মহান বিজয় দিবস-২০২২ উপলক্ষে উন্নয়নের মডেল নোয়াখালীর পোরকরা গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় দু দিনব্যাপী বাণিজ্যমেলা। এতে হেযবুত তওহীদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চাষীরহাট উন্নয়ন প্রকল্পের উৎপাদিত রকমারি পণ্যের প্রদর্শনী করা হয়। সাত বছর আগে যে এলাকাটি ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কবলে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল সেখানে এরই মধ্যে হেযবুত তওহীদের হাত ধরে ঘটে গেছে এক নবজাগরণ।
হেযবুত তওহীদের সদস্যদের নিজেদের উৎপাদিত ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি কাঁচামাল থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী বাজারজাত করে থাকে কররানি ফুডস্ লিমিটেড। নিজেদের উৎপাদিত সত্তরটির বেশি পণ্য নিয়ে বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটি।
বাণিজ্য মেলায় অংশ নেওয়া কে আর ফ্যাশনের স্টলে স্থানীয় নারী ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। রক্ষণশীল নোয়াখালীর যে কোনো গ্রামে এমন দৃশ্য বিরল।
মেলায় আগত অতিথি, জনপ্রতিনিধি ও গ্রামবাসীর সামনে হেযবুত তওহীদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম।
বিলুপ্তির পথে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি শীতের পিঠা। একে পুনরায় উজ্জীবিত করতে পিঠা উৎসবের আয়োজন করে হেযবুত তওহীদ। দর্শনার্থীদেরকে সৌজন্য উপহার হিসাবে পিঠা পরিবেশন করা হয়।
প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় আপন চাইল্ড কেয়ার হোমের শিশুদের সঙ্গে হেযবুত তওহীদের এমাম।
উন্নয়নের মডেল পোরকরা গ্রাম:
অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য মানুষ শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে থাকেন। কিন্তু একটি আদর্শের উপযুক্ততা, প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য উৎপাদনমুখী উদ্যোগ গ্রহণের ঘটনা ইতিহাসে নজিরবিহীন। আল্লাহ ইসলাম পাঠিয়েছেন মানুষের মানুষকে একটি শান্তিময় সমৃদ্ধ জীবন উপহার দেওয়ার জন্য। প্রকৃত ইসলাম অর্ধ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার ফলে এমনই একটি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে একা একটা নারী সুন্দরী নারী মূল্যবান অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় শত শত মাইল পথ নির্ভয়ে অতিক্রম করতে পারত। মানুষ দরজা খুলে রেখে চলে যেত, কেউ কিছু চুরি করত না। ধনীরা সম্পদ বিতরণ করার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরত, কিন্তু নেওয়ার মত কাউকে পেত না। ইসলাম সেটা করেছিল। কিন্তু আজকে আমাদের সমাজে যে ইসলাম সেটা কেন এমন সমাজ উপহার দিতে পারছে না? কারণ বিগত ১৪শ বছরে আজকের ইসলাম আর রসুলাল্লাহর আনীত ইসলামের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান হয়ে গেছে। কিন্তু ইসলাম শাশ্বত চিরন্তন জীবনব্যবস্থা। যদি আল্লাহর রসুলের সেই প্রকৃত ইসলামকে আজ আবারও প্রতিষ্ঠা করা হয় তাহলে একই প্রকার শান্তি মানুষ লাভ করবে। হেযবুত তওহীদ সেই প্রকৃত ইসলাম লাভ করেছে এবং সেটা গ্রহণ করার জন্য মানুষকে আহ্বান করছে।
ইসলামের নামে বর্তমানে যখন পৃথিবীতে জঙ্গিবাদী তাণ্ডব হয়, যখন ইসলামের নামে রাজনীতি করে মানুষের ঈমানকে সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করা হয়, যখন ইসলামের লেবাস ধারণ করে মানুষ ধর্মব্যবসার প্রতারণা করে, যখন ইসলামের নামেই হাজার হাজার ফেরকায়, মাজহাবে, দলে, উপদলে মুসলাম বিভক্ত হয়ে একে অপরের উপর হামলা চালায় তখন কী করে যুক্তিশীল মানুষ হেযবুত তওহীদের এই আহ্বানের উপর আস্থা রাখতে পারে?
