মিথ্যাশ্রয়ী গণমাধ্যম ও ধর্মব্যবসায়ীদের প্রবণতা
যে সমাজে যুক্তিহীনতার অবাধ চর্চা হয় সে সমাজে কিছুদিন পর পর গুজব ছড়িয়ে দিয়ে সহিংসতা সৃষ্টি করা হবে এটা খুবই স্বাভাবিক। বর্তমানে ধর্মগুলো ধর্মের মূল শিক্ষার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে পুরোপুরি যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাসের সামর্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মের ধারক-বাহক দাবিদার একটি শ্রেণি ঘোষণাই দিয়েই নেমেছেন যে, ধর্মকে বিনাপ্রশ্নে বিনা যুক্তিতে গ্রহণ করতে হবে। আর ধর্ম কী? ধর্ম হচ্ছে সেটাই যেটা তারা বলবে। সাধারণ মানুষ ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাদেরকেই অন্ধভাবে অনুসরণ করবে, বিনা প্রশ্নে, বিনা দলিলে, বিনা দ্বিধায়। এই অন্ধত্বের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তি ও অসহায় হয়ে যায়। যারা এর বিরুদ্ধে যাবে তারাই কাফের, নাস্তিক ফতোয়া দ্বারা বিদ্ধ হবে। তাদের বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে ধর্মবিশ্বাসী ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে অনবহিত জনগোষ্ঠীকে ক্ষিপ্ত করে তোলা হবে, সৃষ্টি করা হবে ধর্মোন্মাদনা।
বিভিন্ন প্রকার গুজব সৃষ্টি করে ধর্মোন্মাদনা ও দাঙ্গা-সহিংতা ঘটানোর ইতিহাস সুপ্রাচীন। ইউরোপের মধ্যযুগ পুরোটাই খ্রিষ্টান যাজকদের অন্ধত্বের চর্চার উদাহরণ। মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, মেধাবিকাশের স্বাধীনতা কিছুই ছিল না। যাজকরা যখন যাকে ইচ্ছা ফতোয়ার ফাঁদে ফেলে বিচারের সম্মুখীন করতো অথবা বিনা বিচারে হত্যা করত। যে কোনো তুচ্ছ কারণেও নির্মম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। ধর্মীয় পৈশাচিকতার ঘৃণ্য সেই নিদর্শন দেখে ইউরোপের মানুষ ধর্মের উপর শ্রদ্ধা হারিয়েছে, তারা কায়েম করেছে ধর্মনিরপেক্ষ জীবনব্যবস্থা। ধর্মযাজকদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ছিনিয়ে নেওয়া হলো, কিন্তু ধর্মান্ধ জনতার ধর্মানুভূতির নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই রয়ে গেল। পরবর্তীতে সেই জীবনব্যবস্থা মুসলিম বিশ্বেও ইউরোপীয়রা সামরিক শক্তিবলে কার্যকর করল। ভারতবর্ষে জাতিকে বিভক্ত করার মানসে তারা একই সাথে দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করল। একদিকে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা আরেকদিকে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করে আলেম শ্রেণির হাতে ধর্মীয় অনুভূতির নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করা হলো। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গায় উভয় ধর্মের ধর্মব্যবসায়ীরা নেতৃত্ব দিয়ে লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীকে হত্যা করল। পেছনে ইন্ধন যোগালো ব্রিটিশ খ্রিষ্টানরা। এটা তাদের ডিভাইড এন্ড রুল নীতির প্রতিচ্ছবি। আজও সেই ধারবাহিকতা আমরা বয়ে চলেছি বলেই অগণিত মাদ্রাসা থেকে হুজুগপ্রবণ ও ধর্মোন্মাদনায় মেতে ওঠা আর মাতিয়ে তোলার যোগ্যতাধারী নাগরিক বেরিয়ে আসছে। তারা নিজেদের ধর্মব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুগপৎ জনগণ ও শাসকদেরকে তটস্থ রাখে এই ধর্মোন্মাদনা নামক হাতিয়ারটি ব্যবহার করে।
