মোহাম্মদ আসাদ আলী
শত শত বছর এদেশে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে এসেছে। বিপদ আসলে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করেছে। একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনা ভাগাভাগী করে নিয়েছে। তাতে ধর্ম বাধ সাধে নি। অথচ আজ ধর্মের নামে কী ভয়াবহ বিদ্বেষ ও ঘৃণা বিস্তার করা হচ্ছে। ধর্ম রক্ষার হুজুগ তুলে এক সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যে বিভক্তির বীজ বুনে গেছে ইংরেজ শাসকরা, দিনকে দিন সেই বিষবৃক্ষ ডালপালা মেলে সমস্ত সমাজকে আচ্ছাদিত করে ফেলছে।
ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হলো। আমরা পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা অন্তর্ভুক্ত হলাম পাকিস্তানের সঙ্গে। ভাবলাম এবার বুঝি ‘ইসলাম’ পাব। অচিন্তনীয় ন্যায়, সাম্য ও মানবাধিকারে ভরে উঠবে আমাদের সমাজ! কিন্তু অচিরেই সেই ভুল ভাঙল যখন ইসলামের আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা নব্য উপনিবেশবাদ কায়েম করতে লাগলো, আর ধর্ম নিয়ে যথারীতি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিল অব্যাহত রইল। কোনো কল্যাণকর বস্তুকেও যদি সঠিক ব্যবহারের বদলে অপব্যবহার করা হয় সেটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। ধর্মও তা-ই। এটি এক মহাশক্তি, এই শক্তির সঠিক প্রবাহ দেশ ও জাতির প্রভূত কল্যাণসাধন করতে পারত, কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ীদের কারণে। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে ধর্মের অপব্যবহার শুরু হলো, ফলে একদিকে ধর্মীয় আদর্শ মারাত্মকভাবে বিকৃত হতে লাগলো; অন্যদিকে দীর্ঘদিন মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইত্যাদির কারণে এতদঞ্চলের সমাজজীবনে আবহমান কাল থেকে যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার চিত্র দেখা যেত সেটা ক্ষুণœ হতে লাগলো। মানুষগুলো হয়ে উঠল শত্রুভাবাপন্ন।
স্বভাবতই ধর্মের নামে এই সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ, বঞ্চনা, বিভক্তি আর অপরাজনীতি উপহার পেয়ে বিদ্রোহে ফুঁসে উঠল পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী জনতা। আজকের এই দিনে, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, তার ডাকে সাড়া দিয়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যে দেশের জন্ম, স্বাধীনতার পরে সে দেশটি অসাম্প্রদায়িকতার মডেল হবার কথা। কিন্তু সেই অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা আর গড়ে উঠল না। আজ ৪৭ বছর পেরিয়ে এসে যে বাংলাদেশের চিত্র পাই, এই অপরাজনীতি, ধর্মব্যবসা ও সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকারে পথ হারানো বাংলাদেশ দেখার জন্য যে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেন নি। আজ বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটছে?
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে মুসলিমদের উপর নির্যাতন হলে আমাদের দেশে অমুসলিমদের দিকে আঙ্গুল তোলা হয়, এই অপরাধে তাদের বসতভিটেয় হামলা চালানোর নজিরও আছে। একজনের অপরাধে অন্যজনকে শাস্তি দেওয়া কি ইসলামের শিক্ষা? ওয়াজে, খুতবায়, বই-পুস্তকে, জেহাদী আলোচনায় ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও সন্ত্রাসীপনার দিকে চালিত করা হয়। আল্লাহর রসুল ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনাপ্রধান। সত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অনেক যুদ্ধ তাঁকে করতে হয়েছে, কিন্তু এমনভাবে সেই ইতিহাসগুলোকে বর্ণনা করা হচ্ছে যেন তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে নয়, অমুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। বিশেষ করে মানুষকে ধর্মান্তরিত করার জন্য যুদ্ধ করেছেন তিনি। এসব কথা বলে তারা বোঝাতে চান যে, বিধর্মীদের সাথে মুসলমানদের কোনো আপস চলবে না!
