেন ‘যারা আমার সুন্নাহ ছেড়ে দিবে তারা আমার কেউ নয় আমি তাদের কেউ নই’ ‘তোমরা ঐক্য নষ্ট করো না, ঐক্য ভঙ্গ কুফর, যারা ঐক্য শৃঙ্খলা আনুগত্য হেজরত ও জেহাদ এই পাঁচদফার ঐক্যবদ্ধনী থেকে এক বিঘত সরে যাবে তাদের গলদেশ থেকে ইসলামের রশি খুলে যাবে, তারা হবে জাহান্নামের জ্বালানি পাথর। (হাদিস) সেই সতর্কবাণীগুলো ভুলে গিয়ে যখন জাতি তর্ক-বাহাস আর ফতোয়াবাজিতে মেতে উঠলো, তখন আল্লাহ এদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বর্বর হালাকু খানের সৈন্যরা। মুসলমানদের রক্তে ফোরাত নদী লাল হলো। তাদের মস্তক দিয়ে হালাকু খান পিরামিড বানালো। নারী-শিশুদেরকে পর্যন্ত রেহাই দেওয়া হলো না। স্বয়ং খলিফাকে লাঞ্ছনা আর অপমানের সাথে হত্যা করা হলো। তবু জাতির হুঁশ হলো না। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রসুলের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হলো না। বাকি পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবাধিকার ও সাম্য স্থাপনের সংগ্রাম আরম্ভ করলো না। আবার ফিরে গেল সেই হুজরা, খানকায়। সেই বাহাস, তর্কাতর্কি, চুলচেরা বিশ্লেষণ, আধ্যাত্মিক ঘষামাজাই শুরু হলো নতুন উদ্যমে। আবার শুরু হলো শাসকদের ভোগ-বিলাসিতার রাজত্ব। ফলে এবার এলো চূড়ান্ত মার খাবার পালা।
দাসত্বের কারাগারে বন্দী জাতি
এই জাতির জন্য গজবস্বরূপ ইউরোপ থেকে উঠে আসলো বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো। তারা একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত করতে লাগলো মুসলিমদেরকে। তাদেরকে মোকাবেলায় এই মুসলিম নামধারী জাতিটি কোথাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলো না। পারার কথাও নয়, কারণ এই জাতি আর সুশৃঙ্খল, এক লক্ষাভিমুখী সংগ্রামী জাতি নেই, তারা সংগ্রাম ছেড়েছে হাজার বছর আগে। সেই সংগ্রামী চরিত্র, সেই শাহাদাতের তামান্না, সেই ঐক্য, সেই শৃঙ্খলা ও সেই আনুগত্য- কিছুই তাদের মধ্যে নেই। অন্তত তারা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারতো তবু হয়তো এই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মোকাবেলায় কিছুটা হলেও বাধা দিতে পারত। তা তো হয়ইনি, বরং বহু জায়গায় শত্রুরা এই জাতির অনৈক্য ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের সুযোগ গ্রহণ করেছে।
ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস- যেই জাতিকে সৃষ্টিই করা হলো সমস্ত পৃথিবীময় সংগ্রাম চালিয়ে সকল অপশক্তিকে নির্মূল করে মানুষকে তার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, সেই জাতি নিজেরাই সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির দাসে পরিণত হলো! আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, যখন এই ঘটনাটি ঘটলো অর্থাৎ আজ থেকে কয়েশ’ বছর পূর্বে, তখন এই জাতির সদস্যরা সংখ্যায় কোটি কোটি। তাদের মসজিদের অভাব নেই, নামাজ-রোজার অভাব নেই, আলেম-ওলামা-পীর-বুজুর্গ কোনোকিছুরই অভাব নেই। লক্ষ লক্ষ কোর’আন, হাদিস ও ফিকাহ্র মহাপণ্ডিত ছিলেন, কিন্তু কেউই জাতিকে দাসত্বের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলেন না। শুরু হলো ঔপনিবেশিক পরাধীনতার যুগ, দাসত্বের যুগ।
ইলাহ’র (হুকুমদাতা) আসনে ব্রিটিশ!
