মনে রাখতে হবে, সবচেয়ে জঘন্য মিথ্যা হলো যে মিথ্যা ধর্মের নামে করা হয়, আলস্নাহর নামে করা হয়। পলিটিক্যাল ইসলামের বড় বড় নেতারা এই জঘন্য মিথ্যাটিকেই তাদের রোজগারের হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছেন। আসলে এরকম ছলনা তারা করতে বাধ্য। আঁকাবাঁকা রাস্তায় দিয়ে সোজা গাড়ি চালানো যায় না, আঁকাবাঁকাই চালাতে হয়। তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করে না, তারা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদির কথা বলে রাজনীতি করে। সেই দলের নেতারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে পরিমাণ দুর্নীতির আশ্রয় নেন, তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামলে তাদের চেয়েও বেশি দুর্নীতি আর ভ-ামির আশ্রয় নিতেই হবে। ব্রিটিশদের শেখানো পথে যারা রাজনীতি করবে তাদেরকে ধান্ধাবাজি, গলাবাজি, মিথ্যাচার, সন্ত্রাসী কর্মকা-, জ্বালাও- পোড়াও, ভাঙচুর, হরতাল-অবরোধ করতেই হবে। এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় না। তাই ইসলামের নামে যারা রাজনীতি করেন তারা একদিকে যেমন আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা করেন অপরদিকে জনগণের সঙ্গেও প্রতারণা করেন।
তাদের সবচেয়ে বড় বোকামিটা এখানে। যারা সেক্যুলার রাজনীতি করেন তারা তাদের যাবতীয় অপকর্মকে শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েজ প্রমাণ করার চেষ্টা করেন না। তাই জনগণও তাদের কাছে শরিয়তসম্মত, ইসলামের নীতিসঙ্গত আচরণ আশা করে না, দীনের মানদন্ডের তাদেরকে যাচাই করে না। রাজনীতিতে ধান্ধাবাজি চলে, প্রতারণা চলে এটা সর্বজনবিদিত। কিন্তু যারা ইসলামের পক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়েছে তাদেরকে মানুষ ইসলামের মানদন্ডেই যাচাই করবে এটাই যুক্তিসঙ্গত, মানুষ দেখবে তারা কি অন্যদের মতো রাজনৈতিক মিথ্যাচারিতা করে, নাকি যা বলে তা কাজেও প্রমাণ করে। তাদের বক্তব্যের মধ্যে কোর’আন হাদিসের কথা থাকে, তাই তাদের বক্তব্যকে ইসলামের কথা বলেই জনগণ বিবেচনা করে। কিন্তু প্রচলিত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনগণের এই চাহিদা কোনোদিন তারা পূরণ করতে পারবে না। এখানেই ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো হাজারবার ব্যর্থ হতে বাধ্য। ধর্মের নামে মিথ্যাচার, প্রতারণাকে মানুষ মেনে নিতে পারে না। এ কারণে আমাদের দেশেও রাজনৈতিক ইসলামি দলগুলো জাতীয় নির্বাচন তো দূরের কথা, গ্রামের মেম্বার চেয়ারম্যান পদেও জিততে পারে না।
দু’চার জন জিতলেও সেটা সামগ্রিক বিচারে এতটাই নগণ্য যে জাতীয় পর্যায়ে তাদের কোনো প্রভাবই সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না। আর যেসব দেশে অমুসলিমরা সংখ্যাগুরু সেখানে রাজনৈতিক ইসলামের সফলতার সম্ভাবনা শতকরা শূন্যভাগ, যেমন ভারত, চীন, জাপান, রাশিয়া বা ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোয়। কারণ মুসলমানদের ভোটের উপর ভরসা করেই ইসলামিক দলগুলো রাজনীতি করে থাকে। যেখানে মুসলমানদের বাঁধা