আবার রসুলাল্লাহ বিচারক ছিলেন বিধায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে হয়ত কোনো ব্যক্তিকে দ- প্রদান করেছেন, কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা সেই ঘটনার অপব্যাখ্যা দিচ্ছে যে, শুধু আল্লাহর রসুলকে গালি দেওয়ার কারণেই ইহুদি লোকটিকে হত্যা করা হয়েছিল, কাজেই বিরানব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে রসুলকে কটুক্তি করলে তাকেও হত্যা করা হবে ইত্যাদি। এই যে এরা মানুষের কল্লার দাম হাঁকাচ্ছেন, যুদ্ধের আয়াত দেখিয়ে যুদ্ধের ফতোয়া দিচ্ছেন, তাদেরকে এই দায়িত্ব কে দিল? আল্লাহর রসুল যুদ্ধ করেছেন, সন্ধি করেছেন, চুক্তি করেছেন, গণিমত নিয়েছেন- এইসবই রাষ্ট্রীয় পদাধিকার বলে করেছেন, আমাদের এই মুফতিরা কোন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে এসব ফতোয়া দিচ্ছেন? আমাদের জাতি কি তাদের হাতে বিচারকের দায়িত্ব অর্পণ করেছে।
এটা সত্য যে, ফেসবুকে ব্লগে একটি ইসলামবিদ্বেষী শ্রেণি আল্লাহ-রসুলকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে, যা সুস্থচিন্তার মানুষমাত্রই মেনে নিতে পারবেন না। একজন ঈমানদার মানুষ যিনি নিজের প্রাণের চেয়ে আল্লাহ-রসুলকে বেশি ভালোবাসেন তার সামনে যখন রসুলকে অকথ্য ভাষায় গালি দেওয়া হয় তখন তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ না হয়ে পারে না! কিন্তু এর বিহিত করবেন কীভাবে? সেখানেই আমাদের কথা।
প্রথমত, এর জন্য দেশে আইন আছে, আদালত আছে। দেশের প্রচলিত আইনে তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়া করানো যায়। কিন্তু কোনোভাবেই আইন হাতে তুলে নেবার সুযোগ নেই। আর একজনের একটি পোস্ট পড়ে উত্তেজিত হয়ে সমগ্র গ্রামবাসী মিলে ঐ ব্যক্তির পুরো সম্প্রদায়ের উপর হামলে পড়া- এই বর্বরতার কোনো স্থানই ইসলামে নেই। এগুলো করে আদতে ইসলামের কোনো উপকার হয় না, ইসলামকে সংকীর্ণ একটি ধর্মাদর্শ বলে প্রতিপন্ন করা হয় মাত্র।
দ্বিতীয়ত, যারা ইসলামের সমালোচনা করে লেখালেখি করে থাকে তাদের সমালোচনার যৌক্তিক জবাব দেওয়া প্রয়োজন। যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে তাদের মিথ্যাচারকে ভুল প্রমাণ করতে হবে, তাহলে মানুষ ঐ অপপ্রচারকারীদেরকেই ঘৃণা করবে, তাদেরকে বয়কট করবে। কিন্তু লেখালেখির জবাব যখন চাপাতি দিয়ে দেওয়া হয় তখন এটিই প্রমাণিত হয় যে, আমাদের কাছে এমন কোনো যুক্তি প্রমাণ নেই যা দিয়ে আমরা তাদেরকে সদুত্তর দিতে পারি। এতেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইসলাম। আমরা যদি আল্লাহর রসুলের জীবনী দেখি তাহলে কী পাই? তাঁকে কি কম সমালোচনার মুখোমুখী হতে হয়েছে? কম বিদ্রুপের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি? তিনি তো কোনোদিন আবু জহেল, ওতবা, শায়বাদের হত্যা করতে লোক পাঠান নি, বরং বারবার তাদের কাছে গেছেন, বারবার বুঝিয়েছেন, কোনো বিদ্রƒপ আর অপমানকেই গায়ে মাখেন নি, অবিচলিত থেকে তওহীদের উপর মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। অবশেষে দেখা গেল যে মানুষগুলো তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল তারাই তাঁর সামনে স্বেচ্ছায় নিজেদেরকে সমর্পণ করল। সেই সুন্নাহ ভুলে গিয়ে গুপ্তহত্যা, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা ভাঙচুর ইত্যাদির ফল হয়েছে এই যে, ইসলাম সম্পর্কে যুক্তিশীল মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি তাই ইসলামের নাম করে কার্যত ইসলামের বিরুদ্ধেই কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে।
কিছুদিন আগেও ধারাবাহিকভাবে হিন্দু পুরোহিত/সেবায়েত হত্যার ঘটনা ঘটেছে, যার দায় স্বীকার করেছে কোনো না কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী। গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা করে বিদেশি মেহমানদের জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। একের পর এক ব্লগার, লেখককে চাপাতির কোপে হত্যা কর হয়েছে। এই হত্যাকা-গুলো আন্তর্জাতিক মিডিয়া লুফে নিয়েছে, পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরাও এগুলো পছন্দ করে, বেশি বেশি শুনতে চায়। কারণ এ ইস্যুগুলো কাজে লাগিয়েই সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বিশ্বের দেশে দেশে আগ্রাসন চালায়। বাংলাদেশে যখন কোনো সংখ্যালঘু গ্রামে হামলা হয়, পাশ্চাত্যের মিডিয়াগুলো ফলাও করে সেই খবর প্রচার