বাংলাদেশের প্রায় সব নির্বাচনের ইতিহাসই ঘটনাবহুল। নির্বাচনে কারচুপি, ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখল, বাক্স ছিনতাই ইত্যাদি ঘিরে সহিংসতা, নৈরাজ্য সৃষ্টি, বোমাবাজি, মানুষ খুন, প্রার্থী গুম ইত্যাদি ঘটনা এদেশে অহরহই ঘটে থাকে। আমরা মুখে গণতন্ত্রের ফোয়ারা ছোটাই কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নাশকতাই একমাত্র নিয়ামক হিসাবে গণ্য হয়। সব সমস্যারই এক সমাধান- পেশীশক্তি। সরকারি দল কি বিরোধী দল উভয় ক্ষেত্রেই পেশীশক্তিই প্রথম ও শেষ আশ্রয় হিসাবে গণ্য হয়। মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষকে দিবানিশি গণতন্ত্রের নামে কিছু বুলি শুনতে হয়। এই ফাঁকাবুলি গুলির মধ্যে একটি হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন।
কয়েকবছর আগে নির্বাচনকে ঘিরে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল-অবরোধ, ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও এবং তার বিরুদ্ধে সরকারি বাহিনী ও সরকারদলীয় কর্মীদের প্রতিরোধ সবকিছু মিলিয়ে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তারপর মেরে কেটে সেই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডকে স্থগিত করা গেছে বটে কিন্তু সরকার বৈধ কি অবৈধ সেটা নিয়ে বিতর্ক চলেছে বহুদিন।
সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায় হলো নির্বাচনে অর্থের অপব্যবহার। ভোট কেনাবেচা, প্রার্থী কেনাবেচা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। যদিও এটা নির্বাচনী নীতিমালা পরিপন্থী, তবু রাজনীতিবিদরা এই খাতে অঢেল অর্থ ব্যয় করে থাকেন। সাধারণ ভোটারের হাতের মধ্যে টাকা গুঁজে দেয়া, ভোটের আগের রাতে দরজার নিচে দিয়ে টাকা-বিড়ি-সিগারেট পুরে ভোটভিক্ষা করা আমাদের নির্বাচনগুলোতে হরহামেশা হত এবং এখনও হয়। দরিদ্র ভোটার ভালোভাবেই জানে যে, নির্বাচনে তাদের কিছুই আসে যায় না; যেই নির্বাচিত হোক, যে দলই ক্ষমতায় আসুক তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হবার সম্ভবনা নেই। কাজেই এই অর্থপ্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে অনেকেই সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দিয়ে আসে। এভাবেই অর্থ বিলি করার সক্ষমতার উপর যে নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করে সেই নির্বাচনে সকল দল অংশ নিলেও, ভোট চুরি না হলেও সেটাকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায় কিনা?
সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরেকটি অন্তরায় হচ্ছে অপপ্রচার যা গণতন্ত্রের স্বভাবজাত বলা যায়। গণতন্ত্রের একটি বড় সমস্যা হল, প্রতিটি দল নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও পোপাগান্ডা চালায়। এবং গণতন্ত্রে এটা অবধারিত। যারা যত যুক্তিপূর্ণভাবে প্রতিপক্ষের দোষত্রুটি জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে গণতন্ত্রে তাদেরই কদর বেশি। নির্বাচনের আগে তাই অপপ্রচারের ঝড় বয়ে যায়। সব দল অন্যের ছিদ্রানুসন্ধানে রত থাকে, সরকারের কোন ত্রুটি বিচ্যুতি পেলেই সেটাকে আন্দোলনের ইস্যুতে পরিণত করার চেষ্টা থাকে বিরোধীপক্ষের। সবাই আবার যার যার ত্রুটির পক্ষে সাফাই গায়। যে পক্ষ যত বেশি প্রতিপক্ষের দোষত্রুটি প্রচার করতে পারে, সেই পক্ষের ভোটের বাক্স ভর্তি হয় তত বেশি। উন্নয়ন বা জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড করে জনসমর্থন আদায়ের চেয়ে বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে অনবরত অপপ্রচার করার মাধ্যমেই দ্রুত ও কার্যকর ফল পাওয়া যায়। এই অপপ্রচার দ্বারা বিভ্রান্ত জনগণের সিদ্ধান্তে নির্বাচিত হয় একটি পক্ষ। অবধারিতভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বড় গলাবিশিষ্ট চোরের মায়ের। কাজেই এই নির্বাচনগুলি যতই অবাধভাবে করা হোক, যত স্তর নিরাপত্তার বেষ্টনি সৃষ্টি করা হোক বা সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হোক না কেন সেটাকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলার কতটুকু যৌক্তিকতা আছে?
