দ্বিতীয় হিজরীর সফর মাসে রসুলাল্লাহ (দ.) ষাটজন সশস্ত্র সাহাবী নিয়ে কুরাইশদের বাণিজ্য চলাচল পথে ‘আবওয়া’ অভিযান পরিচালনা করেন। এ অভিযানেও হযরত হামযা (রা.) ছিলেন পতাকাবাহী এবং নেতৃত্বদানকারী। মুসলিম বাহিনী পৌছার আগেই কুরাইশ কাফেলা অতিক্রম করায় এ যাত্রাও কোন সংঘর্ষ ঘটেনি। এমনিভাবে দ্বিতীয় হিজরী সনের ‘উশায়রা’ অভিযানেও হামযা (রা.) মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহীর গৌরব লাভ করেন।
হিজরী দ্বিতীয় সনে ইসলামের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ প্রথম যুদ্ধ ‘বদর যুদ্ধ’ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে হামযার (রা.) বীরত্বগাঁথা ইতিহাসে চির অমলিন হয়ে আছে। রণক্ষেত্রে উভয়পক্ষ কাতারবন্দী হওয়ার পর কুরাইশ পক্ষের উতবা, শায়বা ও ওয়ালিদ সারি থেকে বেরিয়ে এসে রসুলাল্লাহর (দ.) বাহিনীর থেকে কাউকে দ্বন্দ যুদ্ধের আহবান জানায়। তখন রসুলাল্লাহর (দ.) বাহিনীর মধ্যে থেকে তিনজন আনসার মুজাহিদ তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু উতবা চিৎকার করে বলে উঠলো; “মোহাম্মদ, আমাদের সমকক্ষ লোকদেরই পাঠাও, এসব অনুপযুক্ত লোকদের সাথে আমরা লড়তে চাই না।” রসুলাল্লাহ (দ.) আদেশ দিলেন; “হামযা, আলী ও আবু উবায়দা সামনে এগিয়ে যাও।” তাঁরা যেন শুধু রসুলের (দ.) মুখ থেকে আদেশের প্রতীক্ষায়ই ছিলেন। এ তিন জন এগিয়ে গিয়ে প্রতিপক্ষ তিন জনের মুখোমুখি হলেন। প্রথম আক্রমনেই হামযা (রা.) জাহান্নামে পাঠালেন উতবাকে। আলীও (রা.) বিজয়ী হলেন শায়বার উপর। মুহূর্তেই ময়দানে দুই কোরাইশ নেতার লাশ গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু আবু উবায়দা এবং ওয়ালিদের যুদ্ধ একটু প্রলম্বিত হল। অতঃপর আলীর (রা.) সহায়তায় আবু উবায়দা (রা.) ওয়ালিদকেও জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন। তিন জনের এ অবস্থা দেখে কুরাইশদের মধ্য থেকে তুয়াইমা ইবনে আদী ‘ওয়ালিদের’ সাহায্যার্থে এগিয়ে এলে আলী (রা.) তাকে তরবারীর এক আঘাতেই ধরাশায়ী করে ফেলেন। এ যুদ্ধে হামযা (রা.) পাগড়ীর উপর উটপাখির পালক গুঁজে রেখেছিলেন। এ কারণে যে দিকে তিনি যাচ্ছিলেন সুস্পষ্টভাবে তাকে দেখা যাচ্ছিল। দু’হাতে বজ্ব্রমুষ্ঠিতে তরবারী ধরে বীরত্বের সাথে কাফিরদের ব্যুহ তছনছ করে দিচ্ছিলেন। এ যুদ্ধে কুরাইশরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। উমাইয়া ইবনে খালাফ ঐ সময় আব্দুর রহমান ইবনে আউফকে (রা.) জিজ্ঞেস করেছিল; ‘উটপাখির পালক লাগানো এ লোকটি কে’? তিনি যখন বললেন; ‘হামযা’ (রা.) তখন সে বলেছিল; “এ ব্যক্তিই আজ আমাদের সবচেয়ে বেশী সর্বনাশ করেছে”।
মদিনার উপকন্ঠেই ছিল ইহুদী গোত্র বনূ কাইনুকা’র বসতি। রসুলাল্লাহ (দ.) মদিনায় আসার পর সকলের মতো তাদের সাথেও মৈত্রি চুক্তি করেছিলেন। কিন্তু বদর যুদ্ধে মু’মিনদের বিজয় লাভে তাদের অন্তরে হিংসার আগুন জ্বলে উঠে। তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠে। এ চুক্তি ভঙ্গের কারণে রসুল (দ.) দ্বিতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। এ অভিযানেও হামযা (রা.) পতাকাবাহীর দায়িত্ব পালন করেন।