করে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বিরূপ ধারণা গড়ে তোলে যে, এই দেশের মানুষ জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন, এখানে ভিন্নমতের মানুষ নিরাপদ নয়। সম্প্রতি রংপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলার ঘটনা দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তোলে। তবে সবচাইতে নির্মম ও হৃদয়বিদারী ঘটনাটি ঘটে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার পোরকরা গ্রামে। অন্যান্য ঘটনার সাথে এটার পার্থক্য হচ্ছে, অন্যগুলোয় ইসলামবিদ্বেষী কোনো লেখক বা ব্লগারকে টার্গেট করে হামলা হয়েছে, অথবা সংখ্যালঘুদেরকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। কিন্তু নোয়াখালীতে হামলার শিকার হয় হেযবুত তওহীদের সদস্যরা, যারা উদয়াস্ত গায়ের রক্ত পানি করে সংগ্রাম করে চলেছেন আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করার জন্য, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতিকে আদর্শিকভাবে সচেতন করে তোলার জন্য।
ঘটনার সূত্রপাত হেযবুত তওহীদের সর্বধর্মীয় সভা-সমাবেশকে কেন্দ্র করে। দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক গুপ্তহত্যা শুরু হলে আমরা হেযবুত তওহীদ উদ্যোগ নিই ক্রমাগত সর্বধর্মীয় সভা-সমাবেশ আয়োজন করে দেশের সকল ধর্মের মানুষকে সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র ও উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে। আমাদের আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে, আলোচনা সভায়, প্রমাণ্যচিত্র প্রদর্শনীতে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ দুই হাত তুলে যাবতীয় অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ঐক্যমত পোষণ করতে থাকেন। কিন্তু এরই মধ্যে কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দলের চক্ষুশূলে পরিণত হই আমরা! কারণ আমরা বলেছি ধর্মের কাজ করে রাজনৈতিক/অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করা যাবে না, করলে সেটা হবে ধর্মব্যবসা। কোর’আনে আল্লাহ ধর্মের বিনিময় গ্রহণ করতে কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছেন!
আমাদের এই বলিষ্ঠ উচ্চারণ তাদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করার উপায় তালাশ করতে থাকে এবং এমন সুযোগ খুঁজতে থাকে যেন খুব সহজেই আমাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে তোলা যায়! এক পর্যায়ে সেই সুযোগটি তারা পেয়ে যায় যখন হেযবুত তওহীদ সকল ধর্মের মানুষ নিয়ে সভা-সমাবেশ শুরু করে। সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে এই শ্রেণিটি এমনিতেই পটু! ইতোমধ্যেই তারা সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রচ- বিদ্বেষভাব তৈরি করে রেখেছে। কাজেই খুব বেশি বেগ পেতে হয় নাই, তারা শুধু প্রচার শুরু দিল – হেযবুত তওহীদ সর্বধর্মীয় ঐক্য চায়, সুতরাং ওরা কাফের, ওরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের দালাল, ইসলামের শত্রু ইত্যাদি। আমাদের বিরুদ্ধে একটি হ্যান্ডবিল রচনা করা হয় যার শিরোনাম হচ্ছে ‘হেযবুত তওহীদ একটি কুফরি সংগঠন’ এবং সেটা সোনাইমুড়ির স্থানীয় মসজিদে মসজিদে বিলি করে ও খুতবা দিয়ে মানুষকে হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তোলা হয়। এরপর শুরু হয় তা-ব। ‘হেযবুত তওহীদ খ্রিষ্টান এবং তারা বাড়িতে গির্জা নির্মাণ করছে’- এই হুজুগ তুলে ঐ রাজনৈতিক দলগুলোর হাজার হাজার কর্মী সমর্থক ধারালো অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে এবং আমাদের দুইজন সদস্যকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে প্রকাশ্য দিবালোকে জবাই করে, চোখ উপড়ে, রগ কেটে হত্যা করে। হত্যার পর লাশে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। দেশের প্রায় সবগুলো পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে খবরটি প্রচারিত হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, বর্বরোচিত এই হত্যাকা-টি তারা ঘটায় ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ, অর্থাৎ স্বাধীনতার মাসেই। যেই মাসে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর সেই মাসেই দুইজন মানুষকে জবাই করে হত্যা করা হলো ‘খ্রিষ্টান’ আখ্যা দিয়ে, একটি স্বাধীন দেশের জন্য এর চাইতে পরিহাসের বিষয় আর কী হতে পারে?