এই প্রশ্নের জবাব দিতে হলে কেবল মুখে বললেই হবে না, কাজেও প্রমাণ করতে হবে। হেযবুত তওহীদের এমাম জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম তাই সমগ্র জাতিকে নিয়ে একটি ছোট পরিসরে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করে দেখানোর উদ্যোগ নিলেন। তাঁর এই উদ্যোগকে ভুলভাবে তুলে ধরে মানুষের মধ্যে অপপ্রচার ও গুজব রটিয়ে ২০১৬ সালে তাঁর বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়, গুড়িয়ে দেওয়া হয় নির্মাণাধীন মসজিদ। পিটিয়ে, হাত পায়ের রগ কেটে, চোখ তুলে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয় আন্দোলনের দুজন সদস্যকে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের মরদেহ।
কিন্তু এই ঘটনার ফল হল উল্টো। ধর্মব্যবসায়ীদের ভয়ে ভীতশঙ্কিত না হয়ে তাদেরকে ভিন্ন উপায়ে জবাব দেওয়ার জন্য তারা সকলে মিলে মাঠে নামলেন। চাষীরহাট ইউনিয়নকে প্রকৃত ইসলামের আদর্শের বাস্তবায়ন তারা করে দেখাবেন এই তাদের দৃঢ় প্রত্যয়। আল্লাহর দেওয়া সত্যদীন দিয়ে মানুষের বাস্তব জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করার জন্য নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে সারাদেশের সদস্যরা নিজ নিজ এলাকাতেও উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগ করলেন। গড়ে তুলতে লাগলেন গরুর খামার, সনাতন মৎস্য খামার, বায়োফ্লোক মৎস্য খামার, ছাগলের খামার, হাঁসমুরগির খামার। তারা সম্মিলতভাবে ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি খাদ্যশস্য, পাট, শাক-সবজির আবাদ করতে লাগলেন। যারা কোনোদিন কৃষিকাজ করেননি তারাও কোমর বেঁধে কাস্তে কোদাল হাতে নেমে পড়লেন উৎপাদনে। উদ্দেশ্য, নিজেদেরকে আসন্ন খাদ্য সংকট মোকাবেলার উপযোগী করে গড়ে তোলা। তারা প্রতিষ্ঠা করলেন পোশাক তৈরির কারখানা, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প কারখানা।
কেবল উৎপাদন নয়, নতুন প্রজন্মকে সুশিক্ষা দিতে প্রতিষ্ঠা করলেন স্কুল, বড়দের জন্য গণশিক্ষা কার্যক্রম, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য শিশুবিকাশ কেন্দ্র, প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য হাসপাতাল। এভাবে প্রায় অর্ধশত উন্নয়নমুখী প্রতিষ্ঠান একযোগে শত শত সদস্যের কর্মসংস্থানের যোগান দিচ্ছে।
জাতির সামনে হেযবুত তওহীদের এই বহুমুখী উদ্যোগকে প্রকাশ করার জন্য মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ২২ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে চাষীরহাট নুরুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। শহুরে যান্ত্রিক জীবনের ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মেলা যখন বিলুপ্ত হওয়ার পথে তখন নোয়াখালীর পোরকরা গ্রামে আয়োজিত হয় একটি ভিন্ন রকমের মেলা। কৃষিমেলা, বাণিজ্যমেলা ও গ্রামীণমেলার অভিনব সম্মিলন ঘটানো হয় দুদিনব্যাপী এ মেলায়।
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি থানাধীন প্রত্যন্ত গ্রাম পোরকরায় এত জমজমাট বাণিজ্যমেলার আয়োজন আগে কখনো হয়নি। শুধু পোরকরা নয়, পুরো নোয়াখালী জেলাতেও এমন আয়োজন আগে দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন নোয়াখালী জেলার অধিবাসীগণ। মেলাটি নানা কারণে এলাকাজুড়ে অভাবনীয় প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। দুটো দিন ধরে মেলাটি প্রকৃত অর্থেই পরিণত হয়েছিল হাজার হাজার দর্শনার্থীর মিলনমেলায়। মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকার নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সকলের মধ্যে সৃষ্টি হয় উৎসবের আমেজ।
চাষীরহাট উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মেলায় তাদের স্টল সজ্জিত করে। কররানি ফ্যাশন, কররানি ফুড এন্ড বেভারেজ, কৃষি প্রকল্পে উৎপাদিত ফলমূল, শাকসবজি, মৎস্য প্রকল্পে উৎপাদিত তাজা মাছ, গ্রাম বাংলার শতপ্রকারের ঐতিহ্যবাহী পিঠা, বহুরকমের আচার, হাতে তৈরি খাবার, শিশুদের খেলনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শীতের পোশাকসহ যাবতীয় পোশাক, নিত্যব্যবহার্য পণ্যের স্টল সাজানো হয় চাষীরহাট নুরুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠকে আবর্তন করে।
এখানে একটি কথা বলতে হয়। মেলার প্রথমদিনে গ্রামের পুরুষরা মেলায় আসেন। তারা তেমন কিছু কেনাকাটাও করেন না, শুধু পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে হেঁটে চলে গেছেন। আমাদের সমাজে সর্বত্র যখন দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অস্থিরতা লেগেই থাকে। তাই মেলার নিরাপত্তা পরিস্থিতি কেমন সেটা তারা বিচার বিবেচনা করে যখন তারা নিশ্চিত হয়েছেন এখানে কোনো ভয় নেই, ভীতি নেই, বিবাদের আশঙ্কা নেই, মেলাকে কেন্দ্র করে শুধুই আনন্দ আর উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে, তখন দ্বিতীয় দিন তাদের স্ত্রী, সন্তান এবং মা বোনদের নিয়ে মেলায় এসেছেন। পিঠা খেয়েছেন, চা খেয়েছেন, আনন্দ করেছেন, মন খুলে কেনাকাটা করেছেন। মেলায় একটি চুরির ঘটনাও ঘটেনি, কেউ কোনো মেয়েকে উত্যক্ত করেনি। এলাকাবাসী একজন আরেকজনের সঙ্গে খোশ গল্প করেছেন। এরকম আনন্দঘন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আজকাল দেখাই যায় না। যা হেযবুত তওহীদ আবার পুনরায় ফিরিয়ে এনেছে।
আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে যে এলাকাটি সন্ত্রাসীদের হামলায়, ধর্মীয় উন্মাদনায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল আজ হেযবুত তওহীদের পদচারণায় সেখানে উন্নয়নের জয়জয়কার। যে সুন্দর, নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ সমাজের রূপরেখা ও আদর্শ হেযবুত তওহীদ এতদিন মুখে বলে এসেছে তার বাস্তবরূপ নোয়াখালীর চাষীরহাটে না গেলে বোঝা সম্ভব নয়। ইনশাল্লাহ শুধু চাষীরহাট নয় হেযবুত তওহীদের প্রস্তাবিত আদর্শ গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশের প্রতিটা গ্রামে শান্তি সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের এমন চিত্রই দেখা যাবে।