ভারতবর্ষে আমরা ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হলাম। ব্রিটিশরা প্রথম ধাপেই আমাদের জীবন থেকে আল্লাহর হুকুমকে বাতিল করে নিজেরা হুকুমদাতার আসনে বসে পড়লো। আমাদের ইলাহ তখন আর আল্লাহ রইলেন না, কার্যত আমাদের ইলাহ তথা হুকুমদাতা হয়ে গেল ব্রিটিশ শাসকরা। তারা তাদের মনগড়া হুকুম/বিধান/ব্যবস্থা দিয়ে আমাদের জীবন পরিচালনা করতে লাগলো, আর আমরা সেটা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতে বাধ্য হলাম। খুবই স্বাভাবিক, তারা তো আর আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য আসেনি (সেটা ছিল উম্মতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব) তারা এসেছে শোষণ করতে, লুণ্ঠন করতে, সাম্রাজ্য স্থাপন করতে। আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করলে শোষণ-লুণ্ঠন করবে কী করে? কী লজ্জা ও অপমানের বিষয়! যেই উম্মতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব ছিল সমস্ত পৃথিবী থেকে মানুষের মনগড়া বিধানকে অচল করে দিয়ে আল্লাহর হুকুম-বিধান প্রতিষ্ঠা করা, তাদের নিজেদের জীবন থেকেই আল্লাহর হুকুম-বিধানকে প্রত্যাখ্যান করে মানুষের মনগড়া হুকুম-বিধান বলবৎ করা হলো এবং এই জাতিকে সেটাই মুখ বুঁজে মেনে নিতে হলো। জাতি তওহীদ থেকেই সরে গেল।
বিকৃত ইসলাম শিক্ষা দেওয়ার ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র
আমাদেরকে পদানত করার পর ব্রিটিশরা কিন্তু বসে থাকলো না। তারা জানতো- যাদেরকে পরাজিত করা হয়েছে তাদের অস্তিত্বের ভিত্তিই হলো আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা বলে বিশ্বাস ও স্বীকার করা। সেই হুকুমদাতার আসনটি যেহেতু দখল করে নেওয়া হয়েছে, কাজেই এই জাতি সেটা সহজে মেনে নিবে না, যে কোনো সময় তারা গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারে! ভাত-কাপড়ের জন্য মানুষ জীবন দিবে না, তবে ঈমান বাঁচাতে অবশ্যই জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে পারে। সেই পথটি চিরতরে বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করল ব্রিটিশরা। মুসলিমদেরকে চিরকালের জন্য গোলাম বানিয়ে রাখতে ব্রিটিশরা একটি চক্রান্ত করল। তারা দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করল- একটি সাধারণ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা, আরেকটি মাদ্রাসা শিক্ষা। এই দুটো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে চিন্তা-চেতনায় মৌলিক ব্যবধান ও বৈপরীত্য রয়েছে। এখানেই তারা আমাদের জাতিটিকে মানসিকভাবে ও বাস্তবে বিভক্ত করে দিয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য কী ছিল তা আলিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন অধ্যক্ষ ইয়াকুব শরীফ “আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস” বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, “মুসলমানরা ছিল বীরের জাতি, ইংরেজ বেনিয়ারা ছলে-বলে-কৌশলে তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাদের প্রচলিত ধর্ম, শিক্ষা ও মর্যাদা হরণ করার জন্য পদে পদে যেসব ষড়যন্ত্র আরোপ করেছিল, আলিয়া মাদ্রাসা তারই একটি ফসল। বাহ্যত এই প্রতিষ্ঠানের পত্তন করা হয়েছিল আলাদা জাতি হিসাবে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের নিমিত্তে, যাতে মুসলমানদের ধর্ম, কৃষ্টি ও আদর্শ রক্ষা পায়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়াই ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য।” এই যে ধোঁকাটা দিল, কী সে ধোঁকা? মারটা কোন জায়গায় দিল সেটা বুঝতে হবে। এখন ফলাফল দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমরা কোথায় ধোঁকাটা খেয়েছি।