যদি তাদের দাবি সত্যই হত, অর্থাৎ হেযবুত তওহীদ খ্রিষ্টান হত, তারপরও কি তাদের এই হামলা ইসলামসিদ্ধ হয়? নাকি দেশের আইনে অনুমোদিত? এ কোন বিকৃত চিন্তাধারা তাদের? তাদের এই সাম্প্রদায়িকতার ইসলাম, এই হুজুগ ও গুজবনির্ভর ইসলাম কি আল্লাহ-রসুল শিক্ষা দিয়েছেন? প্রকৃত ইসলামের স্বরূপ কেমন ছিল তা ইতিহাসের পাতায় সোনালি অক্ষরে আজও লিপিবদ্ধ আছে এবং চিরদিন থাকবে। আল্লাহর রসুল যখন মদীনায় গেলেন সেখানকার নিরাপত্তা ও সংহতির জন্য ইহুদি, পৌত্তলিক, মুসলিম সবাইকে কাছে টেনে নিলেন। সংখ্যালঘু ইহুদি পৌত্তলিকদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার চিন্তাও কেউ করতে পারত না, কারণ রসুলাল্লাহ তাদেরকে মদীনা সনদের মাধ্যমে ‘উম্মাহ’র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। সবাই সবার ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে বসবাস করতে পারত, কেউ কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করত না। শুধু কেউ অন্যায় করলে তাকে সাহায্য না করতে সবাই ছিল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এক্ষেত্রে কেউ গোত্রপ্রীতি বর্ণপ্রীতি ইত্যাদি দেখালে সেটাকে ইসলামের পরিভাষায় বলা হয় ‘আসাবিয়াত’ অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতা, যা নিকৃষ্ট অপরাধ বলে বিবেচ্য। তাহলে ‘তুমি হিন্দু বা বৌদ্ধ বা খৃষ্টান কাজেই তুমি আমার শত্রু, তোমায় হামলা করলে হত্যা করলে আমার সওয়াব’- এই বিকৃত ধারণা কোথা থেকে এলো?
আরেকটি প্রাসঙ্গিক ঘটনা ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনছি, পাঠকরা খেয়াল করুন। মিসরের শাসনকর্তা হিসেবে আমর ইবনে আস (রা) দায়িত্ব পালন করছিলেন। একদিন সকালবেলায় আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রিষ্টান পল্লীতে হইচই পড়ে গেল। খ্রিষ্টানদের স্থানীয় আর্চবিশপ আমর ইবনে আস (রা.) এর বাসভবনে গিয়ে জানালেন, কেউ একজন বাজারের যিশু খ্রিষ্টের মার্বেলের মূর্তির নাক গত রাতে ভেঙে ফেলেছে। এ মূর্তিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাদের জন্য। খ্রিষ্টানরা ধরে নিয়েছে যে এটা মুসলমানদের কাজ। তারা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। আমর ইবেন আস (রা.) এ কথা শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। তিনি মূর্তিটি নিজ খরচে মেরামত করে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন কিন্তু বিশপ মানলেন না, এমনকি নতুন করে তৈরি করে দিতে চাইলেও তিনি মানলেন না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিশপ দাবি করলেন “এই ঘটনার প্রতিশোধস্বরূপ- একটাই ক্ষতিপূরণ, আমরা আপনাদের মুহাম্মাদ (স.) এর মূর্তি বানিয়ে সেটার নাক ভাঙব।” বিশপের এই দুঃসাহসিক প্রস্তাব শুনেও আমর (রা.) বিন্দুমাত্র রাগ প্রকাশ করলেন না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে তিনি খ্রিষ্টান বিশপকে বললেন, “আপনি যা বললেন সেটা সম্ভব না। আমাদের স¤পদ, পরিবারের চেয়েও মুহাম্মাদ (স.) কে বেশি ভালবাসি। আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যেকোনো প্রস্তাব করুন আমি রাজি আছি। আমাদের যেকোনো একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে প্রস্তুত, যার নাক আপনারা চান।”
