তারেক বিন যিয়াদ ৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অনারব ‘সম্প্রদায়ের’ লোক ছিলেন। সেনাপতি মুসা বিন নুসাইর-এর হাতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি (মুসা) তারেককে নেতৃত্ব দান করে স্বসৈন্যে স্পেন বিজয়ের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। তিনি স্পেন যুদ্ধে সম্রাট রডারিককে পরাস্ত এবং হত্যা করেন। তিনি আরো কতিপয় যুদ্ধে বিপুল আগ্রহ ও উদ্দীপনা সহকারে অংশগ্রহণ করেন এবং ১০২ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। (আসাদুল গাবা)
হযরত তারেক বিন যিয়াদ আবদুল্লাহ পৃথিবীর বিখ্যাত ও স্বনামধন্য সেনাপতিগণের মধ্যে অন্যতম। তিনিই ছিলেন স্পেন বিজয়ী প্রথম মুসলিম শাসনকর্তা। (তাঁর শাসনকাল ৯২ হিজরীর শাওয়াল মাস মুতাবিক ৭১১ খ্রী. এর জুলাই মাস হতে ৯৩ হিজরীর জামদীউল উলা মুতাবিক ৭১২ খ্রী. এর মার্চ মাস পর্যন্ত ছিল।) তিনি তাঁর ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী নিয়ে ইউরোপের বুকে স্পেনের মতো এক বিশাল রাষ্ট্র জয় করেছিলেন। এখানে তিনি আল্লাহর প্রদত্ত জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি আপন যোগ্যতাবলে অগ্রসর হয়ে ইউরোপের রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে অবিস্মরণীয় কৃতিত্ব সম্পাদন করে গেছেন। মানুষ হিসাবে তিনি ছিলেন একজন খোদাভীরু, দায়িত্ব সচেতন এবং বিপুল সাহসের অধিকারী ব্যক্তি। তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ এবং সেনাবাহিনীর প্রত্যেকেই তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাঁকে সবাই সমীহ করে চলত। তারেক বিন যিয়াদ ছিলেন সেনাপতি মুসা বিন নুসাইরের আযাদকৃত ক্রীতদাস।
শিক্ষাদীক্ষা: তারেক বিন যিয়াদ শিক্ষাদীক্ষা মুসা বিন নুসাইরের মতো সমর বিশারদ এবং শ্রেষ্ঠ সেনাপতি তত্ত্বাবধানে সুসম্পন্ন করেছিলেন। যুদ্ধবিদ্যা ও সমর কৌশলে তারেক বিন যিয়াদ অতি দ্রুত খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন এবং দিকে দিকে তাঁর রণকৌশলের চর্চা বিস্তার লাভ করে। তিনি যুদ্ধ পরিকল্পনায় ছিলেন সুদক্ষ। এক কথায় তিনি ছিলেন অসাধারণ ধীশক্তির অধিকারী দূরদর্শী সদাপ্রস্তত একজন সেনানায়ক।
তাঁকে স্পেন বিজয় অভিযানের পূর্বে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার ভিত্তিতে তান্জা প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়েছিল। আফ্রিকার ইসলামী রাষ্ট্রকে সে সময় স্পেন সরকারের নৌ বাহিনীর শক্তিমত্তা সম্পর্কে আতঙ্ক ও শঙ্কার মধ্যে কালাতিপাত করতে হত। যাই হোক অন্যান্য যুদ্ধাভিযানের উপর ভিত্তি করে মুসা বিন নুসাইর স্পেন জয় করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সুতরাং তিনি শত্রুর শক্তিমত্তা এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা নিরীক্ষণ করা এবং যুদ্ধকৌশল জানার জন্য ৯১ হিজরীর রমজান মাসে (মোতাবেক ৭১০ খ্রী. জুলাই মাসে) একটা ক্ষুদ্র বাহিনী পাঠালেন। এ যুদ্ধ অভিযানে ৪০০ মুজাহিদ অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এ অভিযানের পরিচালক ছিলেন তরীফ ইবনে মালেক নাখয়ী। তরীফ দক্ষিণ স্পেনের যে প্রান্তে অবতরণ করেন তা তরীফ দ্বীপ নামে আখ্যায়িত হয়ে রয়েছে। এখানে এসে তিনি নতুন দ্বীপ ‘খাদরা’ আক্রমণ করে দখল করলেন। এই অভিযানে সাফল্য অর্জনের পর মুসা বিন নুসাইর নিজের প্রতিনিধি তারেক বিন যিয়াদকে (সাত হাজার ভিন্ন বর্ণনায় ১২ হাজার) সৈন্যসহ স্পেন বিজয়ের জন্য প্রেরণ করলেন। এই সৈন্যবাহিনীতে আফ্রিকার বারবার সম্প্রদায়ের লোকের সংখ্যা বেশী ছিল।
