মোহাম্মদ আসাদ আলী:
পাপমুক্তি ও আত্মশুদ্ধির আকুল বাসনা নিয়ে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ পবিত্র মক্কায় হজ্ব করতে যান। কিন্তু সেই পাপমুক্তি ও আত্মশুদ্ধি কীভাবে অর্জিত হবে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি কখনও? সাধারণত হজ্বে যাবার পূর্বে সবাইকে নিয়ম-কানুন, দোয়া-দরুদ শেখানো হয় যত্ন করে। কিন্তু হজ্ব কীভাবে আমাদের পাপমুক্ত করে তা কোথাও শেখানো হয় না। হজ্ব কীভাবে আমাদের পাপমুক্ত করে তা জানতে হলে কয়েকটি বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। যেমন-
প্রথমত, হজ্বের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা বা আকীদা সহিহ থাকতে হবে। এটা ইসলামের একেবারে মৌলিক একটি কথা যে, আকীদা ছাড়া ঈমানের কোনো দাম নেই। সুতরাং শুধু হজ্ব করাই যথেষ্ট নয়, হজ্ব কেন, আল্লাহ কেন হজ্বের বিধান দিয়েছেন সেটাও জানতে হবে। জানতে হবে হজ্বের মাধ্যমে জাতিকে কী শিক্ষা দেওয়া হয়। হজ্ব যদি নিছক আত্মশুদ্ধি’র মাধ্যম হত, আধ্যাত্মিক বিষয় হত, তাহলে সেটা যার যার দেশেই পালন করা যেত। হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে একটি নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। আসলে হজ্ব কেবল আধ্যাত্মিক বিষয় নয়, নিছক আনুষ্ঠানিকতাও নয়। হজ্বের মাধ্যমে আল্লাহ এ জাতিকে নানামুখী শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কিন্তু উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলার দরুন সেসব শিক্ষা আমরা অনুধাবন করতে পারি না। যিনি হজ্ব করবেন তাকে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানতেই হবে। যেমন- হজ্বে কেন যাবেন? হজ্ব কাদের জন্য? আরাফাতের ময়দানে জমায়েত হবার কারণ কী? হাজ্বীদের উদ্দেশ্যে ইমামের খোৎবার উদ্দেশ্য কী এবং অর্থ কী? সেলাইবিহীন দুই প্রস্থ সাদা কাপড় পরার কারণ কী? আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলে ক্বাবা তাওয়াফ করার অর্থ কী? সাফা-মারওয়া দৌড়াদৌড়ি করবেন কেন? শয়তানকে পাথর মারার অর্থ কী? কালো পাথরে চুমু খাওয়ার উদ্দেশ্য কী? পশু জবাইয়ের উদ্দেশ্য কী? সামষ্টিকভাবে হজ্ব মুসলিম উম্মাহ বা মানবজাতির কী উপকার করে? এসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর জানা থাকলে হজ্ব সার্থক হবে।
ইসলামের অন্যান্য বিধানের মত হজ্বের বিধানও কেবল মু’মিনদের জন্য। হজ্ব হচ্ছে সারা বিশ্বের মু’মিনদের ঐক্যের প্রতীক। এ কারণে বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে আল্লাহর রসুল বারবার জাতিকে ঐক্যের কথা, ভ্রাতৃত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মুসলিম জাতি কখনও উদ্দেশ্যহীন, লক্ষ্যহীন থাকতে পারে না। তাদের লক্ষ্য আল্লাহ ঠিক করে দিয়েছেন। সেটা হচ্ছে- সমস্ত পৃথিবী থেকে অন্যায়, অবিচার, হানাহানি, রক্তপাত, শোষণ, নির্যাতন বন্ধ করে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করা। এ কাজের জন্য জাতির মধ্যে প্রধান যে চারিত্রিক গুণগুলো থাকা দরকার তা হচ্ছে- ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য। বাহ্যিকভাবে হজ্বের উদ্দেশ্য এই ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য সৃষ্টি করা। আর আধ্যাত্মিকভাবে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে হাজির-নাজির জানা এবং হাশরের ময়দানে তার সামনে সকলকে দণ্ডায়মান হয়ে দুনিয়ার যাবতীয় কর্মের হিসাব দিতে হবে- এই আত্মিক দায়বদ্ধতা উপলব্ধি করানো। সারা পৃথিবী থেকে মুসলিমরা হজ্বে গিয়ে আরাফাতের ময়দানে একত্রিত হবার মাধ্যমে ঐক্যের প্রশিক্ষণ লাভ করেন। তাদের জাতীয় চেতনা গড়ে ওঠে যে, আমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি, যে অবস্থাতেই থাকি, আমরা এক জাতি, আমরা ঐক্যবদ্ধ। হজ্বের যত আনুষ্ঠানিকতা আছে তার সবই জাতিকে বিভিন্নভাবে ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করার প্রশিক্ষণ প্রদান করে। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি হয়। সেই সাথে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার দায়বদ্ধতাও তৈরি হয়।