এই গুজবের হাতিয়ার যে কেবল ধর্মব্যবসায়ীরাই ব্যবহার করে তা নয়, মিথ্যাশ্রয়ী যে কোনো গোষ্ঠী তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য হুজুগে জাতির কানে গুজব তুলে দেয়। আমাদের দেশে অপপ্রচারে বিশ্বাস করে সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের বোঝাতে চিলে কান নিয়ে যাওয়ার উদাহরণ দেওয়া হয়। যখন কোনো গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে সেটা রাজনৈতিক হোক বা অরাজনৈতিক, সেটাকে জোরদার করার জন্য সকলেই প্রায় গুজব আর হুজুগের পন্থা অবলম্বন করে। কিছুদিন আগেও নিরাপদ সড়কের জন্য যে ছাত্র আন্দোলটি হলো সেটাও শেষভাগে এসে হুজুগ আর গুজবের উপর ভর করল। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি ভাষণে বলেন, “গুজব ছড়ালেই তা বিশ্বাস করতে হবে কেন, কিছু শুনলে আগে বুদ্ধির প্রয়োগ করে তা বিচার বিবেচনা করতে। ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি সুশিক্ষার জন্য, গুজব ছড়াতে নয়।”
গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে যে হেফাজতের আন্দোলন হয়েছিল সেটাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ কয়েকটি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সহযোগিতায় গুজব আর হুজুগের উপরই দাঁড়িয়েছিল। এটাই আমাদের দেশে বারবার হয়ে আসছে।
নোয়াখালীতে ২০১৬ সনের ১৪ মার্চ হেযবুত তওহীদের দুই সদস্যকে জবাই করে হত্যা করা হয়। হত্যা করেছিল ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দলের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে ধর্মোন্মাদ কিছু মানুষ যারা ধর্মব্যবসায়ীদের মিথ্যা কথায় অর্থাৎ গুজবে বিশ্বাস করেছিল। হেযবুত তওহীদের সদস্যরা সেখানে নিজেদের জমিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা মসজিদে মসজিদে প্রচার করে দেয় যে এটা মসজিদ নয়, গির্জা বানানো হচ্ছে। সুতরাং খ্রিষ্টানদের মারো আর গির্জা ভাঙো। হেযবুত তওহীদ হলো তাদের দাবি মোতাবেক খ্রিষ্টান। মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হলো, খ্রিষ্টানদের সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধ চলছে, জেহাদ চলছে ঈমানী দায়িত্ব হিসাবে সবাই যোগ দাও। ব্যাস আর যায় কোথায়? সম্পূর্ণ গুজব আর হুজুগের উপর ভর করে এমন তাণ্ডব ঘটিয়ে দেওয়া হলো যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। গুজবে প্রভাবিত হয়ে হাজার হাজার সন্ত্রাসী প্রকৃতির মানুষ নরহত্যার উন্মাদনা আর ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠল। তারা হেযবুত তওহীদের সদস্যদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়, লুটপাট চালায়, নারী-শিশুসহ ১১৪ জন মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করল। এই ঘটনার বিরুদ্ধে সেদিন কোনো মিডিয়া, কোনো সুশীল সমাজ দাঁড়ায় নি। তারা একে উপেক্ষা করেছে। ভাবখানা এমন যে, হেযবুত তওহীদের লোকদের মেরেছে এটা একটা ধর্মীয় মতবিরোধের জের হিসাবে তারা করেছে। হেযবুত তওহীদের কী দরকার পড়েছে হেযবুত তওহীদ করার?
তাদের এই নীরবতাকে বিজয় এবং মৌনসম্মতি হিসাবে গ্রহণ করেছে ধর্মব্যবসায়ীরা। তারা আরো উজ্জীবিত হয়েছে, আরো আত্মবিশ্বাসী হয়েছে নতুন কোনো ধ্বংসযজ্ঞ সাধনে। আগেই বলেছি, সরকারগুলোও তাদের অন্যায় দাবির সামনে নতজানু হয়ে থাকে, তাদের সমীহ-তোয়াজ করে কথা বলে। কিন্তু এটা সাধারণ জ্ঞান যে, হুজুগ আর গুজব কখনোই একটি জাতির জন্য ইতিবাচক কিছু বয়ে আনে না। কারণ মিথ্যা যখন প্রকাশিত হয়ে যায় তখন পুরো আন্দোলন ভিত্তিহীন হয়ে যায়, তার যৌক্তিক প্রসঙ্গগুলোও আর ধোপে টেকে না। গুজব ব্যবহারের দরুন একটি ন্যায়সঙ্গত বিষয়ও জনসমর্থন হারায়। তাই কোনো অবস্থাতেই হুজুগ আর গুজবকে আশ্রয় করে জাতির টেকসই পরিবর্তন আনয়ন করা যায় না। এই শিক্ষাটি দেয় ইসলাম।