ভোটব্যাঙ্ক নেই সেখানে তাদের ভোটাভুটি করে ক্ষমতায় যাওয়াই সম্ভব নয়, ইসলাম প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা। কিন্তু আল্লাহ তাঁর রসুলকে দায়িত্ব দিয়েছে অন্যান্য সমস্ত দীনের উপরে এই শেষ জীবনব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তাঁর উপাধি দিয়েছেন রহমাতালিল্লাহ আলামিন বা বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ। এক কথায় সমগ্র মানবজীবনে এই সত্য প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব আল্লাহ তাঁকে দিয়েছেন। যে প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর নির্দিষ্ট কিছু ভূখন্ডে দীন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতে পারে, আর বাকি পৃথিবীতে অসম্ভব সেটা কোনোভাবেই সার্বজনীন নীতি-প্রক্রিয়া হতে পারে না। আল্লাহ দীনুল হক দিলেন সারা পৃথিবীর জন্য কিন্তু এমনই প্রতিষ্ঠার তরিকা দিলেন (রাজনৈতিক ইসলাম) যা কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশগুলোয় প্রয়োগ করা সম্ভব এটা কী করে হতে পারে? সুতরাং এটা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আলস্নাহর দেওয়া পথ নয়, এটি মানুষের তৈরি পথ। ও পথে আল্লাহর ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব নয়। ধানচাষের প্রক্রিয়ায় আলু চাষ করা যায় না। এই দলগুলোতে বহু কর্মী আছেন যারা সত্যি সত্যিই ইসলামকে ভালোবাসেন, আল্লাহর-রসুলের বিজয় দেখতে চান। কিন্তু পথ ভুল হলে হাজার বছর চলেও গন্তব্যে পৌঁছা যায় না। এটা এসব দলের কর্মীরা যত দ্রুত বুঝতে পারবেন ততই তাদের পড়্গে বিভ্রান্তি বেড়াজাল থেকে মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ভোট পাওয়ার জন্য ইসলাম নিয়ে কপটতার রাজনীতি করতে কিন্তু সেক্যুলার দলগুলোও কম যান না। প্রয়োজনে বাহ্যিক কিছু কাজ করে তারা দেখান যে নেতারাও অতি উৎকৃষ্ট মুসলিম। যেমন মসজিদ তৈরি ও মেরামত, টাকার নোটে মসজিদের ছবি ছাপান, শুক্রবারকে ছুটির দিন ঘোষণা করা, সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, রাষ্ট্রধর্ম ইত্যাদি সংযোজন করা। প্রতি বছর সরকারি খরচে বিরাট বহর নিয়ে হজ্ব করতে যাওয়া এবং সেখানে সৌদি বাদশা ও শাহী আলেমদের সঙ্গে ছবি তুলে নিজ নিজ দেশে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা, নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরুর আগে কোনো বিখ্যাত মাজারে গমন এবং লম্বা মোনাজাতের ব্যবস্থা করা, বড় কোন ইসলামের নামে সম্মেলনের শেষদিনে আখেরী মোনাজাতে উচু মঞ্চ বানিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে লম্বা দোয়া করা এবং সেটা সারাক্ষণ টেলিভিশনে দেখানো ইত্যাদি। ইংরেজিতে যাকে বলে Window dressing, বাইরে রং লাগিয়ে চকচকে করে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া। যেহেতু জনসাধারণ প্রকৃত ইসলাম সম্বন্ধে অজ্ঞ কাজেই তারাও খুব ইসলাম করা হচ্ছে মনে করে খুশি থাকেন। কিন্তু এসবকিছু করে ইসলামের কোনো উপকার হচ্ছে না, ইসলামের প্রতিশ্রুত ন্যায়, শান্তি, সাম্য, অর্থনৈতিক সামাজিক সুবিচার কিছুই মানুষ পাচ্ছে না। পাচ্ছে কেবল ধোঁকা। তাদেরকে সেক্যুলার দলগুলোও ধর্মের নামে ধোঁকা দিচ্ছে, ইসলামপন্থী দলগুলোও ধর্মের নামে ধোঁকা দিচ্ছে।
আজ গণতান্ত্রিক রাজনীতির মতো মিছিল, মিটিং, ঘেরাও, ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও, সাধারণ মানুষের জীবন-সম্পদকে জিম্মি করে আন্দোলন ইত্যাদি কাজগুলোও অন্যান্য দলগুলোর মতো অনেক ইসলামি আন্দোলনও হরদম করে যাচ্ছে কিন্তু ইসলাম এগুলোর অনুমতি দেয় না, এগুলো ইসলামে নেই। আল্লাহ রসুল মক্কায় থাকতে অর্থাৎ রাষ্ট্র গঠনের আগে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ ঘোষণা করেন নি। তিনি সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে একবারও কোনো ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াওয়ের কর্মসূচি নিয়েছেন এমন প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবেন না। এগুলো হচ্ছে ইসলামের মৌলিক নীতিপরিপন্থী কাজ যা সুস্পষ্ট সন্ত্রাস। ইসলামের নীতি হলো সত্য ও মিথ্যা মানুষের সামনে উপস্থাপন করা এবং সত্যের পথে যারা আসবে তাদেরকে নিয়ে দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করা। একটা পর্যায় আসবেই যখন সত্য বিজয়ী হবে আর সত্য বিজয়ী হতে গেলে মিথ্যার সঙ্গে চূড়ান্ত সংঘাত হবে, সেটা হলো যুদ্ধ, জেহাদ, কেতাল। সেটার জন্য ন্যায়ের পক্ষে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পক্ষে এক নেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা লাগবে, মদিনার মতো একটা স্বাধীন ভূখ- ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো লাগবে। এই শর্তগুলো পূরণ হওয়ার পরই রসুলাল্লাহর সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
ইসলামের নীতিই হচ্ছে, কেউ যদি নেতৃত্বের আকাক্সক্ষ পোষণ করে তাহলে তাকে নেতৃত্ব লাভের অযোগ্য বলে গণ্য করতে হবে। অথচ প্রচলিত রাজনৈতিক পদ্ধতিই হচ্ছে, নিজের জন্য মনোনয়নপত্র কিনতে হবে, পোস্টার টানাতে হবে, আত্মতপ্রচার করতে হবে এমন কি ঘুষ দিয়ে ভোট কিনতে হবে। অর্থাৎ ইসলামের নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। রসুলাল্লাহর বলেছেন, তোমরা যখন কারো ভিতর নেতৃত্ব পাবার বাসনা, আকাক্সক্ষ দেখ সে যেন কখনও তোমাদের মধ্যে নেতা না হতে পারে (হাদিস: আবু বুরাদা (রা.) থেকে বোখারি)। সুতরাং এটা হচ্ছে প্রথম নীতি। যারা রাজনৈতিক ইসলামের কথা বলেন তারা এই নীতিটা ভঙ্গ করতে বাধ্য হন।আল্লাহর রসুল কোনোদিন প্রতিপক্ষর সঙ্গে কোয়ালিশন করে, ভাগাভাগি করে ক্ষমতা যান নি। তিনি যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছেন, সন্ধি করেছেন। এই সবই তিনি করেছেন কাফেরদের সঙ্গে। কিন্তু সত্য ও মিথ্যাকে, ঈমান ও কুফরকে, দীন ও তাগুতকে তিনি কোনোদিন মিশ্রিত হতে দেন নি।
তার নীতি ছিল, মিথ্যার সাথে কোনো আপস হবে না। কিন্তু ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যে কোনো পন্থা গ্রহণ করতে পারে। মানুষের অজ্ঞতাকে ব্যবহার করে, মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে কখনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, কখনও গুজব রটনা করে, কখনও মিথ্যানির্ভর হুজুগকে কাজে লাগিয়ে ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টি করে অর্থাৎ ছলে বলে কৌশলে যেভাবে পারে উদ্দেশ্য হাসিল করার চেষ্টা করে। এতে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের কোনো বাছবিচার থাকে না।রসুলাল্লাহর সমস্ত সংগ্রামের প্রতিপক্ষ ছিল কাফেরগণ। আজকে যারা নির্বাচনকে ‘এ যুগের জেহাদ’ বলে জনগণকে বিশ্বাস করাতে চান তাদের কাছে প্রশ্ন হচ্ছে এই ভোটযুদ্ধ তারা কার বিরম্নদ্ধে করছেন তাদের ধর্মীয় পরিচয় কী? তারা কি মো’মেন না কাফের এটা আগে সুস্পষ্ট করতে হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য মো’মেনদের সংগ্রাম নিশ্চয়ই হবে কাফেরের বিরুদ্ধে।
সমগ্র পৃথিবীর রাজনৈতিক ইসলামী আন্দোলনগুলো এ ক্ষেত্রে বড় কপটতার আশ্রয় নিয়ে থাকে। তারা প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের ধর্মীয় পরিচয়টি স্পষ্ট করে না। প্রতিপক্ষ ধর্মীয় মানদন্ডে হয় মো’মেন হবে নয় তো কাফের হবে, তৃতীয় কোনো পথ খোলা নেই। প্রতিপক্ষ যদি মো’মেন-মুসলিম হয় তাহলে লড়াই হতেই পারে না, তাহলে উভয়েই ভ্রাতৃবিরোধী সংঘাতের দরুন ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে। আর যদি কাফের হয় তাহলে কাফেরদের মোকাবেলা করার ড়্গেেত্র ইসলামের যে নীতিগুলো আছে সেগুলো প্রযুক্ত হবে। মনে মনে তারা সেই প্রতিপক্ষ সেক্যুলার রাজনৈতিক দলগুলোকে তাগুত আর কুফরি শক্তি বলেই বিশ্বাস করেন, কিন্তু এ কথা তারা প্রকাশ্যে বলেন না, কারণ ও কথা বললে তো রাজনীতিই করা যাবে না।
ক্ষমতার ভাগ পেতে তাদেরকে বিভিন্ন সেক্যুলার দলের লেজুড়বৃত্তি করতে হয়। কাফের ফতোয়া দিলে সেটা সম্ভব হবে না। এই লেজুড়বৃত্তিকে জায়েজ করার জন্য তারা মক্কার কাফেরদের সঙ্গে রসুলাল্লাহর করা হোদায়বিয়ার সন্ধির উদাহরণ টেনে আনেন। তারা ভুলে যান যে, সেই সন্ধিটি হয়েছিল কাফেরদের সঙ্গে মো’মেনদের। এখানে হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির প্রসঙ্গ টানার অর্থই হচ্ছে অপর পড়্গকে কাফের বলে সাব্যস্ত করা। এই আখ্যাটি তারা জনসমড়্গে দিতে পারেন না। তারা অন্তরে বিভেদ পুষে রেখে একই মসজিদে, একই ইমামের পেছনে নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়েই তারা একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হন। কিন্তু রসুলাল্লাহর সময় এই মো’মেন ও কাফেরের বিভাজনটা স্পষ্ট ছিল। যারা মোমেন তারা ছিলেন ভাই-ভাই, এক নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ। নামাজের সময় তারা যেমন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতেন তেমনি বাস্তব জীবনেও তারা কাফেরদের বিরম্নদ্ধে লড়াই করে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের কাছে কে মো’মেন কে কাফের এ বিভাজন প্রকাশ্য ও স্পষ্ট ছিল। মক্কার কাফেরদের সঙ্গে মো’মেনগণ কি এক জামাতে নামাজ পড়তেন, একসঙ্গে হজ্ব করতেন? প্রশ্নই আসে না।