ব্রিটিশ পণ্ডিতরা অনেক গবেষণা করে একটি বিকৃত ইসলাম তৈরি করল যা থেকে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেতনাকে (জেহাদ) বাদ দেওয়া হলো এবং ব্যক্তিগত জীবনের মাসলা-মাসায়েল, ফতোয়া, দোয়া-কালাম, মিলাদের উর্দু-ফার্সি পদ্য, বিশেষ করে দীনের যে বিষয়গুলো স¤পর্কে পূর্ব থেকেই বিভিন্ন মাজহাবের ফকীহ্দের মধ্যে বহু মতবিরোধ সঞ্চিত ছিল সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করল অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিল যেন সেগুলো নিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষিতরা তর্ক, বাহাস, মারামারিতে লিপ্ত থাকে। সেই ইসলামটিকে জাতির মনে-মগজে গেড়ে দেওয়ার জন্য বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেসটিংস ১৭৮০ সনে ভারতের তদানীন্তন রাজধানী কলকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলো। সেখানে নিজেরা অধ্যক্ষ থেকে পর পর ২৬ জন খ্রিষ্টান (প্রথম খ্রিষ্টান অধ্যক্ষ এ.এইচ. প্রিঙ্গার এম.এ. এবং শেষ খ্রিষ্টান অধ্যক্ষ এ. এইচ. হার্টি এম.এ.) ১৯২৭ সন পর্যন্ত ১৪৬ বছর ধরে মুসলিম জাতিকে সেই বিকৃত ইসলামটি শেখাল। [দেখুন- আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, মূল- আঃ সাত্তার, অনুবাদ- মোস্তফা হারুন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এবং Reports on Islamic Education and Madrasah Education in Bengal by Dr. Sekander Ali Ibrahimy (Islami Foundation Bangladesh)]|
মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসে গণিত, ভূগোল, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষা ইত্যাদির কোনো কিছুই রাখা হলো না। ফলে আলেমরা বাস্তব জীবনে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত হলেন। কিন্তু জীবিকা ছাড়া তো মানুষ চলতে পারে না। অগত্যা তারা ধর্মের বিভিন্ন কাজ করে রুজি-রোজগার করাকেই নিয়তি হিসাবে গ্রহণ করলেন। ব্রিটিশরা এটা এই উদ্দেশ্যে করলো যেন তারা সর্বদা পরনির্ভরশীল হয়ে থাকে এবং মেরুদণ্ড সোজা করে কখনো তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারে। ইংরেজরা তাদের এ পরিকল্পনায় শতভাগ সাফল্য লাভ করলো। সেখান থেকে কোর’আন-হাদীসের জ্ঞান নিয়ে লক্ষ লক্ষ আলেম বেরিয়ে আসছেন কিন্তু তাদেরকে জাতির ঐক্য গঠনের গুরুত্ব, জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রেরণা, সমাজে বিরাজমান অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দেয়া হয়নি। এই ষড়যন্ত্রের পরিণামে তাদের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞানের অহঙ্কার যেমন সৃষ্টি হলো, পাশাপাশি তাদের হৃদয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গতিশীল ভূবন থেকে পিছিয়ে থাকার দরুন একপ্রকার হীনম্মন্যতাও সৃষ্টি হলো। তাদের অন্তর্মুখিতা, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে গোঁড়ামি, বিভক্তি, নিস্পৃহতা, স্বার্থপরতা, ইসলামের নামে অন্ধত্ব, অযৌক্তিক, কুসংস্কার ও অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষের মূল কারণ এই শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াতেই প্রোথিত রয়েছে। শত শত বছর আগের সামাজিক পরিস্থিতিতে উদ্ভূত সমস্যাবলীর সমাধান ঐ সময়ের আলেমরা কীভাবে করেছিলেন সেটা তাদের লেখা ফতোয়ার বইগুলোতে ঠাঁই পেয়েছে। বর্তমানের আমূল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন হাজারো সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু এদের মন-মগজ আটকে গেছে সেই পুরানো ফতোয়ার বইতে। মাদ্রাসাগুলোর সিলেবাসে সেই আদিকালের চর্বিত চর্বনেরই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সময়ের সমাজে যে বাস্তব সমস্যাগুলো বিরাজ করছে সেগুলোর বাস্তব কোনো সমাধান সেখানে নেই। আলিয়া আর কওমী ধারার মধ্যে পার্থক্য এটুকুই যে, একটি সরকারি অর্থায়নে চলে আরেকটি জনগণের দানের টাকায় চলে, কিন্তু উভয়েরই শিক্ষার ফলাফল প্রায় একই।
