১৯৬৩ সনে হেযবুত তওহীদ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মাননীয় এমামুযযামান টাঙ্গাইল-বাসাইল নির্বাচনী আসনে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য পদের জন্য স্বতন্ত্র পদপ্রার্থী হন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা অনেকেই চেয়েছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ মওলানা ভাসানীকে দিয়ে নিজ দলীয় প্রার্থীর ক্যাম্পেইন করাতে, কিন্তু মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘সেলিমের (এমামুযযামানের ডাক নাম) বিপক্ষে আমি ভোট চাইতে পারব না, চাইলেও লাভ হবে না। কারণ তাঁর বিপক্ষে তোমরা কেউ জিততে পারবে না।’
বাস্তবেও তা-ই হয়েছিল। তিনি আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগের প্রার্থীগণসহ বিপক্ষীয় মোট ছয়জন প্রার্থীকে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত করে এম.পি. নির্বাচিত হন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সকল প্রার্থীই এত কম ভোট পান যে সকলেরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য থাকা অবস্থায় তিনি ‘কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এ্যাসোসিয়েশন’ এর সদস্যপদ লাভ করেন। এছাড়াও তিনি আরও যে সংসদীয় উপকমিটিগুলির সদস্য ছিলেন তার মধ্যে স্ট্যান্ডিং কমিটি অন পাবলিক-একাউন্ট, কমিটি অফ রুল এ্যান্ড প্রসিডিউর, কমিটি অন কনডাক্ট অফ মেম্বারস, সিলেক্ট কমিটি অন হুইপিং বিল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এম.পি. নির্বাচিত হওয়ার দেড় বছর পর তাঁর নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দাদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখেন যা তিনি লিফলেট আকারে মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। এই চিঠিতে তিনি এ অল্প সময়ে নিজ এলাকায় কী পরিমাণ উন্নয়ন ও সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড করেছিলেন তার আংশিক বিবরণ তুলে ধরেন।
এটি লেখার পেছনে যে প্রেরণাটি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে সেটা হচ্ছে ভোটারদের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা, তিনি তাদের সঙ্গে যে প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ সেই প্রতিশ্রুতি তিনি কতটা পূরণ করতে পারলেন আর কতটা পারলেন না, সেই ব্যাপারে প্রতিটি ভোটার যেন সুস্পষ্ট ও সত্য ধারণা পায় এটাই ছিল তাঁর চাওয়া। তাঁর এম.পি. জীবনের সেই স্মৃতিচিহ্ন আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মানসিকতা, সত্যনিষ্ঠা, জনসংযোগ, ওয়াদাপূরণ, দায়বদ্ধতা কেমন থাকা উচিত তা এই লেখাটুকু থেকে বুঝতে পারা যায়।
মির্জাপুর ও নাগরপুরের আমার প্রিয় ভাইয়েরা।
সালাম/আদাব,
দেড় বৎসর টাঙ্গাইল ও বাশাইল থানার জনগণের খেদমত করার পর এবার আমি আপনাদের এলাকা থেকে প্রাদেশিক আইন পরিষদ নির্বাচন প্রার্থী। কলিকাতার ইসলামিয়া কলেজে ছাত্র-জীবন থেকেই আমার রাজনীতি ও সমাজ সেবা শুরু হয় সে আজ ২০/২২ বৎসর আগের কথা। সমাজ সেবার কোন সুযোগ আমি ছেড়ে দেই নি। তাই আমাকে জনসাধারণ সবসময় দুঃখ দুর্দ্দশায় তাদের পাশে পেয়েছে। গত সর্বগ্রাসী বন্যার সময় আমি ঢাকার বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাপড় চোপড় ভিক্ষা করে এনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে বিতরণ করেছি। বন্যার পর যখন মহামারীর আশংকা দেখা দিল তখন আমেরিকানদের কাছ থেকে ঔষধ পত্র চেয়ে নিয়ে এসে গ্রামে গ্রামে, বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে কলেরা টাইফয়েডের ইনজেকশন দিয়েছি। আমার নিজের হাতে ইনজেকশনের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি এবং একদিনে প্রায় সাড়ে তিনশত। গত দুঃখজনক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় দিনরাত আপ্রাণ চেষ্টা করেছি যাতে মানুষ পশুত্বকে দমন করে মানুষের মর্যাদা পায়। তারপর জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে গত দেড় বছরে আল্লাহ আমাকে যে খেদমত করার সুযোগ দিয়েছেন তার বর্ণনা আমি আলাদা কাগজে দিলাম। বন্ধুগণ! আমি ব্যবসা বাণিজ্য করি না-চাকরিও করি না। ব্যক্তিগত কোন স্বার্থে আমি সদস্য পদ প্রার্থী নই। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য আইনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) জনগণের খেদমত। আমার বিগত খেদমতই তার চূড়ান্ত প্রমাণ। আমি জমিদার হিসাবে আপনাদের নিকট হাজির হই নাই। আমার পূর্ব-পুরুষ আপনাদের জন্য কি করেছেন সে দাবি নিয়েও আমি আসি নাই। আমি আপনাদের কাছে এসেছি আমি কি করেছি সেই দাবি নিয়ে। মাত্র দেড় বছরে আামাকে আল্লাহ যে খেদমতের সুযোগ দিয়েছেন তা আপনাদের কাছে পেশ করলাম। যদি সুযোগ দেন তবে এনশাল্লাহ আমার সাধ্যমত আপনাদের খেদমত করে যাব।
আল্লাহ আপনাদের সর্ব প্রকার মঙ্গল করুন। আমীন!
