মসীহ উর রহমান :
মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুগে যুগে মানুষ শান্তি পেয়েছে একমাত্র স্রষ্টা প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী চোলে, তথা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে। অন্য কোনো পন্থা বা বিধান মানুষকে শান্তির সন্ধান দিতে পারে নি। কারণ, যেহেতু মানুষ সৃষ্টি করেছেন স্রষ্টা কাজেই তিনিই ভালো জানেন কোন বিধান মেনে চললে মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, আর কোন বিধান অশান্তি সৃষ্টি করবে। তাই বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে নবী-রসুল-অবতার পাঠিয়ে স্রষ্টা মানুষকে সত্যের মার্গ প্রদর্শন করেছেন। যখন মানুষ সে পথে জীবন নির্বাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন তাদের জীবনে নেমে এসেছে অনাবিল শান্তি। আর যখন এবলিস বা কলির প্ররোচনায় পড়ে সেই সহজ সত্যকে অস্বীকার করেছে, স্রষ্টার বিধান প্রত্যাখ্যান করেছে বা বিকৃত করেছে তখনই তাদের জীবনে নেমে এসেছে অন্যায়-অবিচার-অশান্তির ঘন কালো ছায়া। বিভিন্ন ধর্মের বিকৃতিগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অধিকাংশ সময়ই ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মের আত্মিক ভাগ তথা মানবতাকে নষ্ট করে ধর্মকে নির্জীব-মৃত জীবনব্যবস্থায় পরিণত করেছে। ধর্মের বিধি-বিধান, নিয়ম-কানুন সব ঠিক থাকলেও সেগুলোর উদ্দেশ্য যে মানুষের কল্যাণ, মানবজীবনে শান্তি আনয়ন করা সে শিক্ষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে ভারসাম্য হারিয়ে ধর্ম পরিণত হয়েছে নিপীড়নের কলে। পরবর্তীতে ধর্মের হারিয়ে যাওয়া ঐ আত্বিক ভাগটাকে যথাস্থানে অধিষ্ঠিত করার জন্য স্রষ্টাকে নতুন নবী-রসুল-অবতার পাঠাতে হয়েছে। আবার এমনও হয়েছে যে ধর্মের আধ্যাত্মিক ভাগটাকেই মানুষ আঁকড়ে ধরে রেখেছে, কিন্তু তার জাতীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিধি-বিধান, আইন-কানুনকে অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান করে অকার্যকর করে রাখা হোয়েছে। এর পরিণতিতেও মানুষ অনিবার্য অশান্তিতে পতিত হোয়েছে।
আজকের পৃথিবীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা এমন চিত্রই দেখতে পাই। দেখা যাচ্ছে- ধর্মভীরু মানুষগুলো মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা, সিনাগগে ঢুকে অকৃত্রিম ভক্তিসহকারে নামাজ-রোজা, পূজা-অর্চনা, উপাসনা, যপ, তপস্যা, প্রার্থনা ইত্যাদি করে যাচ্ছে। কিন্তু জাতীয়ভাবে তারা যে স্রষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করে পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার তৈরি তন্ত্র-মন্ত্রকে গ্রহণ করে কার্যত অশান্তিকে বরণ করে নিয়েছে সে সম্পর্কে তারা বেখেয়াল। তারা আছে তাদের পরকালীন নাজাতের আশায়, স্রষ্টার সান্নিধ্য অর্জন করে জান্নাত, স্বর্গ, হ্যাভেনে প্রবেশের আশায়, মোক্ষ-নির্বান লাভের আশায়। পার্থিব শান্তি-অশান্তির সাথে যেন তাদের কোনোই সম্পর্ক নেই।
