মসীহ উর রহমান:
বর্তমানে আমরা এক ভয়াবহ দুঃসময় অতিক্রম করছি। সামাজিক অন্যায়, নেতৃবৃন্দের অসততা, অঙ্গীকারভঙ্গ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, হানাহানি ইত্যাদির মধ্যে মানবজাতি নিমজ্জিত হয়ে আছে। আমরা মনে করি এই অবস্থাটি সৃষ্টির পেছনে কেবল কোনো একক ব্যক্তি বা দল দায়ী নয়, প্রধানত দায়ী হচ্ছে আমাদের সিস্টেম বা জীবনব্যবস্থা। সেটা কিভাবে?
আল্লাহর রসুল বলেন, প্রত্যেক মানবশিশু জন্ম নেয় ফেতরাতের (প্রকৃতির) উপর, অতঃপর তার বাবা-মা তাকে ইহুদী, খ্রিস্টান অথবা অগ্নিপূজক বানিয়ে ফেলে [আবু হোরায়রা রা. থেকে বোখারী]। পরিবার একটি সিস্টেম। এই সিস্টেমের প্রভাবে পরিবার থেকে যেভাবে মানুষের ধর্ম নির্ধারণ হয়, ঠিক তেমনি সমাজব্যবস্থাও মানুষকে নিজস্ব কাঠামো অনুযায়ী গড়ে তোলে। মানুষ প্রকৃতপক্ষে কাদা মাটির ন্যায়। এই কাদামাটিকে যে ডাইসের (Mould, ছাঁচ) মধ্যে ফেলা হবে, কাদা মাটি সেই ডাইসের রূপ, আকৃতি ধারণ করবে। সমাজব্যবস্থাও এমনই একটি ডাইস। সমাজব্যবস্থা যদি বস্তুবাদী, ভোগবাদী হয়, মানুষও হবে বস্তুবাদী ও ভোগবাদী, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, মানুষগুলিও ধীরে ধীরে হবে দুর্নীতিগ্রস্ত। পক্ষান্তরে সমাজব্যবস্থা যদি ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, মানুষগুলিও হবে ন্যায়নিষ্ঠ। আজকে যারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীতে চাকরি করতে যান তাদের অনেকেই সৎ জীবনযাপনের ইচ্ছা নিয়েই যান, কিন্তু সিস্টেমই তাদের অধিকাংশকে ঘুষখোর, দুর্নীতিপরায়ণ, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, অসৎ বানিয়ে ফেলে। তারা এমন পরিস্থিতির শিকার হন যে অসৎ না হয়ে তাদের কোনো উপায় থাকে না। যারা ব্যবসা করতে যান তারা অনেকেই হয়তো এই নিয়তে যান না যে তিনি মাপে কম দিবেন, ভেজাল মেশাবেন; কিন্তু এক সময় তাকে বাজারে টিকে থাকার জন্য অন্যদের মতই সততা বিসর্জন দিতে হয়। রাজনীতিতে যারা যান তারাও হয়তো এই মানসিকতা নিয়ে যান না যে দুর্নীতি, সন্ত্রাস করবেন, জনগণের সম্পদ লুট করবেন, বিদেশে টাকা পাচার করবেন। অনেকের হয়তো জনসেবা করার ইচ্ছাও থাকে কিন্তু পরে তাদের কী অবস্থা হয় সেটা সকলেরই জানা। একসময় ছাত্ররা শিক্ষাগুরুর পায়ে হাত দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতো, আজ সেই ছাত্ররাই এখন শিক্ষককে আটক করে রাখে, মারধোর করে। যে ছাত্রদের শিক্ষা অর্জন করে মানবসেবার জন্য আত্মনিয়োগ করার কথা, সেই ছাত্ররা টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী, বোমাবাজি করে, রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসী হিসাবে ভাড়া খাটে। কেন এই সমাজের মানুষগুলো ধীরে ধীরে তার নীতি-নৈতিকতা, সততা হারিয়ে দুর্নীতিবাজ ওয়াদা খেলাফকারী হয়ে যায়, সন্ত্রাসী, মিথ্যাবাদী, মানুষের সম্পদ লুণ্ঠনকারী হয়ে যায়?