এ অভিযানের সেনাপতি তারেক খ্রিষ্টাননেতা কাউন্ট জুলিয়ানের এক নৌবহর ব্যবহার করেছিলেন। এই নৌবহরটি কাউন্ট জুলিয়ান সেনাপতি তারেকের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির ভিত্তিতে প্রেরণ করেছিলেন। মুসলিম বাহিনী ৯২ হিজরীর রজব মাসের ৫ম তারিখ সোমবার স্পেনের সমুদ্র উপকূলে অবতরণ করে এক পাহাড়ের সন্নিকটে অবস্থান করে। এই স্থানটি পরবর্তীকালে সেনাপতি তারেকের নামানুসারে জাবালত তারেক নামে অভিহিত হয়েছে। যা ইউরোপীয় ভাষায় বিকৃত হয়ে জিব্রাল্টার রূপ ধারণ করেছে। অতঃপর তিনি কারটাজনা দূর্গ দখল করে নেন। তারেক যুদ্ধের জন্য এমন এক স্থান নির্বাচন করে নেন সামরিক দৃষ্টিতে যা মুসলিম বাহিনীর অনুকূলে এক সুরক্ষিত এলাকা ছিল। এর সন্নিকটে পানি ও যুদ্ধের রসদ সামগ্রী সহজভাবে মওজুদ ছিল। স্থানটি ‘রাবাত’ উপত্যকার প্রান্তভাগে ছিল। যার অপর নাম ‘বকর’ উপত্যকা। মুসলিম বাহিনীর পশ্চাৎভাগে ‘লাজান্ডা’ নামে এক ঝিল বা বাওড় ছিল এটাকে লোকে আল বুহায়রা বলতো। সেনাপতি তারেক স্বীয় সেনাবাহিনীকে সামনে রেখে এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। তিনি বলেছিলেন- “তোমাদের সামনে দুশমন, পিছনে সাগর”; এর ইঙ্গিত ছিল ভূমধ্য সাগরের প্রতি। তার মধ্যেই তারেকের জাহাজ ছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি সেটাকে জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করে দিলেন এই বিদেশে বিভুইয়ে তাদের জন্য মাত্র দুটো পথ খোলা রয়েছে হয় শাহাদাত, নয়তো বিজয়।
যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার আগে ভাগেই তারেকের সেনাবাহিনী কাছাকাছি ও নিকটতম লোকালয় ও শহরগুলো দখল করে নেয়। যার ফলে সেখানে থেকে সেনাবহিনীর জন্য তিনি যথেষ্ট ও প্রচুর যুদ্ধের রসদ অর্জন করেন। এই সব এলাকা ও অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন টিডমীর। তিনি পশ্চিম স্পেন কিউটের বাদশা রডারিককে এ সংবাদ জানালেন। বাদশা রডারিক দুঃসাহসিক সৈন্য সামন্ত নিয়ে তার মুকাবিলার জন্য আগমন করলেন এবং রেবাট নদীর তীরে সৈন্য শিবির স্থাপন করলেন। ইতোমধ্যে মুসা বিন নুসাইর-এর প্রেরিত বাড়তি পাঁচহাজার সৈন্য ও সেনাপতি তারেক পেয়ে যান। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে তারেক তাঁর সৈন্যবাহিনীর সামনে যে উদ্দীপনাপূর্ণ ভাষণ দান করেছিলেন তা ইসলামের সাহিত্যেও এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে। দীর্ঘ আটদিন ধরে ঘোরতর যুদ্ধ চলেছিল। অবশেষে স্পেন বাহিনীর চরম পরাজয় হয়। এই পরাজয়ের দিন ছিল ৯২ হিজরীর ২৮ রমজান; মুতাবিক ৭১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুলাই। বাদশা রডারিক যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করেন। কিন্তু তার শেষ পরিণাম কি হয়েছিল তা জানা যায়নি।
এই যুদ্ধ এমন এক চূড়ান্ত পর্যায়ের ছিল যার ফলে স্পেনের সেনাবাহিনী পুনরায় কোথাও ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন সাফল্যজনক মোকাবেলা করতে সক্ষম হয় নাই। রণবিজয়ী তারেকের জন্য এখন সামনের সকল ময়দান ছিল মুক্ত। তিনি স্পেনের দক্ষিণ পশ্চিম ভূখণ্ডের দিকে নজর দিলেন এবং কাবিস প্রদেশের বিখ্যাত শহর সেজুনা এবং এরপর জেছুল, মেডুল, কারমুনা, ইশিবিলা ইছতেজা, কর্ডোবা, মালাক্কা আল-বীরা, রিয়া, ইরয়ুলা এবং তেলিতুলার নগর ও শহরগুলো দখল করে ফেললেন। গুরুত্বপূর্ণ কর্ডোবা শহরটি সেনাপতি তারেকের নির্দেশক্রমে ‘মুগীস’ ৯৩ হিজরীর প্রথম দিকে অর্থাৎ ৭১১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে জয় করে নেন।