বদরের শোচনীয় পরাজয়ে কুরাইশদের আত্ম অভিমান দারুণভাবে আহত হয়। প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্ত বিশাল কুরাইশ বাহিনী হিজরী তৃতীয় সনে মদিনার দিকে ধাবিত হয়। আল্লাহর রসুল (দ.) সঙ্গীদের নিয়ে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাদের গতিরোধ করেন। শাওয়াল মাসে যুদ্ধ শুরু হয়। কুরাইশদের পক্ষে ‘সিবা’ নামক এক জওয়ান এগিয়ে এসে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান জানায়। হামযা (রা.) উন্মুক্ত তরবারী হাতে ময়দানে এসে হুঙ্কার ছেড়ে বললেন; “ওরে উম্মে আনমারের অপবিত্র পানির সন্তান, তুই এসেছিস আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধে লড়তে”? এ কথা বলে তিনি এমন প্রচন্ড আক্রমণ চালালেন যে, এক আঘাতেই ‘সিবা’র তর্জন গর্জন চিরতরে খতম। তারপর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। হামযার (রা.) ক্ষিপ্র আক্রমণে কাফিরদের বুহ্য তছনছ হয়ে গেল। এ যুদ্ধে তিনি একাই ত্রিশ জন কাফির হত্যা করেন।
যেহেতু হযরত হামযা (রা.) বদর যুদ্ধে কুরাইশদের বাছাবাছা নেতৃবৃন্দকে হত্যা করেছিলেন, এ কারণে কুরাইশদের সকলেই তাঁরই খুনের পিয়াসী ছিল সবচেয়ে বেশী। হামযার হত্যাকারী ‘ওয়াহশী’ ওহুদের ময়দানে হামযার হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলে; “আমি ছিলাম জুবাইর ইবনে মুত’ইমের ক্রীতদাস। বদর যুদ্ধে জুবাইরের চাচা ‘তুয়াইম ইবনে আদী’ হামযা (রা.) এর হাতে নিহত হয়। মক্কায় ফিরে জুবাইর আমাকে বললো, যদি তুমি মোহাম্মদের (দ.) চাচা হামযাকে (রা.) হত্যা করে আমার চাচার হত্যার বদলা নিতে পার, তাহলে আমি তোমাকে মুক্তি দিব। আমাকে সে বিশেষ ট্রেনিং দিল। আমি শুধু হামযাকে (রা.) হত্যার উদ্দেশ্যে উহুদের দিকে রওয়ানা হলাম। যুদ্ধ শুরু হলো, একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে হামযার প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমার প্রতীক্ষার অবসান হল। আমি নিরাপদ দূরত্ব থেকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে হামযাকে (রা.) নিখুঁতভাবে নিশানা করে আমার বর্শা নিক্ষেপ করলাম। বর্শাটি হামযার পেট দিয়ে ঢুকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল। তিনি তখন আমার দিকে লক্ষ করে এগুতে চাইলেন। কিন্তু আঘাতের তীব্রতার জন্য পথিমধ্যেই পড়ে গেলেন। এভাবেই হামযা (রা.) শহীদ হলেন। তারপর আমি আমার স্বপক্ষ সৈন্যদের নিকট এসে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকলাম। কারণ, আমার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে। আমি মক্কায় ফিরে এলে আমাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।”
