মুসলমান জাতিকে কয়েকটি মৌলিক বিষয় নিয়ে এখন ভাবতেই হবে।
- যে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, সামরিক শক্তি, শিল্পকলা, সাহিত্য, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে এক কথায় সর্ববিষয়ে পৃথিবীর অপরাপর জাতির শিক্ষকের আসনে আসীন হয়েছিল, যারা যুক্তি ও জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল তারা আজ কী করে যুক্তিহীনতা, বুদ্ধিহীনতার, স্থবিরতার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হলো?
- আরবের আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অবিচারের ধারাকে উল্টে দিয়ে সেখানে অকল্পনীয় শান্তি, ন্যায়, সুবিচার ও মানবতা প্রতিষ্ঠা করেছিল। যুদ্ধাপরাধ ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে বনু কোরাইজাকে রসুলাল্লাহ (স.) সরাসরি হত্যা করতে পারতেন, কিন্তু তা না করে তিনি তাদের পছন্দমতো বিচারক নিয়োগ করে, তাদের পছন্দনীয় বিধানের দ্বারা দণ্ড প্রদান করেছিলেন। সেই মুসলিম জাতির একটি অংশ আজ কীভাবে ফতোয়া দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে?
- মুসলিমদের মধ্যে আলাদা একটি পুরোহিত শ্রেণি থাকবে যাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনেতিক অঙ্গনে কোনো কতৃত্বই থাকবে না, তারা যাবতীয় ধর্মীয় কাজ করে দেবে এবং সমগ্র জনগোষ্ঠী ধর্মের বিষয়ে তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে, তারা দ্বীনের ন্যূনতম জ্ঞানও রাখবে না – এমন ব্যবস্থা কীভাবে সৃষ্টি হলো?
- উম্মতে মোহাম্মদী জাতির মধ্যে এমন কোনো শ্রেণি ছিল কিনা যারা দেশ-জাতি ধ্বংস হয়ে গেলেও তা নিয়ে সামান্যতম চিন্তা না করে পীর-বুজুর্গ হয়ে কোটি কোটি মুরিদানকে আলিশান দরবার শরীফে বসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের তরিকা শিক্ষা দিয়ে তাদের থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে বিপুল আরাম আয়েশে জিন্দেগী পার করেছেন ?
- মসজিদ ছিল সামাজিক সামষ্টিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, বিচারালয়, সমস্ত সমস্যার সমাধানকেন্দ্র। এখন দুনিয়ার সব মসজিদ নিষ্প্রাণ, ঘুমন্ত। আর সেখান থেকে মাঝে মধ্যে মাইকে ঘোষণা দিয়ে দাঙ্গা সৃষ্টির জন্য মানুষকে উন্মত্ত করে তোলা হচ্ছে। এই বিপরীত অবস্থা কীভাবে সৃষ্টি হলো?
- প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ওয়াজকারী কোটি কোটি মুসলমানকে ওয়াজ করে শোনান। রেডিও, টেলিভিশনে ইসলামী বিশেষজ্ঞ-চিন্তাবিদ-ওলামায়ে কেরামদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা বক্ চলছে, সেখানে তারা ইসলামকে সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বীন বলে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করেই চলেছেন, গোনাহ না করার জন্য নসিহত করেই চলেছেন। কিন্তু এর দ্বারা সমাজে অশ্লীলতা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, মাদকাসক্তি, সুদ, ঘুষ, রাহাজানি ইত্যাদি একটি অপরাধও কি কিছুমাত্র কমেছে? না। বরং পঞ্চাশ বছর আগের সঙ্গে বর্তমানের অবস্থার তুলনা করলে দেখা যাবে প্রতিটি সামাজিক অপরাধ শত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে উপদেশ ফলপ্রসূ হচ্ছে না কেন?
- বিশ্বের সমস্ত পরাশক্তিগুলো নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে, জোট-মহাজোট গঠন করে বিশ্বের সমস্ত সামরিক শক্তি, মিডিয়া এবং অর্থের পাহাড়ে বসে থেকে বাকি দুনিয়ার উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে। আর তাদের মিডিয়ার একচ্ছত্র প্রচারে সারা দুনিয়ায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাচ্ছে। বিপরীতক্রমে এই জাতি নিজেরা হাজারো ফেরকা, মাজহাব, দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে মারামারি করছে, তাদের উপর চলমান অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না কেন?
- বিশ্বে এখন সাংঘাতিক রকমের আদর্শের সঙ্কট, সভ্যতার সংকট (Clash of civilization) চলছে। একদিকে পশ্চিমা ধর্মহীন বস্তুবাদী সভ্যতা শত শত বছর থেকে শাসন ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, মিডিয়া ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে ধর্মকে বিদায় করতে, কিন্তু পারছে না। তাই তারা ধর্মকে ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্কীর্ণ পরিসরে আবদ্ধ করে রেখেছে। ঐ সঙ্কীর্ণ গুহা থেকে মাথা তুলতে গেলেই তার মস্তক গুড়িয়ে দেয়। কিন্তু ধর্ম সেখানে বন্দী না থেকে বার বার সামষ্টিক জীবনে বিপর্যয় টেনে আনছে, বিশ্বকে করছে যুদ্ধক্ষেত্র। এই সমস্যার মোকাবেলা কীভাবে করা যাবে?
- এদিকে মুসলিম নামক এই জাতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের লক্ষ্যহীন, সঠিক আকিদাহীন, শক্তিহীন, গন্তব্যহীন, প্রতিপক্ষের তুলনায় সর্বদিকে নগণ্য। এদের মধ্যে একটি শ্রেণি মরিয়া হয়ে এখানে ওখানে হামলা চালাচ্ছে এবং নিজ জাতিরই ক্ষতি সাধন করে নিজ জাতির কাছেই ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এদের শাসকরা জনবিচ্ছিন্ন, জনপ্রিয়তাহীন। সাধারণ জনগণ হতাশ হয়ে অপেক্ষা করছে মাহদী (আ.) আর ঈসার (আ.) আগমনের জন্য। যার পয়সা আছে তিনি এলাকার মসজিদে মাদ্রাসায় দান করেন, মক্কায় গিয়ে হজ্ব করে জান্নাতের টিকিট কিনে বসে আছেন। তরুণরা আসক্ত হয়ে আছে ব্যক্তিগত ফুর্তিবাজি, অশ্লীলতা, মাদকদ্রব্য আর নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে। তাদের রয়েছে আত্মপরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি, অতীত গৌরব নিয়ে অজ্ঞতা, হুজুগপ্রবণতা, জাতির প্রতি দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। এর সমাধান কী?
এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য জাতিকে নিবিষ্টমনে কয়েকটি বিষয় নিয়ে ভাবতেই হবে।
- একটি জাতির সংজ্ঞা মোতাবেক তারা আসলে জাতি কিনা এবং আল্লাহর কেতাব না মানা সত্ত্বেও তারা মুসলিম থাকেন কিনা?
- নবী করিম (স.) এর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করার কারণে তারা উম্মতে মোহাম্মদী থাকেন কিনা?
- তারা বর্তমান অবস্থায় তাদের চির আকাঙ্ক্ষিত জান্নাতের উপযুক্ত কিনা?