আরজ গোজার –
মো: বায়াজীদ খান পন্নীপরিষদের বাহিরে
নির্বাচিত হওয়ার পর আমি করটিয়ার আর্ন্তজাতিক রেড ক্রশের একটি কেন্দ্র স্থাপন করেছি। এই কেন্দ্রে একটি মাতৃসদন, একটি ফ্রি ডিসপেনসারী, একটি শিশু-মহল এবং একটি রিলিফ বিভাগ আছে। একজন পাশ করা ধাত্রী, একজন পাশ করা দাই, দুইজন ডাক্তার (একজন এম, বি এবং একজন এল, এম, এফ), একজন সেক্রেটারী, দুইজন দারোয়ান এবং কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক এই কেন্দ্র পরিচালনা করেন। কয়েকদিন আগে ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা মঞ্জুর করিয়ে নিয়ে এসেছি এই কেন্দ্রের পাকা বিল্ডিং করার জন্য। ইলেকশনের হাঙ্গামা চুকে গেলেই এনশাল্লাহ বিল্ডিংয়ের কাজ আরম্ভ করব। কিছুনি আগে এই কেন্দ্রের দুইটি শাখা মঞ্জুর করিয়ে দিয়েছি এবং সেগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধপত্রও এসে গেছে। একটি কেন্দ্র পাহাড় অঞ্চলে এবং একটি কেন্দ্র চর অঞ্চলে স্থাপন করতে স্থির করেছি। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলি এ ব্যাপারে স্থান এবং ডাক্তারের বন্দোবস্ত করলেই এগুলো খুলে দেব।
এই কেন্দ্রের ধাত্রীর হাতে এবং তত্ত্বাবধানে এপর্যন্ত ১৩৫টি শিশুর জন্ম হয়েছে। শিক্ষিতা ধাত্রীর হাতে না পড়লে হয়তো এর মধ্যে অনেক শিশুই প্রাণ হারাত।
শিশু মঙ্গল বিভাগে রেজেস্ট্রি করা এক শত শিশুর স্বাস্থ্যের তত্বাবধানে এবং চিকিৎসা করা হচ্ছে। এদের মধ্যে এবং অন্যান্য শিশুদের মধ্যে মোট ৯০০কার্টন (মোটামুটি ৬৫মন) গুড়া দুধ বিতরন করা হয়েছে। এ ছাড়া ‘কর্ণ মিল’ শিশু-খাদ্য (Baby food) রেডি ডায়াট (Ready Diet) ও ঘি যথেষ্ট পরিমাণে বিতরণ হয়েছে।
ফ্রি ডিসপেনসারি বিভাগে এ পর্যন্ত চৌদ্দ হাজারের বেশি মানুষের চিকিৎসা করা হয়েছে। প্রায় এক হাজার লোককে কলেরা, টাইফয়েডের টীকা দেওয়া হয়েছে।
এই কেন্দ্রের রিলিফ বিভাগ থেকে এ পর্যন্ত নিুলিখিত জিনিষগুলি গরীব লোকদের মধ্যে বিতরন করা হয়েচে। (১) নূতন পশমী কম্বল -১৫০(২) নূতন সুতি জ্যাকেট-৩০০ (৩) নূতন পশমী সোয়েটার-৮০ (৪) নূতন পশমী সার্ট-২০ (৫) নূতন ধুতি-২১০০ (৬) নূতন লুঙ্গি-১৫০০ (৭) নূতন শাড়ী-১০০০ (৮) নূতন ও পুরান মেশানো ওভার কোট, কোট, সার্ট প্যান্ট, সোয়েটার ইত্যাদি-২৫৪৬। এই মোট ৭৫৯৬ খানা। এগুলি আমি টাঙ্গাইল, বাশাইল থানার সর্বত্র এবং কালীহাতী এবং মির্জাপুরই কিছু অংশ বিতরণ করেছি।
আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে এই কেন্দ্র পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত গ্রাম্য কেন্দ্রের ১৯৬৪ সনে মানুষের সেবায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে।
বাশাইল থানার অধিবাসীদের একটা সাধ ছিল যে টাঙ্গাইল থেকে বাশাইল পর্যন্ত একটা পাকা রাস্তা। এ রাস্তার জন্য লাখ টাকার কিছু বেশি মঞ্জুর হয়েছে এবং কিছুটা রাস্তা ইটের সোলিং হয়েছে। এর মধ্যে আমার প্রচেষ্টা ছিল। টাঙ্গাইল থেকে বাশাইল হযে শ্রীপুর হয়ে জয়দেবপুরের চৌরাস্তা পর্যন্ত একটা রাস্তার প্রস্তাব আমি সরকারের কাছে দিয়েছি। এটাকে ভূত পূর্ব যোগাযোগমন্ত্রী হাসান আসকারী সাহেবকে দিয়ে সুপারিশ করিয়ে দিয়েছি তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অঙ্গীভূত করতে। জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল যদি এটাকে অনুমোদন করে তবে এই রাস্তা সি এন্ড বি কর্তৃক তৈরী হবে।
এ ছাড়া এই এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিও আমার লক্ষ্য ছিল এবং যখন যেভাবে সম্ভব সে গুলোকে সাহায্য করেছি। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী এ, টী এম মোস্তাফাকে নিয়ে এসে মির্জাপুর টাঙ্গাইল ও বাশাইল থানার বিভিন্ন স্কুলের, মাদ্রাসার ও মেয়েদের স্কুলে প্রতিষ্ঠায় আড়াই থেকে পাঁচ হাজার ঢাকায় আর্থিক সাহায্য দেওয়াইয়াছি।
মোটামুটি এই হোল আমার দেড় বছরের কাজের হিসাব। এর মধ্যে ছোট খাট অনেক কিছুই ধরি নাই। আমি জনগণের খেদমত করতে পেরেছি কিনা সে বিচারের ভার এখন আপনাদের হাতে।
আরজ গুজার
মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী (সেলিম)