‘কদর’ মানে হচ্ছে মাহাত্ম্য ও সম্মান। মূলত কয়েকটি হাদিসের উপর ভিত্তি করে শবে-ই কদর পালন করা হয়। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে রমজান মাস একটি গুরুক্তপূর্ণ মাস হিসেবে পালন করা হয়। আল্লাহ সুরা আল-কদরে বলেছেন, “আমি এই কোর’আন কদরের মহিমান্বিত রাতে নাযিল করেছি।”
আল্লাহ এই কোর’আনের মাধ্যমে মানবজাতির জন্য মুক্তির দিশা দিলেন, হেদায়াতের বাণী দিলেন। এই রাত্রি মহিমান্বিত এই জন্য যে, এই রাতে ওহীর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে মানবজাতির সংযোগ স্থাপন হয়েছে। আসমানের সাথে জমিনের সংযোগ শত শত বছর বিচ্ছিন্ন ছিল। মানুষ চলছিল তার নিজের মর্জিমত। এই রাতে আরশ থেকে জিব্রাঈল আবার একজন রসুলের কাছে বাণী নিয়ে এসেছেন। কাজেই এর মাহাত্ম্য, তাৎপর্য, গুরুত্ব, মর্যাদা, মরতবা, দরজা অনেক অনেক ঊর্ধ্বে। এই মাসকে, এই রজনীকে অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ জ্ঞান করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য।
আল্লাহ বলেছেন, “এই ‘লায়লাতুল কদর’ সম্পর্কে তুমি কী জান?” এই মহিমান্বিত রজনী হাজার হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কারণ এই রজনীতে মালায়েক এবং রুহ অবতীর্ণ হয়। এখানে রুহ বলতে আল্লাহর আদেশকে বুঝানো হয়েছে। এরপর আল্লাহ বললেন, এটা সালাম অর্থাৎ শান্তি ও নিরাপত্তার বার্তা। মানবজাতির উদ্দেশে শান্তির বার্তা, আগমনি বার্তা। মানুষ শান্তির পথ খুঁজছিল, শান্তির পথ কামনা করছিল। কিন্তু তারা আল্লাহর হুকুমের কিছু মানতো এবং কিছু মানতো না। ফলে তাদের সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা ছিল না। আল্লাহ এই রজনীতে কোর’আন নাজিল করে আল্লাহর হুকুম নাজিল করতে শুরু করলেন যা পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার সংবিধান। এর মাধ্যমেই সমগ্র মানবজাতির জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোর’আন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথনির্দেশ, আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে (সুরা বাকারা ১৮৫)।
তাহলে বোঝা গেল যে রমজান মাসটি গুরুত্বপূর্ণ শুধু এ কারণেই যে এই মাসে কোর’আন নাজিল হয়েছিল। এই কোর’আন হচ্ছে ন্যায়-অন্যায়ের সুস্পষ্ট পার্থক্য বিধানকারী কেতাব। কিন্তু আমাদের আজ মুসলিম জাতির দূর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, যে কোর’আনের জন্য রমজানের এই রাতের এত বড় মাহাত্ম্য, আজ মানুষ সওম বা রোজা ঠিকই রাখে কিন্তু কোর’আনের হুকুম মানে না, কোর’আনের বলে দেওয়া ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড মোতাবেক জীবন পরিচালনা করে না। তারা লাইলাতুল কদরে সারা রাত ধরে ওয়াজ, জিকির করে কিন্তু জাতিগত জীবনে আল্লাহর হুকুম মানে না।
এই রাতটি নিঃসন্দেহে মোমেনদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এই রাতের মাহাত্ম্য অনুধাবন করে রাতটি নফল সালাহ কায়েম, কোর’আন পাঠ ইত্যাদি উপায়ে আল্লাহর স্মরণে অতিবাহিত করার জন্য আল্লাহর রসুল নির্দেশনা দিয়েছেন। ইবনে মাজাহ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হযরত রসুল (সা.) বলেন, যে লোক শবে কদর থেকে বঞ্চিত হয় সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে পরিপূর্ণ বঞ্চিত হল।
আবু দাউদ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেলো কিন্তু ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে কাটাতে পারলো না, তার মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই। কদরের রাতের ইবাদতের সুযোগ যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায় সেজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশদিনের পুরো সময়টাতে ইতেকাফরত থাকতেন। (মুসলিম, হাদিস নং : ১১৬৭)।
কিন্তু এই রাতের মূল তাৎপর্য যেহেতু কোর’আন নাজিল, তাই সেই কোর’আনের হুকুম-বিধান জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা না করে যত নফল আমল, জিকির আজকার করা হোক, কোর’আন পাঠ করা হোক তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না। কোর’আন মানব সমাজে যে শান্তি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেই শান্তি আজ কোথাও নেই। সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি, ঘরে-বাইরে, মানুষের মনে কোথাও সেই শান্তি নেই। ধর্মের নামে কেবল আনুষ্ঠানিকতা করা হচ্ছে, উপাসনা করা হচ্ছে। কিন্তু এগুলো দিয়ে তো শান্তি আসবে না। এই উপাসনা দিয়ে একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি কিছু প্রশান্তি লাভ করতে পারে বটে, কিন্তু এটা মানব সমাজে শান্তি আনতে পারে না। এর তাৎপর্য বুঝতে হলে আবারও মানুষকে আল্লাহর হুকুমের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।