হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

তাকওয়ার প্রদর্শনী ও নিষ্ফল আমল

ইলিয়াস আহমেদ:

মুসলমানিত্ব, ঈমানদারী এসব দেখানোর বিষয় না। দাড়ি-টুপি ধারণ করলেই কেউ মুসলিম হয়ে যায় না, মো’মেন হয়ে যায় না, জোব্বা-পাগড়ি পড়লেই পরহেজগার হয়ে যায় না। এসবকে যদি আপনি আখেরি নবীর অনুসারীর চিহ্ন, মুসলিম, মো’মেনের পরিচায়ক হিসেবে মনে করে তাহলে ঘোর ভুলের মধ্যে রয়েছেন। কারণ যদি তাই হতো, তবে হাশরের ময়দানে আল্লাহ পাক পোশাকহীন না উঠিয়ে মুসলিম-মো’মেনদের জোব্বা-পাঞ্জাবি, পাগড়ি-টুপি ইত্যাদিসহ উঠাতেন। এসবে মুসলমানিত্ব নেই, ঈমানদারীত্ব নেই। যদি তারপরেও বলেন এসব ছাড়া ইসলাম হয় না, মুসলমান হওয়া যায় না; তবে বুঝে নিতে হবে আপনি যে ইসলামের লালন করছেন সেটা আরব্য জাতীয়তাবাদে আবদ্ধ, কূপমণ্ডূকতায় আড়ষ্ট।

পোশাকে সৈনিকত্ব নেই, ডাক্তারিত্ব নেই। খাকি রঙের ইউনিফর্ম পড়লেই সৈনিক হয় না, অ্যাপ্রন আর গলায় একটা স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে রাখলেই ডাক্তার হয় না। সৈনিকত্ব, ডাক্তারিত্ব বহু অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জন করে নিতে হয়। তেমনি মুসলমানিত্ব, মো’মেনত্ব এসব আত্মায় ধারণ করতে হয়, নিজের ভিতরে, বিবেকে-চিন্তায়, চরিত্রে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। ইসলাম হচ্ছে প্রকাশমান বিষয়, আর ঈমান হচ্ছে অন্তরের বিষয়। আল্লাহ কারো বাহ্যিক চেহারা, পোশাক আশাক দেখেন না, তিনি দেখেন মানুষের অন্তর ও মানুষের কাজ (আবু হোরায়রা রা. থেকে মুসলিম)। একাধিক হাদিসে পাওয়া যায়, রসুল (সা.) তাঁর হাত দ্বারা বক্ষের দিকে ইশারা করেন তিনবার; এরপর বলেন, “তাকওয়া এখানে”। [আনাস বিন মালিক (রা.) হতে, মুসনাদে আহমেদ (ইফা), ২য় অধ্যায়, হাদিস নং ৯]

কেবলমাত্র ইসলাম প্রকাশ্যমান। ইসলাম মানুষের শরীরে থাকে না, থাকে চরিত্রে। ইসলাম থাকে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে। এই ইসলামের ফলই হলো শান্তি। সত্য, ন্যায়, মানবিকবোধ, নিরাপত্তার অভূতপূর্ব মেলবন্ধনের নাম ইসলাম। সমাজে শান্তি নেই মানে সমাজে ইসলাম নেই, রাষ্ট্রে শান্তি নেই মানে রাষ্ট্রে ইসলাম নেই। দীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার বিষয়; কাগজে লিপিবদ্ধ করে রাখার তত্ত্ব না, কন্ঠে বয়ানে সীমাবদ্ধ রাখার মন্ত্র-কালাম না, আবার কেবলমাত্র বিশ্বাসে গেঁথে রাখারও বিষয় না।