শোনা কথায় কান দিয়ে আকস্মিক আবেগের বশে কোনো কাজ করা আল্লাহর সরাসরি নিষেধ, ইসলাম এর ন্যূনতম সম্ভাবনাকেও প্রশ্রয় দেয় না বরং নির্মূল করে দেয়। উড়ো কথা প্রচার করা বা কারো উপর অপবাদ আরোপ করা ইসলামের দৃষ্টিতে দণ্ডনীয় অপরাধ। কারো ব্যাপারে কোনো কথা শুনে সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে প্রচার করা সমাজে বিশৃঙ্খলা বিস্তারের অন্যতম কারণ। আল্লাহ বলেছেন- মো’মেনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও (সুরা হুজরাত-৬)। আর রসুলাল্লাহ বলেছেন, আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন, কোনো মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যাই শোনে তাই যাচাই না করেই অন্যের কাছে বর্ণনা করে দেয় (মুসলিম)।” রসুলাল্লাহর জীবনে এমন একটি ঘটনাও নেই যেখানে সাহাবীরা গুজবে মেতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষতিসাধন করেছেন। এমন কি যুদ্ধের সময়ও তারা অত্যন্ত সতর্ক থেকেছেন যেন কোনো নির্দোষ বেসামরিক ব্যক্তি, নারী, শিশু, বৃদ্ধের উপর আঘাত না লাগে।
আল্লাহর রসুল (স.) যে একজন সত্যনিষ্ঠ মহামানব ছিলেন এবং তিনি তাঁর জীবনে মিথ্যার ভিত্তিতে, গুজবের ভিত্তিতে, মানুষকে ধোঁকা দিয়ে কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেন নি তার প্রমাণ হিসাবে আরেকটা ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো। মদিনায় তাঁর ৩ বছরের ছেলে ইব্রাহিম যেদিন ইন্তেকাল করলেন, সেদিন সূর্যগ্রহণ হলো। আরবের নিরক্ষর, অনেকটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকদের মনে এই ধারণা জন্মাল যে, যার ছেলে মারা যাওয়ায় সূর্যগ্রহণ হয়, তিনি তো নিশ্চয়ই আল্লাহর রসুল, না হলে তাঁর ছেলের মৃত্যুতে কেন সূর্যগ্রহণ হবে? কাজেই চলো, আমরা তাঁর হাতে বায়াত নেই, তাঁকে আল্লাহর রসুল হিসাবে মেনে নেই, তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করি।
তাদের এ মনোভাব মুখে মুখে প্রচার হতে থাকল। আল্লাহর রসুল (সা.) যখন একথা শুনতে পেলেন, তিনি নিজ গৃহ থেকে বের হয়ে লোকজন ডাকলেন এবং বললেন, “আমি শুনতে পেলাম তোমরা অনেকেই বলছ, আমার ছেলে ইব্রাহিমের ইন্তেকালের জন্য নাকি সূর্যগ্রহণ হয়েছে। এ কথা ঠিক নয়। ইব্রাহিমকে আল্লাহ নিয়ে গিয়েছেন আর সূর্যগ্রহণ একটি প্রাকৃতিক নিয়ম। এর সাথে ইব্রাহিমের মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই” (হাদিস: মুগীরা ইবনে শো’বা ও আবু মাসুদ (রা.) থেকে বোখারী)।
ঘটনাটি এমন এক সময়ের যখন মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড টানাপড়েন ও বিতর্ক চলছে যে তিনি আসলেই আল্লাহর রসুল কি রসুল নন। এমতাবস্থায় রসুলাল্লাহ কিছু না বলে যদি শুধু চুপ করে থাকতেন, কিছু নাও বলতেন, দেখা যেত অনেক লোক তাঁর উপর ঈমান এনে ইসলামে দাখিল হতো, তাঁর উম্মাহ বৃদ্ধি পেত – অর্থাৎ যে কাজের জন্য আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছেন সেই কাজে তিনি অনেকটা পথ অগ্রসর হয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, এসেছিলেন সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে, তাই মিথ্যার সাথে এতটুকুও আপস করলেন না। এতে তাঁর নিজের ক্ষতি হলো। কিন্তু যেহেতু এ কথা সত্য নয় গুজব, সত্যের উপর দৃঢ় অবস্থান থাকার কারণে তিনি সেটিকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দিলেন না। তিনি শক্তভাবে এর প্রতিবাদ করলেন, তিনি জনগণের ধারণাকে সঠিক করে দিলেন। নিজের স্বার্থে তাদের ঈমানকে ভুল খাতে প্রবাহিত করলেন না বা হতে দিলেন না।