দ্বিতীয়ত, ঐক্য-সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির এই মিলনমেলা থেকে শিক্ষা নিয়ে মু’মিনরা নিজ দেশে ফেরত যাবে এবং জাতির মধ্যে ঐক্য স্থাপনে আত্মনিয়োগ করবে- এটাই স্বাভাবিক। তারা ঐক্যের গুরুত্ব বুঝবে। ঐক্য নষ্ট হয় এমন কথা বা কাজ তারা কখনই করবে না। কেউ জাতির মধ্যে ঐক্য বিনষ্ট করার সামান্য চেষ্টা করলেও তারা বাধা দিবে। এতে কেবল মুসলমানরাই উপকৃত হবে তা নয়, প্রকারান্তরে সমগ্র মানবজাতিই উপকৃত হবে।
তৃতীয়ত, শিরক না করার অঙ্গীকার। হজ্বের ময়দানে সমবেত কণ্ঠে উচ্চারিত হয় যে ধ্বনিটি তা হচ্ছে- লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বায়েকা লা শারীকা লাকা লাব্বায়েক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতাকা লাকা ওয়ার মূল্ক লা শারিকালাক্- আমি হাজির, হে আল্লাহ তোমার সম্মুখে হাজির, তোমার কোন শরিক নেই, নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই এবং তাবৎ রাজত্ব ও সার্বভৌমত্ব তোমারই, তোমার কোন শরিক নেই।
আল্লাহর আদেশ-নিষেধের কিছু মানলাম আর কিছু মানলাম না- এটাই হচ্ছে বড় শিরক। কাজেই আল্লাহর হুকুমকে সামগ্রিক জীবনে মান্য করার অঙ্গীকারই হচ্ছে শিরক থেকে মুক্ত থাকা। হজ্বের ময়দানে এই অঙ্গীকার করা হয়। হজ্বের ময়দানে এই সাক্ষী দিয়ে বা শিরক না করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে যখন মু’মিনরা নিজ দেশে ফেরত যাবে তখন তারা নিজেরা যেমন শিরক থেকে দূরে থাকবে জাতিকেও শিরকমুক্ত রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। এতেও জাতি অত্যন্ত লাভবান হবে।
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে হজ্বের এই প্রশিক্ষণগুলো যথাযথভাবে হৃদয়ে ধারণ করে মুসলিমরা যখন নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে তার প্রতিফলন ঘটাতে থাকবে, তখন স্বভাবতই একদিকে তারা ব্যক্তিগতভাবে আত্মিক উৎকর্ষতা অর্জন করবে, অন্যদিকে জাতি তার লক্ষ্য অর্জনে অনেকদূর এগিয়ে যাবে। হজ্বকে আত্মশুদ্ধি বা পাপমুক্তির মাধ্যম বলার কারণ এটাই। অথচ বাস্তবে আমরা যা দেখছি তা ভিন্ন চিত্র। সারা পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ মুসলিম জাতির ঐক্যের কেন্দ্রভূমি মক্কায় একত্রিত হন, কিন্তু কেন আল্লাহ হজ্বের বিধান দিয়েছেন সেটাই তাদের অজানা। হজ্বকে তারা নিছক আধ্যাত্মিক বিষয় বা উপাসনা হিসেবে পালন করেন। তারা পাপমুক্তির জন্য হজ্বে যান, হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা পুংখানুপুংখভাবে মেনে চলেন, তারপর হজ্ব শেষে চুপচাপ বাড়ি ফিরে যান। ঐক্য-সম্প্রীতির কোনো শিক্ষা না তারা নিজেরা গ্রহণ করেন, না জাতিকে শিক্ষা দেন। তারা হজ্ব করেন আর জাতি শিরকের সমুদ্রে হাবুডুবু খায়। সম্প্রীতি-ভ্রাতৃত্ব অধরাই থেকে যায়। মুসলিমের হাতে মুসলিমের রক্ত ঝরে। দিন দিন অনৈক্য-সংঘাত, প্রতারণা, দুর্নীতি, হিংসা, বিদ্বেষ, রক্তপাত ধাই ধাই করে বাড়তে থাকে। এমতাবস্থায়, এই হজ্ব প্রকৃতপক্ষেই আমাদের পাপমুক্ত করতে সক্ষম হচ্ছে কিনা তা নিয়ে ভাবতে হবে গভীরভাবে। হজ্বের প্রকৃত শিক্ষা যদি আমরা হৃদয়ে ধারণ করি এবং জাতির মধ্যে সেটার প্রতিফলন ঘটাই তবেই হবে প্রকৃত পাপমুক্তি।