মহানবীর মক্কি জীবনে তখনও ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয় নি। তখন ইসলাম কবুলকারীদের উপর নেমে এসেছিলো অকথ্য নির্যাতন। তাঁরা যখন আর সহ্য করতে পারছিল না, তখন একদিন তাঁদের অন্যতম খাব্বাব (রা.) রসুলাল্লাহর কাছে এলেন। খাব্বাব (রা.) বলেন, আমি একবার নবী করিম (সা.) এর খেদমতে হাযির হলাম। তখন তিনি তাঁর নিজের চাদরকে বালিশ বানিয়ে কা’বা গৃহের ছায়ায় বিশ্রাম করছিলেন। যেহেতু আমরা মুশরিকদের পক্ষ থেকে কঠিন নির্যাতন ভোগ করছিলাম, তাই আমি বললাম, আপনি কি আমাদের (শান্তি ও নিরাপত্তার) জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন না? তখন তিনি উঠে বসলেন এবং তাঁর চেহারা রক্তিম বর্ণ হয়ে গেল। তখন তিনি বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী ঈমানদারদের মধ্যে কারো কারো শরীরের হাড় পর্যন্ত সমস্ত মাংস ও শিরা উপশিরাগুলো লোহার চিরুনী দিয়ে আঁচড়ে পৃথক করে ফেলা হত। কিন্তু এসব নির্যাতনও তাদেরকে দীন থেকে বিমুখ করতে পারত না। তাঁদের মধ্যে কারো মাথার মধ্যবর্তী স্থানে করাত স্থাপন করে তাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা হত। কিন্তু এ নির্যাতনও তাঁদেরকে তাদের দীন থেকে ফিরাতে পারত না। আল্লাহর কসম, আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই দীনকে পরিপূর্ণ করবেন, ফলে একজন উষ্ট্রারোহী সান’আ শহর থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সে ভয় করবে না। রাবী (র.) অতিরিক্ত বর্ণনা করেন এবং তার মেষ পালের উপর নেকড়ে বাঘের আক্রমণে সে ভয় করবে না। [সহীহ বুখারি (ইফা), ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদিস নং ৩৫৭৩]

হ্যাঁ, ইসলামের মূল উদ্দেশ্যই এটা। মানুষের সামাজিক, আর্থিক, রাষ্ট্রীয়সহ সকল ধরনের নিরাপত্তা প্রদান করা; সত্য ও ন্যায় সুপ্রতিষ্ঠিত করা। এককথায় পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করার আরেক নাম ইসলাম। আমরা ইতিহাসে দেখেছি, পরবর্তীতে এই ইসলামের মাধ্যমে সমস্ত আরবে কী পরিমাণ শান্তি, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। একজন সুন্দরী সালঙ্কারা নারী একাকী রাতের আঁধারে মাইলে পর মাইল পাড়ি দিত, কিন্তু তার মনে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ভয় থাকতো না। আর্থিক অবস্থার এতটাই উন্নতি হয়েছিলো যে, শহর-উপশহর, মরুভূমি চষে বেড়িয়েও দান গ্রহণের জন্য এমন একজনকেও পাওয়া যেত না। মাসের পর মাস আদালত আলস্যে দিন কাটাতেন বিচারকগণ।

কোথায় সেই ইসলাম? কোথায় সেই নিরাপত্তা? আজ কোথায় সেই শান্তি? বাস্তবের কাছে সবই যেন আজ দুঃস্বপ্ন। কারণ, আমরা রসুল (সা.) ও তাঁর আসহাবদের কাছ থেকে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করার পরিবর্তে গ্রহণ করেছি তাঁদের যুগের আরবীয় লেবাস, সুরত। বিষ ভর্তি রসগোল্লা খেলে যা হয়, তাই হয়েছে আমাদের। হ্যাঁ, আমরা মরেই গিয়েছি, মৃতজাতি। না হলে কী করে আমরা বাস্তব ও পার্থিব জীবনের শান্তিটাকে বিসর্জন দিয়ে, মানবজাতির দুঃখ দুর্দশা দেখেও না দেখে স্বার্থপরের মতো পরকালীন সুখের জন্য নিজেকে আবদ্ধ করেছি ফজিলত ও সওয়াবের নানাবিধ ব্যক্তিগত আমলে! আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই সালাহ যাবতীয় অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে তোমাদের বিরত রাখে (সুরা আনকাবুত ৪৫)। তাহলে সালাতের ফল কী সেটা বোঝা গেল, কিন্তু আমাদের সমাজে লক্ষ লক্ষ মসজিদে কোটি কোটি মুসল্লির নামাজের ফল কী হলো সেটা বোঝা গেল না। সবচেয়ে বেশি যারা নামাজ পড়ছে অর্থাৎ মাদ্রাসা ও মসজিদের বাসিন্দারা, তাদের মধ্যে শিশুকামিতা, ধর্ষণ, বলাৎকার ইত্যাদি বহুবিধ অশ্লীলতার চর্চা প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে পড়ে।