পরদিন খ্রিষ্টান ও মুসলমান বিরাট এক ময়দানে জমায়েত হলো। মিসরের শাসক সেনাপতি আমর (রা) সবার সামনে হাজির হয়ে বিশপকে বললেন, “এ দেশ শাসনের দায়িত্ব আমার। যে অপমান আজ আপনাদের, তাতে আমার শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই এই তরবারি গ্রহণ করুন এবং আপনিই আমার নাক কেটে দিন।” এ কথা বলেই বিশপকে একখানি ধারালো তরবারি হাতে দিলেন, বিশপ সেটা পরীক্ষা করলেন। জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খ্রিষ্টানরা স্তম্ভিত। চারদিকে থমথমে ভাব। হঠাৎ সেই নীরবতা ভঙ্গ করে একজন মুসলিম সৈন্য এগিয়ে এলো। চিৎকার করে বলল, “আমিই দোষী, সেনাপতির কোনো অপরাধ নেই। আমিই মূর্তির নাক ভেঙেছি। এইত, আমার হাতেই আছে সে নাক। তবে মূর্তি ভাঙার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। মূর্তির মাথায় বসা একটি পাখির দিকে তীর নিক্ষেপ করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
সৈন্যটি এগিয়ে এসে বিশপের তরবারির নিচে নাক পেতে দিল। স্তম্ভিত বিশপ! নির্বাক সবাই। তরবারি ছুড়ে বিশপ বললেন, “ধন্য সেনাপতি, ধন্য হে বীর সৈনিক, আর ধন্য আপনাদের মুহাম্মদ (সা:), যার মহান আদর্শে আপনাদের মতো মহৎ উদার নির্ভীক ও শক্তিমান ব্যক্তি গড়ে উঠেছে। যীশু খ্রিষ্টের প্রতিমূর্তিই অসম্মান করা হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চেয়েও অন্যায় হবে যদি আপনার অঙ্গহানি করি।” (ওয়াকিদি, হিরক হার; অহবপফড়ঃবং ভৎড়স ওংষধস, পৃষ্ঠা ১৯৫-৭)
এই ছিল প্রকৃত ইসলাম, এভাবেই ইসলাম মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল। পক্ষান্তরে প্রচলিত সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রপন্থার ইসলাম দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মানুষ ইসলাম থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, নাস্তিক হয়ে যাচ্ছে। একই বৃক্ষের দুই রকম ফল কি হতে পারে? বিপরীত ফল হচ্ছে মানেই এটি আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়। এমতাবস্থায় প্রকৃত ইসলামের আদর্শকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে হবে, যে আদর্শ মানুষকে অনৈক্যের বিপরীতে ঐক্যের শিক্ষা দেবে, শত্রুতার বিপরীতে ভাতৃত্বের বোধ জাগ্রত করবে, হুজুগ ও গুজবনির্ভরতার বিপরীতে যুক্তিবুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে যাচাই করতে শেখাবে। অন্যথায় পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা যদি সত্যিই আমাদের এই দেশটাকে সাম্প্রদায়িক ও উগ্র মনোভাবাপন্ন হিসেবে পরিচিত করে ফেলতে পারে, তাহলে আমাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে উঠবে! আগেই বলেছি এই সাম্প্রদায়িকতা ও চরমপন্থার ইস্যু বড় ভয়াবহ ইস্যু। বহু দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে, বহু জাতি উদ্বাস্তু হয়েছে, বহু শিশুর লাশ নদীতে সাগরে ভেসেছে এই ইস্যুতে। আমাদের এই ছোট্ট দেশটা যেন সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান না হয় সেজন্য আসুন সাম্প্রদায়িক চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শপথ নিই, এই স্বাধীনতার মাসে।