নির্বাচনী অপপ্রচারে ধর্মের ব্যবহার ‘গণতন্ত্রের চর্চা’য় একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসাবে যখন ধর্মকে ব্যবহার করা যায় তখন সেই অপপ্রচার অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়ায়। এটা গণতন্ত্রের রঙ চড়ানো একপ্রকার ধর্মব্যবসা। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আমরা দেখেছি, আমাদের দেশের রাজনীতিতে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। আমরা দেখেছি কোর’আন হাতে নিয়ে কিছু ধর্মব্যবসায়ী মিছিল করতে আসে, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের চেষ্টা করে, অতঃপর প্রতিপক্ষের হামলায় ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়, রাস্তায় ফেলে যায় কোর’আন। এরপরেই তারা হাজির করে কোর’আন অবমাননার নতুন ইস্যু, শুরু করে কোর’আনের জন্য মায়া কান্না।
ধর্মব্যবসায়ীদের এই ধর্মীয় সহিংসতা বিস্তারের পক্ষে কাজ করে অনেক গণমাধ্যমও যারা এক ঘটনার ছবির ক্যাপশন পরিবর্তন করে আরেক ঘটনার নাম দিয়ে চালিয়ে দেয়। সংবাদ পড়ে আহত হয় মানুষের অতি কোমল ধর্মীয় অনুভূতি। ফতোয়া দিয়ে যাকে ইচ্ছা তাকে ইসলাম বিদ্বেষী, নাস্তিক, মুরতাদ বানিয়ে দেওয়া যায়, তার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা যায়। বাংলাদেশের ৯০% মানুষ বিশ্বাসগতভাবে ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তাদের অধিকাংশই আল্লাহ-রসুল ও কোর’আনকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। আর এই সুযোগটি নিয়ে দেশের কিছু স্বার্থবাদী রাজনৈতিক মহল নির্বাচনের আগে মানুষের কানে কানে একটি কথা চালু করে দেয় যে, অমুক নাস্তিক, অমুক কাফের। তাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ঈমান থাকবে না, জাহান্নামে যেতে হবে; পক্ষান্তরে অমুক ইসলামের পক্ষের লোক, তাকে ভোট দিলে সেই ব্যালটপেপার আখেরাতে জান্নাতের টিকেট হবে, কেয়ামত পর্যন্ত এই ভোট সদকায়ে জারিয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে মিথ্যা দ্বারা কোটি কোটি ভোটারকে প্রভাবিত করা হয়, ফলে মিথ্যার প্রভাবে তাদের রায় পরিবর্তন হয়ে যায়। তারা নিজেরা এভাবে ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে দেশ ও জাতির ক্ষতিকে তরান্বিত করে। যে নির্বাচনে এভাবে ধর্মের অপব্যবহার হয় তাকে কি অবাধ, সুষ্ঠু বলা যাবে?
এখন ভাবার বিষয় যে, আমাদের অসৎ রাজনীতিবিদরা আর কতকাল গণতন্ত্রের নামে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে যাবেন? কবে তারা কথা ও কাজে এক হবেন। জনগণ রাজনীতিবিদদের স্বার্থপরতা আর মিথ্যচার দেখে দেখে এখন বীতশ্রদ্ধ। তারা বোঝে যে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে কিছু মানুষের স্বার্থ হাসিলের প্রতিষ্ঠানমাত্র, এখানে জনগণ কেবল সিঁড়ি হিসাবেই ব্যবহৃত হয়।