এ সকল স্থান বিজয় করার পর সেনাপতি তারেক উত্তর স্পেনের দিকে দৃষ্টি দিলেন এবং এখানে ইসতির্কা এবং জলীকা প্রদেশ জয় করে নিলেন। কথিত আছে যে, এ সকল অভিযানে তারেকের হাতে বিপুল পরিমাণ যুদ্ধলব্ধ সম্পদ অর্জিত হয়। এসব সম্পদের মধ্যে ‘মায়েদায়ে সুলায়মান’-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিউটের বাদশা রডারিকের পরাজয় বরণ এবং সেনাপতি তারেকের বিস্ময়কর বিজয়সমূহের বিবরণ শ্রবণ করে আফ্রিকার শাসনকর্তা মুসা বিন নুসাইর (৯৩-৯৫ হিজরী) স্বীয় পুত্র আবদুল্লাহর উপর শাসনভার ন্যস্ত করে নিজে আঠারো হাজার সৈন্য সামন্ত নিয়ে ৯৩ হিজরীর রমজান মাসে (মুতাবিক ৭১২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস) জিব্রাল্টার প্রণালী পার হয়ে স্পেনের ‘খাদরা’ দ্বীপে অবতরণ করেন। তিনি যে পর্বতের সন্নিকটে পদার্পণ করেন উহা জাবালে মুসা নামে অভিহিত হয়ে আসছে। মুসা বিন নুসাইরের সেনা বাহিনীতে অধিকাংশ ছিল আরবীয় এবং সিরীয়। মুসা সেনাপতি তারেক কর্তৃক বিজিত ও দখলকৃত এলাকাসমূহ ত্যাগ করে অধিকার বর্হিভূত ভূখণ্ডের দিকে নজর দিলেন এবং শিজুনা, কারমুনা, আশবেলিয়া এবং মারদা জয় করে ফেললেন।
৯৪ হিজরী/৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুসা এবং তারেক একত্রে ‘তালীতলা’ নামক স্থানে মিলিত হন। উভয় সেনাপতি বিজিত এলাকাসমূহের শাসনব্যবস্থার তদারকী গ্রহণ করেন। উভয়ই অভ্যন্তরীণ শাসনকার্যের বাস্তবমুখী চিত্র এবং ভবিষ্যৎ বিজিত এলাকাসমূহের পরিকল্পনা তৈরি করেন। সামনে বিজয় অভিযানে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে তার সেনাবাহিনীর স্বার্থে এমন সব সামরিক বিধি-বিধান প্রবর্তন করেন যা সামরিক শিক্ষা ও চর্চার অধ্যায়ে অতীব গুরুত্ব বহন করে থাকে। এছাড়া তারা আরবী ও ল্যাটিন ভাষায় নতুন মুদ্রা চালু ব্যবস্থা করে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
উভয় সেনাপতি পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন বিজয় অভিযান শুরু করেন। তাঁরা উত্তর পূর্ব স্পেন ছাড়াও দক্ষিণ ফ্রান্সের দিকে অগ্রসর হয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নগর যথাক্রমে আরবুনা, লুডুন এবং উনিউন দখল করেন। এরপর তারা উত্তর পশ্চিম স্পেনীয় ভূখণ্ডের উপর সেনাবাহিনী পরিচালনা করেন। সেনাপতি মুসা ও সেনাপতি তারেক সম্মিলিতভাবে বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখলেন।
ইত্যবসরে দামেস্ক থেকে খলীফা ওলীদ বিন আবদুল মালেকের বিশেষ দূত এই হুকুমনামা এনে হাজির করলেন – অতি শীঘ্র উভয় সেনাপতি তারেক ও মুসা যেন রাজধানী দামেস্কে পৌঁছে যান। সেনাপতি মুসা আরো অতিরিক্ত বিজয় অভিযানের জন্য খলিফার নির্দেশ পালনে বিলম্ব করে ফেললেন। স্পেনের সকল অংশ প্রায় বিজয়ের কাছাকাছি এসে গিয়েছিল। এহেন অবস্থায় সেনাপতি মুসা দামেস্ক যাওয়ার সিদ্ধান্ত করে ফেলেন। স্পেনের বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী স্বীয় বীর পুত্র আবদুল আজীজের উপর স্পেনের শাসনভার অর্পণ করে তিনি স্পেন ত্যাগ করলেন। রাজধানী দামেস্কে প্রবেশ করার পর মুসা বিন নুসাইর এবং তারেক বিন যিয়াদের মত মহা বিজয়ী সেনাপতিদ্বয়ের সামরিক জীবনের অবসান হল। অবশেষে অজানার গহ্বরে লোকচক্ষুর অন্তরালে তাঁরা পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন চিরতরে। হায়! এই দুই মহাবীর তারেক ও মুসা যদি নেতার আনুগত্য লংঘন না করতেন তাহলে শুধু স্পেনের ইতিহাস বদলে যেত না বরং আজকের গোটা ইউরোপ মহাদেশই ইসলামের ছায়াতলে এসে যেত।
(সংগ্রহে: তুহিন সৈকত, কর্নেল ডক্টর হাফেজ ফায়জুর রহমান-এর ‘বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতিদের বিজয় কাহিনী গ্রন্থ’ থেকে)