সুতরাং যে নামায সমাজের অন্যায়, অবিচার, অশ্লীলতা দূর করতে পারে না, সেটা নামাযই না। যে নামাযে গরিব-দুঃখী, এতিম-মিসকীনদের পাশে দাঁড়ানোর কথা তিলাওয়াত করা হয়, যে নামাজে সত্য, ন্যায়, সুবিচারের কথা তিলাওয়াত করা হয় আর সেই নামাযকেই আমরা অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের পূজা-প্রার্থনার মতো নির্জীব, প্রাণহীন উপাসনায় পরিণত করেছি। মূর্তির কাছে প্রার্থনায় যেমন কোনো ফলাফল নেই, আমরাও নামায থেকে কোনো ফলাফলে আশাবাদী না, বিশ্বাসী না। তেমনি রোজা-কুরবানি দেয়া হয়েছে তাকওয়াভিত্তিক চরিত্র তৈরির জন্য (সুরা বাকারাহ ১৮৩, সুরা হজ ৩৭), ওগুলো পালন করে জান্নাত যাবার জন্য না। এই তাকওয়াভিত্তিক চরিত্রের উদ্দেশ্য সমাজে-রাষ্ট্রে সর্বত্র শান্তি, ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। এখনতো আমাদের রোজা-কুরবানিতে তাকওয়া অর্জন হয় না, হয় পার্থিব সম্মান অর্জন। এসব উৎসব-আড়ম্বরে পরিণত হয়েছে আমাদের কাছে, সামাজিক মান-মর্যাদার, প্রদর্শনেচ্ছা, প্রতিযোগতার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি তাকওয়া অর্জনই করতে পারতাম তবে সমাজে-রাষ্ট্রে এতো অন্যায়, হানাহানি, রক্তপাত থাকার কথা ছিলো না; এতো অশান্তি থাকার কথা ছিলো না। কারণ আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এই বলে, “জনপদের অধিবাসীগণ যদি ঈমান আনতো এবং তাকওয়া অবলম্বন করতো, তবে আমি তাদের জন্যে আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দ্বার খুলে দিতাম।” (সুরা আরাফ ৯৬)।

আজ কোথায় আল্লাহর রহমত, কোথায় বরকত? আকাশে-বাতাসে বোমা-বারুদের গন্ধ, পারদ-সীসার বিষবাষ্প; মুসলিমদের ভূখণ্ডগুলো আবালবৃদ্ধবণিতার রক্তে সিক্ত; ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, আরাকান, উইঘুর, জিংজিয়াং, কাশ্মির, লেবানন, ইয়ামেনসহ বহু দেশের নদী-সাগরের পানি আজও রক্তমিশ্রিত ও পঁচা লাশে বিষাক্ত। কামান-শেলে ঝলসে যাচ্ছে ভূখণ্ডগুলো, রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগে কিংবা ক্ষুধার যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে মানুষ। আমাদেরই অসাবধানতায়, কূপমণ্ডূকতায়, অজ্ঞানতায়, উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপনের কারণে মানবতার মহাশত্রু দাজ্জাল (কথিত পশ্চিমা সভ্যতা) মহা ধ্বংসযজ্ঞের আয়োজন করেছে। সময় খুব কম, যদি সত্যটা না বুঝি, প্রস্তুত থাকতে হবে আত্মাহুতির মাধ্যমে তার অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...