কিন্তু তারা এটা বোঝেন না যে, স্রষ্টা মন্দির-মসজিদ, গীর্জা, প্যাগোডার চার দেয়ালের অভ্যন্তরে আবদ্ধ নন। পূজা-অর্চনা, উপাসনা দিয়ে স্রষ্টার কোনো লাভ হয় না, স্রষ্টা কারও পূজার কাঙাল নন। তিনি অমুখাপেক্ষী। কাজেই পূজা-অর্চনা, নামাজ-রোজা-প্রার্থনার উপর স্রষ্টার সন্তুষ্টি নির্ভর করে না, স্রষ্টার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি নির্ভর করে মানবজীবনে বিরাজিত শান্তি-অশান্তির উপর। জালিমরা যখন অন্যায়-অবিচার, শোষণ, নির্যাতন ও অত্যাচারের কষাঘাতে সাধারণ মজলুম জনতাকে জর্জরিত করে ফেলে, তখন সাধারণ এই মানুষগুলোর আর্ত চীৎকারে স্রষ্টা ব্যথিত হন। সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য ইত্যাদির প্রকোপে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর আদম সন্তান যখন অসহায় হয়ে পড়ে, অশ্র“পাত করে, হাহাকার করে, তখন ঐ ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তিনি কষ্ট পান। কারণ তিনি সকলের স্রষ্টা। তিনি যেমন ধনীর স্রষ্টা, তেমন গরীবেরও স্রষ্টা। তিনি যেমন সাদার স্রষ্টা, তেমন কালোরও স্রষ্টা। সৃষ্টি কষ্ট পেলে স্রষ্টা সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না। সে কারণেই তিনি মানবজাতির একমাত্র করণীয় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন- মানুষের শান্তির জন্য সংগ্রাম করা, তথা মানুষের কষ্ট নিবারণ করা। এ কাজ করাই মানুষের এবাদত। অথচ আজকের ধার্মিকদের সেদিকে কোনো নজর নেই। তারা সাধারণ, নিরীহ, বুভুক্ষু হাড্ডিসার, নিপীড়িত মানুষগুলোকে যালেম, অত্যাচারীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে মসজিদে-মন্দিরে-গির্জায় আর প্যাগোডায় গিয়ে শান্তির জন্য প্রার্থনা কোরছেন। আবার প্রার্থনা শেষে চুপচাপ বাড়ি-ঘরে ফিরে আসছেন। সমাজের নিপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিত অত্যাচারিত মানুষগুলোর প্রতি যেন তাদের কোনোই দায়িত্ব নেই, কর্তব্য নেই। এ কেমন ধর্ম-কর্ম?
যুগে যুগে মহাপুরুষগণ, নবী-রসুল-অবতারগণ আমাদেরকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াই হচ্ছে ধর্ম। বলা হয়েছে- যা দ্বারা লোকরক্ষা হয় সেটাই ধর্ম, সেটাই এবাদত। আমাদেরকে এখন এই এবাদত করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে তার জন্য ঐক্য অপরিহার্য। ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। যুগে যুগে মহামানবগণ ছিন্ন-ভিন্ন, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত মানুষকে এক ছাতার নিচে দাঁড় করিয়ে শান্তির পথ সুগম করেছেন। সেই ঐক্যেরই আহ্বান করেছেন যামানার এমাম, এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। এমামুয্যামান নিজের জীবন ও সমস্ত সম্পদকে মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আমরা হেযবুত তওহীদের প্রত্যেকে তাঁর আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করার চেষ্টা করছি সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
সকল ধর্মই এসেছে একই স্রষ্টার পক্ষ থেকে। প্রকৃতপক্ষে মানবজাতি একই জাতি, এক পিতা মাতার (আদম-হাওয়া, আদম-হব্যবতী, অ্যাডম-ইভ) সন্তান। তাই আসুন আমরা আমাদের আদি পরিচয়ে ফিরে যাই। একে অপরের ভাই-ভাই হয়ে যাই। আমরা বলছি না যে, সবাইকে এক ধর্মে আসতে হবে। তার প্রয়োজনও নেই। সকল ধর্মই যেহেতু স্রষ্টা প্রদত্ত কাজেই এর যে কোনোটি সঠিকভাবে মেনে চললে শান্তি আসতে বাধ্য। তাই আমাদের কথা হলো, যে যে ধর্মই মেনে চলুন না কেন সেটাকে পরিপূর্ণভাবে মেনে চলুন, অন্য ধর্মাবলম্বীদেরকে আপন ভাই জ্ঞান করুন, যুগে যুগে আগত সকল নবী-রসুল-অবতারগণকে সম্মান করুন। মানবতাই মনুষ্যের ধর্ম, মানবতাই মুক্তির পথ। মানবজীবনের সর্ব অঙ্গনে মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করুন। আর এই মানবতা প্রতিষ্ঠিত হবে একমাত্র স্রষ্টার দেওয়া বিধান মেনে জীবনযাপন করলে। কাজেই স্রষ্টার দেওয়া বিধানই হোক মানবজাতির মেলবন্ধন।
লেখক: আমীর, হেযবুত তওহীদ