এটা দৃশ্যমান বাস্তবতা যে আমাদের আলেমরা ওয়াজ করছেন, ধর্ম উপদেশ দিচ্ছেন, মসজিদে ইমামতি করছেন, মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন, বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন, গণমাধ্যমে বহু ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। এসব থেকে মনে হচ্ছে যেন দীনের অগ্রগতি সাধনে তাদের অনেক অনেক অবদান। কিন্তু বাস্তবে তাদের কাজের ফলে সমাজে কী ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেটার একটি বিচার করা প্রয়োজন আছে। যে কোনো উদ্যোগেরই সাফল্য আর ব্যর্থতার হিসাব মিলাতে হয়।
আমাদের ইসলামী বিশেষজ্ঞদের বড় ব্যর্থতা হলো ইসলামকে বর্তমান যুগের উপযোগী হিসাবে উপস্থাপন করতে না পারা। তারা হাজার বছর আগের রচনা করা মাসলা মাসায়েল আর ফতোয়াগুলোকে দিয়ে আধুনিক দুনিয়া চালাতে চান। ইসলামকে তারা সর্বাধুনিক বলেন মুখে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্রভেদে এর পরিবর্তনশীলতাকে অস্বীকার করেন এবং ক্ষিপ্ত হয়ে যান।
ইসলামের প্রসঙ্গ উঠলেই তারা প্রাচীন ফিকাহ আর ফতোয়ার কেতাব নিয়ে বসেন। পাঁচশ বছর আগের খোতবা এখনো মসজিদে পড়ে শোনান। এসব ফতোয়ার বিপরীতে যুক্তি, বিবেকের দাবি দূরে থাক কোর’আনকে মানতেও অনেকে নারাজ। আকাশের যত তারা ফতোয়ার তত ধারা। সুতরাং ইসলাম তাদের কুক্ষিগত থাকতে বাধ্য, জনগণ কোনোদিন ইসলাম বুঝতে সক্ষম হোক এটা তারা হতে দেবেন না।
আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে রসুলাল্লাহর (সা.) উপর যে কেতাব নাজিল হয়েছিল সেই কেতাব কোর’আন হচ্ছে এমন কিছু মূলনীতির সংকলন যেগুলো শাশ্বত ও চিরন্তন প্রাকৃতিক নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন কোর’আনে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা বলা হয়েছে। ঐক্য মানেই শক্তি, এ কথাটি লক্ষ বছর আগেও সত্য ছিল, এখনও সত্য। কোর’আনে দীনের মূলনীতিগুলো এমন যেগুলো কেয়ামত পর্যন্তই অপরিবর্তনীয়। এ জন্যই এই দীনের নাম আল্লাহ দিয়েছেন দীনুল কাইয়্যেমাহ অর্থাৎ শ্বাশ্বত ও সনাতন, চিরন্তন ও প্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থা [আল কোর’আন, সুরা বাইয়্যেনাহ ৫] এই সব মূলনীতির পরিবর্তন করলে বিপর্যয় ঘটতে বাধ্য। মানবজীবনে আজ এটাই ঘটেছে, আমাদের সামগ্রিক জীবনে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার মূল কারণ প্রাকৃতিক সত্যগুলোকে অমান্য করে নিজেরা নিজেদের প্রবৃত্তি মোতাবেক জীবনব্যবস্থা তৈরি করা।
কোর’আনের পরিভাষাগুলোকে নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে করতে সেগুলোর মূল তাৎপর্যই এই দীনের পণ্ডিতরা দুর্বোধ্যতার অন্ধকারে হারিয়ে ফেলেছেন, যা এখন সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার বাইরেই চলে গেছে। সেগুলোকে চলমান সময়ের উপযোগী করে, এ যুগের মানুষের চিন্তাধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও যৌক্তিকরূপে উপস্থাপন করতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন বলেই ইসলাম সেই শ্রেণিটির মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে আছে। সাধারণ মানুষ এখন ইসলাম সম্পর্কে কথা বলতে গেলেই বলেন, “আমরা ভাই ইসলাম সম্পর্কে কিছু বুঝি না। ইসলাম খুব কঠিন বিষয়, জটিল বিষয়। এ সম্পর্কে আলেমরাই ভালো জানেন।”