এ মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হয় তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের মাঝামাঝি। হামযার বয়স তখন আনুমানিক আটান্ন। হামযার (রা.) শাহাদতের খবরে কুরাইশ রমণীরা আনন্দে সংগীত ও নৃত্য করেছিল। আবু সুফিায়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতে উতবা হামযার নাক-কান কেটে অলঙ্কার বানিয়েছিল, বুক চিরে কলিজা বের করে চিবিয়ে থুথু নিক্ষেপ করেছিল। এ কথা শুনে রসুল (দ.) জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সে কি কলিজার কিছু অংশ খেয়েও ফেলেছিল’? লোকেরা বলেছিল, ‘না’। তখন রসুল (দ.) বলেছিলেন; “হামযার (রা.) দেহের কোন একটি অংশও আল্লাহ জাহান্নামে যেতে দেবেন না”।
যুদ্ধ শেষে শহীদের দাফন-কাফনের পালা শুরু হলো। রসুল (দ.) তাঁর সম্মানিত চাচার লাশের কাছে এলেন। যেহেতু হিন্দা তাঁর নাক-কান কেটে বিকৃত করে ফেলেছিল, তাই এ দৃশ্য দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন। তিনি বললেন; “কিয়ামাতের দিন হামযা হবে ‘সাইয়্যেদুশ শুহাদা’ বা সকল শহীদের নেতা”। এরপর তিনি চাচার নিথর শহীদ দেহের প্রতি লক্ষ করে বলেন, “তোমার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হউক। আমার জানামতে তুমি ছিলে আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপারে অধিক সচেতন, অতিশয় সালেহ্। যদি সাফিয়্যার শোকগাঁথা ও দুঃখের কথা আমার মনে না থাকতো তাহলে এভাবেই তোমাকে ফেলে রেখে যেতাম, যাতে পশু পাখি তোমাকে খেয়ে ফেলতো এবং কিয়ামতের দিন তাদের পেট থেকে আল্লাহ তোমাকে জীবিত করতেন। আল্লাহর কসম! তোমার প্রতিশোধ নেওয়া আমার উপর অত্যাবশ্যক। আমি তাদের সত্তর জনকে তোমার মতো নাক-কান কেটে বিকৃত করবো।” রসুলাল্লাহর (দ.) এ কসমের প্রেক্ষিতে সূরা ‘নাহল’ এর ১২৬-৭ নং আয়াত নাযিল হয়।
সাফিয়্যা (রা.) ছিলেন হামযা (রা.) এর সহোদরা। ভাইয়ের শাহাদাতের খবর শুনে তাঁকে এক নজর দেখার জন্য তিনি দৌড়ে আসেন। ভাইয়ের দেহের এমন অবস্থা সহ্য করতে পারবেন না বিধায় রসুলাল্লাহ (দ.) তাঁকে দেখতে না দিয়ে কিছু সান্তনা দিয়ে ফিরিয়ে দেন। ভাইয়ের কাফনের জন্য সাফিয়্যা (রা.) দু’খানি চাদর পাঠান। কিন্তু হামযার (রা.) পাশেই আরেক সাহাবির নিথর দেহ কাফনহীন অবস্থায় পড়েছিল। তাই চাদর দু’খানি দু’জনের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। হামযাকে (রা.) ওহুদের ময়দানেই দাফন করা হয়। রসুলাল্লাহ ওহুদ যুদ্ধের শহীদদের থেকে দু’জন করে একটি কবরে দাফন করা হয়। জাবির (রা.) বলেন; “মুয়াবিয়া যেদিন ওহুদে কূপ খনন করেছিলেন, সেদিন আমরা ওহুদের শহীদদের জন্য কান্নাকাটি করছিলাম। খনন করতে গিয়ে এক ব্যক্তি হামযার (রা.) পায়ে আঘাত করলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে পড়ে”।
এই হলেন মহান সাহাবী রসুলাল্লাহর (রা.) চাচা হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রা.)। মানব ইতিহাসে যার নাম কিয়ামত পর্যন্ত চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।