আজ দুঃখের সাথে বলতে হয়- ব্রিটিশদের চক্রান্ত পুরোপুরি সফল হয়েছে। যতটা হয়তো তারা আশাও করেনি তার চাইতেও বেশি সফল হয়েছে। কারণ, ব্রিটিশরা স্বাধীনতা দিয়ে চলে যাবার ৭০ বছর পরেও আজ আমাদের জীবন চলে তাদের তৈরি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আইন, কানুন, শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে। ব্রিটিশরা এসে প্রথমেই আল্লাহর হুকুম বাদ দিয়ে নিজেদের হুকুম-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল, তাহলে তিনশ’ বছরের গোলামীর শাস্তিভোগের পর যখন এই জাতি মুক্তি পেল, আমাদের কি উচিত ছিল না প্রথমেই ব্রিটিশের হুকুম-ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর দেওয়া দীনকে প্রতিষ্ঠা করা? না, তার প্রয়োজন আমরা বোধ করিনি, কারণ ব্রিটিশরা তিনশ’ বছরে অত্যন্ত চতুরতার সাথে আমাদের মনে-মগজে এমন একটি বিকৃত ইসলাম ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে যেই ইসলামের সাথে আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামের বাহ্যিক কিছু আচার-প্রথাসর্বস্ব মিল থাকলেও আত্মায়-চরিত্রে প্রকৃত ইসলামের ঠিক বিপরীত। আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামে তওহীদ বলতে বোঝাতো জীবনের যে অঙ্গনে আল্লাহ ও রসুলের কোনো বক্তব্য আছে, হুকুম আছে, আদেশ-নিষেধ আছে, সেখানে অন্য কারোটা গ্রহণ না করা, অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নেওয়া। ওই ইসলামে রসুলাল্লাহর সুন্নাহ্ বলতে বোঝাত জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করে মানবতার কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করতে থাকা। অন্যদিকে বিকৃত ইসলামে তওহীদের সাথে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের সম্পর্ক নেই বললেই চলে, আর সুন্নাহর সাথে সংগ্রামের সম্পর্ক তো নেই-ই। প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী তাদের মুখ্য কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন সংগ্রামকে, অন্যদিকে বর্তমানের মু’মিন, মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী দাবিদাররা মুখ্য কর্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছে দাড়ি-টুপি, আরবীয় জোব্বা, ঢিলা-কুলুখ, টাখনু, আরবি মাখরাজ, মাসলা-মাসায়েল ইত্যাদি। হায়রে মুসলিম! হায়রে উম্মতে মোহাম্মদী!
এখন করণীয়
এই অবস্থায় জাতির করণীয় হিসেবে রসুলাল্লাহর সেই আহ্বানটিই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যেটি তিনি সাফা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সমবেত জনতার উদ্দেশে ঘোষণা করেছিলেন, ‘ওহে মানুষ! বলো আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানি না, সফল হয়ে যাবে।’ এই একটি বাণী দিয়েই আল্লাহর রসুল আরবে নয় কেবল, অর্ধেক পৃথিবীকে শান্তির সুশীতল বারিধারায় সিক্ত করেছিলেন। আমরাও যদি বর্তমানের হানাহানি, নৈরাজ্যময় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে চাই, তাহলে তওহীদের এই ঘোষণা দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। আল্লাহ আমাদেরকে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রকৃত মু’মিন, মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী হবার পথে চালিত করুন।