এর উত্তর, সিস্টেমই তাদেরকে এমন বানায়। কোনো চালক যদি চেষ্টা করে একটা গাড়িকে সোজা চালাতে, কিন্তু রাস্তাটা যদি বাঁকা হয় তবে সে শত ইচ্ছা করেও সোজা চালাতে পারবে না। আবার রাস্তা যদি সোজা থাকে তাহলে সে চাইলেও আঁকা-বাঁকা চোলতে পারবে না, রাস্তাই তাকে সোজা চোলতে বাধ্য করবে। এই রাস্তা হচ্ছে একটি সিস্টেম যা মানুষের জীবনের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রচলিত সিস্টেমে জয় হয় মিথ্যার
প্রচলিত সিস্টেমে অধিকার আদায়ের জন্য হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও, বিক্ষোভ, অনশন ইত্যাদি করা হয়। এসব থেকে ঘটে সহিংসতা, দাঙ্গা, হাঙ্গামা, ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও, অগ্নিসংযোগ, দিনশেষে আহত এতজন, নিহত এতজন; আর সুদূরপ্রসারী কুফল হচ্ছে জাতির মধ্যে অনৈক্য, অসন্তোষ, বিদ্বেষ, শত্রæতা, বিশৃঙ্খলা- এক কথায় ভয়াবহ বিভীষিকা। এই বিভিষীকাময় পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য একদলের উপর অসন্তষ্ট হয়ে অন্যদলের ভোটের বাক্স ভরে দিচ্ছে জনতা, যাদেরকে নির্বাচিত করছে তারাও পরীক্ষিত দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাস লালনকারী, বিদেশে অর্থপাচারকারী, ওয়াদাভঙ্গকারী। এ যেন বাঁচার জন্য কড়াই থেকে লাফ দিয়ে চুলোয় পড়া, আর চুলো থেকে উঠে আবার কড়াইতে পড়া। এই নির্বাচনের সংস্কৃতি থেকে কি আমরা বেরিয়ে আসতে পারি না? সকলকে বোঝা উচিত গণতন্ত্রের নামে এক বিষাক্ত, জীবনঘাতি সিস্টেম আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে সিস্টেমে একজন সৎ, যোগ্য, প্রকৃত ওয়াদা রক্ষাকারী, আমানতদার, নিঃস্বার্থ মানবপ্রেমী কখনোই উঠে আসতে পারবে না; এই সিস্টেমে যে যত বেশি মিথ্যা বোলতে পারে, কালো টাকা ছড়াতে পারে, পেশীশক্তি ব্যবহার করতে পারে সেই নির্বাচিত হয়।
আমাদের সমাজে একটি কথা চালু আছে, আগে নিজে ভালো হোন, তারপর দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। এই কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, কারণ একটি জীবনব্যবস্থায় মানুষের সামষ্টিক জীবনের গুরুত্ব সর্বাধিক। ব্যক্তি কখনও সামষ্টিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে চোলতে পারে না। জাতীয় ও সামষ্টিক জীবনের চাপে সে তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে। কাজেই জাতীয়ভাবে আজ আমাদের এমন একটি সিস্টেম দরকার যেখানে শত চেষ্টা করেও কেউ ঘুষ খেতে পারবে না, অন্যায় করতে পারবে না, ওয়াদা খেলাফ করতে পারবে না; কেউ বিপুল সম্পদের মালিক হবে আর কেউ না খেয়ে রাস্তায় ঘুমাবে এমন অবিচার সৃষ্টি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও যেখানে থাকবে না।
এমন সিস্টেম কোথায় পাওয়া যাবে?
স্রষ্টা আল্লাহর দেওয়া দীনুল হক, সত্য জীবনব্যবস্থাই হচ্ছে সেই সিস্টেম। মানুষ নামক এই প্রাণী সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ, কাজেই কোনো রাস্তায় বা সিস্টেম-এ সে সুখে থাকবে সেটা ভালো জানেন মহান আল্লাহ। আল্লাহর দেওয়া সিস্টেমই হচ্ছে সেই সরল পথ বা সেরাতুল মোস্তাকীম।
এখানে মনে রাখতে হবে যে, বর্তমানে তওহীদ ও জেহাদ-বিহীন, শুধুই ব্যক্তিগত কিছু আমলসর্বস্ব বিকৃত বিপরীতমুখী যে ইসলামটা দুনিয়াতে চালু আছে আমরা সেই ইসলামের কথা বোলছি না। আল্লাহর দেওয়া প্রকৃত ইসলাম মহানবী যেভাবে পৃথিবীতে রেখে গিয়েছিলেন সেটি গত ১৩০০ বছরের কালপরিক্রমায় বিকৃত হোতে হোতে বর্তমানে একেবারে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। তথাকথিত আলেম শ্রেণী এই বিকৃত ইসলামটিকে তাদের রুটি রুজির মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে। একদা লৌহকঠিন ঐক্যবদ্ধ, অখণ্ড উম্মতে মোহাম্মদী আজ ফেরকা, মাজহাব, মাসলা মাসায়েল ইত্যাদির ক‚টতর্ক নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি, হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে হাজারো ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে; আরেকটি অংশ ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে মানুষকে ইসলামের বিষয়ে বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। জাতির বৃহত্তম অংশটি শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঐ বিকৃত ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা করে যাচ্ছে। এর কোনোটাই আল্লাহ, রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়। কেননা ইসলাম শব্দের আক্ষরিক অর্থই শান্তি। অর্থাৎ যারা ইসলামের অনুসারী হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা শান্তিতে থাকবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা ঠিক এর বিপরীত। আল্লাহ তাঁর অসীম দয়ায় সেই প্রকৃত, অবিকৃত ইসলাম আবার হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমাম, এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীকে বোঝার তওফিক দান করেছেন। তিনি প্রকৃত ইসলামের যে রূপরেখা অঙ্কন তুলে ধরেছেন আমরা যদি সে মোতাবেক জীবন পরিচালিত করি, তাহলে আমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সমষ্টিগত জীবনে পরিপূর্ণ শান্তিতে, প্রগতিতে বাস করতে পারবো। সেই সিস্টেম বাস্তবায়নের ফলে আজকের ঘুণে ধরা সমাজের অসৎ মানুষগুলিই একেকজন সোনার মানুষে পরিণত হবে ইনশা’আল্লাহ।
[লেখক: সাধারণ সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ]