নারী এবং পুরুষ মিলেই পরিবার এবং সমাজ পরিপূর্ণতা লাভ করে। নারীকে সমাজের মূলধারা থেকে দূরে সরিয়ে রাখলে সামাজিক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার নারীর জন্য প্রাকৃতিকভাবে যে ভূমিকা রয়েছে নারীকে সে জায়গা থেকে সরিয়ে আনলে ও সমাজে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। পাশ্চাত্যে নারী স্বাধীনতার নামে বিবাহ ও সন্তান ধারণে নারীর মধ্যে নেতিবাচক মনোভাবের কারণে সেখানে আজ জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। ইসলাম নারীকে সমাজের মূলধারায় ভূমিকা পালনের সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি নারীকে তার সন্তান ধারন ও সন্তান পালনের মৌলিক দায়িত্ব থেকে আলাদা করতে চায় না। এক্ষেত্রে ইসলাম মনে করে নারী পুরুষের সম্পর্ক হবে অবদমন বা প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক নয়, সহমর্মিতা ও সহযোগিতামূলক। শিক্ষা, পরিবার, সমাজ, অর্থনীতি ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ইসলাম নারীর অধিকারকে স্বীকার করে এবং তাকে যথাযথ ভূমিকা পালনের সুযোগ দিতে চায়।
সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পুরুষ যেরূপ আল্লাহর দায়িত্ববান খলিফা বা প্রতিনিধি তেমনভাবে নারীও নিজ অবস্থান থেকে আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আমি দুনিয়ার বুকে আমার খলিফা বা প্রতিনিধি প্রেরণ করতে চাই” (সুরা বাকারা, ৩০)। নারীর পোশাক বা হিজাব হবে খলিফা হিসেবে তার সামাজিক ভূমিকা পালনের সহায়ক বা উপযোগী। পর্দা একটি ফার্সি শব্দ এর অর্থ হলো আড়াল বা আচ্ছাদন। আরবীতে একে হিজাব বলা হয়েছে (সুরা আহযাব, ৫৩)। ইংরেজিতে একে বলা হয় Curtain। হিজাব বা পর্দা প্রচলিতভাবে যতোটা না পোশাক অর্থে ব্যবহৃত হয় তার চেয়ে বেশী নারীকে সামাজিক ভূমিকা থেকে বা পুরুষের দৃষ্টিজগত থেকে আড়াল বা দূরে সরিয়ে রাখা অর্থে ব্যবহৃত হয়। নারী পুরুষের সামনে আসবে না, সে গৃহ অভ্যন্তরে থাকবে, তার শরীর আপাদমস্তক ঢেকে চলতে হবে, শিক্ষা ক্ষেত্রে সহশিক্ষা থাকবে না, নারীরা ঘরের বাইরে কাজ করবে না, মসজিদে যাবে না, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গেলেও নারী ও পুরুষের অবস্থানের মাঝখানে কাপড় বা অন্য কোনোভাবে আড়াল থাকা অর্থে পর্দা শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
ইসলামে পোশাক অর্থে লেবাস শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লেবাস আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হলো নারী পুরুষের শরীর আচ্ছাদন করার কাপড়ের তৈরি পোশাক। কোর’আনে এ লেবাস শব্দটি পোশাক অর্থে ব্যবহৃত হলেও ইদানীং লেবাস শব্দের চেয়ে হিজাব শব্দটি সামনে এসে গেছে। একে নারীর মুখ ঢেকে রাখা অর্থেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। পারিভাষিক অর্থে লেবাস হলো – নারী পুরুষের সামাজিক ভূমিকা পালনের উপযোগী পোশাক। লেবাস শব্দটি সৌন্দর্য অর্থেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কোর’আনে নারী-পুরষ একে অন্যকে পরস্পরের লেবাস বা পোশাক বলা হয়েছে (সুরা বাকারা, ১৮৭)। এখানে দাম্পত্য জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও অর্থনীতিতে নারী পুরুষের ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থানকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
নারীর লেবাস বা পোশাক হিসেবে ইসলামে কোনো নির্ধারিত পোশাকের (Dress code) নির্দেশ দেয়া হয় নাই। সকল নারীর জন্য এক ধরনের পোশাক নির্ধারণ করা জলবায়ু বা প্রাকৃতিক কারণেও বাস্তবসম্মত নয়। নিজ নিজ দেশ বা অঞ্চলের তাপমাত্রা অনুযায়ী পোশাক হবে। আবার একই দেশে শীত ও গ্রীষ্মের পোশাক আলাদা হওয়ার সঙ্গত কারণে আছে। সকল দেশে ঘরের পোশাক এবং ঘরের বাইরের পোশাক পুরুষ ও মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রে পৃথক হতে দেখা যায়।
ইসলামে নারীদের ঘরের বাইরে পোশাকের ক্ষেত্রে কিছু মূল নীতি দিয়েছে। এ মূলনীতিগুলোর আলোকে নারীর পোশাক নির্ধারিত হবে। আল্লাহ নারীর পোশাকের মূলনীতিগুলো দেয়ার আগে পুরুষদের নারীর প্রতি দৃষ্টি অবনত রাখার নির্দেশ দিয়ে সামাজিক সৌন্দর্য ও পবিত্র। রক্ষার ক্ষেত্রে পুরুষের অগ্রগণ্য ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কারণ সমাজকে নারী সংক্রান্ত অপরাধ মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে পুরুষের সামাজিক আচরণকে শৃংখলায় আনা অপরিহার্য কর্তব্য। “মো’মেন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয়ই তারা যা করে সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত” (সুরা নূর, ৩০)।
ইসলামে নবীর সম্মানিতা স্ত্রীগণ এবং সাধারণ মো’মেন নারীগণের জন্য পোশাকসহ সামাজিক বিধান এক নয়। নবীর স্ত্রীগণের স্বাভাবিক অবস্থায় দৈনন্দিন জীবনে পুরুষের সামনে বা ঘরের বাইরে যখন তখন চলাফেরাকে সীমিত (Restricted) করা হয়েছে। ঘরের বাইরে যাওয়া সীমিতকরণের নির্দেশ সাধারণ মো’মেন নারীগণের জন্য নয়। ইসলামে নারীর ভূমিকা ও পোশাকের নীতিমালার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি স্মরণ রাখা প্রণিধানযোগ্য। নবী পত্নীগণের জন্য বিশেষ নির্দেশগুলো হলো,
“হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, এতে করে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে।”
“তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে- পূর্ববর্তী জাহেলিয়াতের যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। সালাত কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ। আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে” (সুরা আহযাব, ৩২ ও ৩৩)।
ইসলামে নারীর পোশাকের নীতিমালা কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ বলে দিয়েছেন-
“হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রী, কন্যা ও বিশ্বাসী নারীদের বলো, তারা যেন (জনসমক্ষে) তাদের চাদরের কিছু নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদের চিনতে সুবিধা হবে এবং কেউ তাদের উক্ত্যক্ত করবে না। আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরমদয়ালু (সুরা আহযাব ৫৯)”।
“ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের গোপন অঙ্গের হেফাযত করে। সাধারণত যে অংশগুলো প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপনঅঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেনো তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মো’মেনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও (সুরা নূর ৩১)।
সুরা বাকারার ৩০, সুরা আহযাবের ৫৯ এবং সুরা নূরের ৩০ ও ৩১ নং আয়াত থেকে নারীর পোশাক সংক্রান্ত নীতিমালাগুলো পাওয়া যায়, তা নিম্নরূপ-
১) নারীর সূচিতা-পবিত্রতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নারীর পোশাক ও আচরণের পাশাপাশি পুরুষের ভূমিকাও রয়েছে। পুরুষের নারীর প্রতি সূচিতা বা সম্মানের দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে এবং নারীর প্রতি তার দৃষ্টি অবনত অর্থাৎ সংযত রাখতে হবে।
২) ঘরের বাইরে বের হলে নারী তার শরীরের উপর অস্বচ্ছ চাদরের (জিলবাব) কিয়দাংশ টেনে রাখবে।
৩) ঘরের বাইরে বের হওয়ার সময় যে পোশাক পরিধান করবে তাতে পোশাক দিয়ে নারীর পরিচয় গোপন করা যাবে না বরং তাকে দেখলে চেনা যায় এমনভাবে পোশাক পরতে হবে।
৪) এমন শালীন পোশাক পরিধান করবে যাতে নারীকে পোশাকের কারণে উত্যক্ত করার মানসিকতা কোনো পুরুষের মধ্যে জাগ্রত না হয়।
৫) চোখের দৃষ্টি, নাকের শ্বাসপ্রশ্বাস, মুখে কথা বলা, পানাহার কানে শুনা এবং হাত দিয়ে কোনো জিনিস ধরার জন্য বা হাঁটাচালার জন্য স্বাভাবিকভাবে খোলা রাখা দরকার শরীরের এমন অংশ (মুখমণ্ডল, হাত ও পায়ের প্রয়োজনীয় অংশ) পোশাক বা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা আওতার বাইরে রাখতে হবে।
৬) নারী তার বক্ষদেশ একটি অতিরিক্ত কাপড় বা ওড়না দ্বারা এবং এমনভাবে চলাফেরা করবে যাতে পোশাক পরার পরও তার গোপন সৌন্দর্য প্রকাশিত না হয়।
৭) আল্লাহর খলিফা হিসেবে নারী দাম্পত্য জীবন, সন্তান ধারন, সন্তান পালনে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় অংশগ্রহণ করবে। নারী হিসেবে তার সন্তান ধারণ ও পালনের ভূমিকাকে অবহলা করা যাবে না। মা হিসেবে নারী জাতি হবেন সম্মানের জন্মগত অধিকারী।
৮) নারী মসজিদে, ঈদগাহে অংশগ্রহণ করতে পারবেন এবং উপযুক্ত শিক্ষাগ্রহণ ও তার উপযোগী কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে কোনো বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। তিনি আয় করতে, ব্যয় করতে এবং নিজের সম্পদ ও সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা করতে পারবেন।
ইসলাম একটি স্বভাবগত জীবনব্যবস্থা এ জন্য ইসলামকে দীনুল ফিতরাত বা মানুষের স্বভাবগত আচরণ ব্যবস্থাপনার জীবনব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে। নারীর শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং প্রাকৃতিক দায়িত্ব স্বীকার করার পাশাপাশি ইসলাম নারীর সকল মানবাধিকার স্বীকার করে নিয়েছে। অন্যদিকে তার আত্মসম্মানবোধকে মেনে নিয়ে তার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকার ক্ষেত্র তৈরি করাকে ইসলাম অপরিহার্যভাবে মেনে নিয়েছে। নারী হিসেবে তার প্রাকৃতিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তার উপর উপার্জনের অর্থনৈতিক ও নানাবিধ সামাজিক দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া নারীর প্রতি কখনো ন্যায়সঙ্গত আচরণ হতে পারে না। তবে প্রয়োজন পড়লে সেটা করারও অধিকার নারী রয়েছে। অথচ ইহুদি-খ্রিষ্টান বস্তুবাদী যান্ত্রিক সভ্যতা নারী ও পুরুষ উভয়কে একে অপরের সঙ্গে উপার্জনের প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছে। এখানেই এই বস্তুবাদী সভ্যতার পরাজয়।
নারীপুরুষের সহাবস্থান, পারস্পরিক সম্মান ও ভারসাম্যমূলক ভূমিকার সৌন্দর্যের দিক থেকে ইসলাম অনন্য এবং অগ্রগণ্য।