যে কথা বলছিলাম, রসুলাল্লাহ (সা.) সে সময়ের আরবদের জন্য উপযোগী করে, তাদের জীবনের সাথে মিলিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল একটি দীন, ইসলাম শিক্ষা দিয়েছেন। আরবীয়রা আগে থেকে যে পোশাক পরতো রসুল তাদেরকে ভিন্ন কোনো পোশাক পরিধানের নির্দেশ দেন নি। তিনি কেবল অশ্লীলতাকে দূর করে পোশাকের মধ্যে শালীনতা আনয়ন করেছেন। আবার অনারব কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তাকেও আরবীয় পোশাক পরতে বাধ্য করেন নি। কেননা ইসলামে পুরুষের পোশাকের নীতিমালা হচ্ছে সতর ঢাকা আর সেটা হচ্ছে নাভি থেকে হাঁটু অবধি। আপনি যে কোনো পোশাক দিয়ে যদি এটুকু আবৃত রাখেন ইসলাম তাতে কোনো বিধিনিষেধ দেয় না। রসুল নিজেও আরবের পোশাক ও খাদ্যে অভ্যস্ত ছিলেন। এ কথাগুলোই হাদিসে এসেছে।
এখন সমস্যা হচ্ছে আমাদের আলেম সাহেবরা সেই আরবীয় প্রেক্ষাপটকেই ইসলাম বানিয়ে নিয়েছেন। তাদের কাছে আরবি ইসলামের ভাষা, খেজুর খাওয়া সুন্নত, দাড়ি রাখা, আরবীয় পোশাক, চেক রুমাল, পাগড়ি পরা সুন্নত। তারা এটা বুঝতে নারাজ যে, আল্লাহর রসুল অন্য দেশে আসলে তিনি সে দেশের ভাষায়ই কথা বলতেন, সে দেশের খাদ্যই খেতেন। তারা সেই আরবীয় সংস্কৃতিগুলোকে ইসলাম মনে করে সেগুলোকে মুসলিমদের উপর চাপানোর জন্য মরিয়া। কেউ উত্তম মুসলিম হতে গেলে প্রথমেই তাকে দাড়ি, টুপি, লেবাস ইত্যাদির শর্ত পূরণ করতে হবে। শার্ট প্যান্ট টি শার্ট জিন্স ইত্যাদি পরে যেন কোনভাবেই ভালো মুসলিম হওয়া যাবে না, ইসলামের কথা বলা যাবে না। তাদের সবাই যে এমন তা কিন্তু নয়। কিছু কিছু আলেম এই অচলায়তন থেকে বের হতে সক্ষম হয়েছেন। একটি উদাহরণ দিই। হাফেজ মাহমুদুল হাসান তার “ইবাদতের নামে প্রচলিত বিদ’আতসমূহ” গ্রন্থে আরবীয় ধাচের পোশাককে সুন্নতি লেবাস বলাকে গর্হিত অপরাধ বলে রায় দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন: “ইসলামে সুন্নতি পোশাক বলতে বিশেষ ছাঁট বা ডিজাইন এবং বিশেষ সাইজের লম্বা/খাটো জামাকে বুঝানো এবং বোঝা দীনের মধ্যে একটি বেদাত বা সংযোজন। কারণ, ইসলামে পোশাকের ব্যাপারে যে মূলনীতি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তা হলো-
১. লজ্জাস্থানকে আবৃত করে রাখবে।
২. সৌন্দর্যবোধ, ভদ্রতা, শালীনতা, রুচি এবং সুস্থতার পরিচায়ক হবে।
৩. কুরুচিপূর্ণ এবং নির্লজ্জতা প্রকাশকারী হবে না। সাথে সাথে বাহুল্য খরচ, অহংকার ও দম্ভ প্রকাশক হতে পারবে না।