এটাই ইসলাম। এটাই আল্লাহর রসুলের প্রকৃত আদর্শ। সে আদর্শ থেকে সরে গিয়ে অর্থাৎ হেকমতের দোহাই দিয়ে বা যে কোনো অজুহাতে মিথ্যার সাথে আপস করে যতই নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক দল, সংগঠন, আন্দোলন পরিচালনা করা হোক, লাখ লাখ কর্মীবাহিনী তৈরি করা হোক, সফলতা আসবে না, আখেরে মিথ্যাই বিজয়ী থাকবে।
আম্মা আয়েশার (রা.) ইকফের ঘটনাও সকলে অবগত আছেন। গাযওয়ায়ে বনু মোস্তালিক থেকে ফেরার পথে আম্মা আয়েশা (রা.) একাকী পেছনে পড়ে যান আর কাফেলা এগিয়ে যায়। সাফওয়ান ইবনে মু’আত্তাল (রা.) এর দায়িত্ব ছিল কাফেলা স্থান ত্যাগের পর পুরো স্থানটি পরিদর্শন করে আসার জন্য যেন কারো কোনো জিনিস পড়ে থাকলে তা তুলে আনতে পারেন। তিনি আম্মা আয়েশাকে (রা.) দেখতে পান এবং নিজের উটে তাঁকে উঠিয়ে উটের রাশি ধরে দ্রুত অগ্রসর হয়ে কাফেলার সঙ্গে মিলিত হন। মোনাফেকরা এই ঘটনাতে অপবাদ রটানোর এক মোক্ষম অস্ত্র পেয়ে গেল। তারা নানারকম কথা বানিয়ে লোকজনের মধ্যে অপপ্রচারের এক তুফান সৃষ্টি করল। যেহেতু রসুলাল্লাহর স্ত্রীকে নিয়ে গুজন রটানো হয়েছে তাই তিনি এ বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে নীরব হয়ে রইলেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো সমাধান আশার জন্য অপেক্ষা করে রইলেন। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে গুজব রটনাকারীরা ঘটনার ডালপালা বিস্তার করতে লাগল। আম্মা আয়েশা (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কারণ রসুলাল্লাহও তাঁর সঙ্গে কোমল আচরণ করা থেকে বিরত ছিলেন। তিনি রসুলাল্লাহর অনুমতি নিয়ে চিকিৎসার জন্য তাঁর মায়ের বাসায় চলে গেলেন।
দীর্ঘদিন এমন অবস্থা চলমান ছিল। অতঃপর আল্লাহ আম্মা আয়েশার নির্দোষ হওয়ার কথা নাযেল করলেন। তিনি লোকজনের সামনে উপস্থিত হয়ে তাদের উদ্দেশে একটি খোতবা দিলেন এবং আল্লাহ কোর’আনে এ ব্যাপারে যা নাযেল করেছেন তা তাদেরকে তেলাওয়াত করে শোনালেন। তারপর তিনি গর্হিত অপপ্রচারে সর্বাধিক তৎপর মিসতাহ, হামনা, হাসসান বিন সাবিত (রা.) ও আব্দাল্লাহ বিন উবাইকে অপবাদের নির্ধারিত শাস্তি আশিটি বেত্রাঘাতের আদেশ দিলেন এবং যথারীতি সে আদেশ পালিত হোল। অপবাদকারীদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে যারা গর্হিত অপপ্রচারে অংশ গ্রহণ করেছিলো, তাদের কথা উল্লেখ করে কোর’আনের যে আয়াতটি নাজেল হলো সেটি হচ্ছে: “যারা এ অপবাদ রটনা করেছে তারা তো তোমাদেরই একটি দল; এই অপবাদকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এতো তোমাদের জন্য কল্যাণকর, তাদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট আছে তাদের কৃত পাপকর্মের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এই ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তার জন্য আছে কঠিন শাস্তি। এ কথা শোনার পর মো’মেন পুরুষ ও নারীগণ কেনো নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করে নি এবং বলে নি: এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ? ….. যখন তোমরা মুখে মুখে এটা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিল না এবং তোমরা একে তুচ্ছ গণ্য করছিলে, যদিও আল্লাহর নিকট এটা ছিল গুরুতর বিষয় (সুরা নূর ১১ – ১৫)।
কাজেই হুজুগপ্রবণ নয় বরং যুক্তিবোধসম্পন্ন, বুদ্ধিমান, জ্ঞানবান মানুষই সমাজের কাম্য, গুজবে বিশ্বাসী লোক কোনোদিন সভ্যজাতির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। আর আল্লাহ স্বয়ং এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে বজ্রকঠিন অবস্থান নিয়েছেন। কোনো মুসলিম দাবিদার তাই হুজুগপ্রবণ যুক্তিবোধহীন হতে পারে না।