৪. পুরুষদের পোশাক মহিলাদের পোশাকের সাথে আর মহিলাদের পোশাক পুরুষদের পোশাকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারবে না। যে কোনো পোষাকে উপরোক্ত শর্তাবলী বিদ্যমান থাকলে সেটি কোর’আন-হাদিস মোতাবেক পোশাক বলে বিবেচিত হবে।
অতএব, বিশেষ ধরনের পোশাক যেমন- টাখনু পর্যন্ত লম্বা জামা, পায়জামা বা লুঙ্গীর উপর পরিহিত আরবীয় জোব্বা জাতীয় জামাকে সুন্নতি লেবাস বলে চালিয়ে দেয়া একটি বড় বেদাত।
১৪০০ বছরে মানুষের রুচি অভিরুচিতে বিবর্তন সাধিত হবে এটা খুব স্বাভাবিক ও সময়ের বৈশিষ্ট্য। এই পরিবর্তনকে অস্বীকার করে কোনো জীবনব্যবস্থাই টিকে থাকতে পারে না। এই দীর্ঘ সময়ে যোগাযোগব্যবস্থা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে যার মূলে মুসলিম বিজ্ঞানীদেরও অনেক অবদান ছিল। এই যে বিবর্তিত সময় উপস্থিত হয়েছে, এই গতিশীল যুগেও যুক্তি ও ভারসাম্যপূর্ণভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিচারিক ইত্যাদি যাবতীয় সমস্যার সমাধান যে ইসলাম করতে পারে, ইসলাম সারা দুনিয়াকে আরব বানাতে চায় না এইভাবে ইসলামটাকে উপস্থাপন করতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তারা এখনও সেই পুরনো যুগের সমাধানগুলো দিয়ে এ যুগের সমস্যাকে মোকাবেলা করতে উৎসুক। এক হাজার বছর আগের সামাজিক প্রেক্ষাপটে যে সমস্যার যে সমাধান ইমাম গাজ্জালী (রা.) বা ইমাম আবু হানিফারা (রা.) দিয়ে গেছেন সেই ওখান থেকে সরে আসাকে তারা ইসলাম ত্যাগ করার মতো গর্হিত অপরাধ জ্ঞান করেন। তারা এটা বুঝতে অক্ষম যে, আল্লাহর রসুলের হাতে গড়া উম্মতে মোহাম্মদীর পরবর্তী যুগের ফেরকা মাজহাবের আলেম ওলামাদের অতি বিশ্লেষণের ফসল হিসাবে যে জটিল, দুর্বোধ্য ইসলামটি দাঁড়িয়ে গেছে সেটা সেই যুগে হয়তো জোর করে চালানো গেছে, কিন্তু এই যুগে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে বাধ্য।
যুগের সাথে খাপ খাচ্ছে না বলে মানুষ তা গণহারে প্রত্যাখ্যান করছে, তাই প্রয়োজন হয়ে পড়ছে জোর করার – অথচ দীনের মূলনীতির একটি হচ্ছে – দীনের মধ্যে কোনো জবরদস্তি নেই (সুরা বাকারা ২৫৬)। তারা বলছেন নারীদের ঘরে থাকতে হবে, নারী নেতৃত্ব হারাম, ছেলেদের দাড়ি রাখতে হবে, আরবীয় লেবাস পরতে হবে, নাচ-গান-ছবি আঁকা, ভাস্কর্য তৈরি সব হারাম। কোর’আন এগুলোর একটাকেও প্রত্যক্ষভাবে হারাম করে নি, কিন্তু ফতোয়া দিয়ে সবই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমন বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে।
তাদের হাতে থাকা কেতাবি ইসলামটা কতটুকু অন্ধত্ব ও কূপমণ্ডূকতায় আচ্ছন্ন, গোড়ামিতে পূর্ণ, তার চিন্তাচেতনার গতিপ্রকৃতি কী – এর বাস্তব নিদর্শন হচ্ছে জঙ্গিবাদী ইসলাম যাদের কার্যকলাপ বিশ্বজুড়ে প্রবল ইসলামভীতির (Islamophobia) সৃষ্টি করেছে। প্রকৃত ইসলাম তো অন্য জাতিগোষ্ঠীর দ্বারা এমন ঘৃণিত হয় নি? প্রকৃত ইসলাম যে এমন ছিল না, এ সরল কথাটি বোঝার জন্য যে মানবিক হৃদয় লাগে সেটার কবর তারা বহু বছর আগেই রচনা করেছেন। তাদের হৃদয়ে মোহর, চোখে পর্দা, কানে তালা।