হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সুলতানী আমল ও মোঘল যুগে পন্নী পরিবার

  • [বাংলার ইতিহাসে যে কয়টি বংশ শাসক হিসেবে সুপরিচিত হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে টাঙ্গাইলের করটিয়ার পন্নী জমিদার বংশ। পন্নী জমিদার বংশের ইতিহাস সুপ্রাচীন এবং এখন পর্যন্ত সমাদৃত। হেযবুত তওহীদ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা এমাম এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মাদ বায়াজীদ খান পন্নীর ধমনীতেও এই পন্নী বংশের রক্তই প্রবাহিত ছিল। দৈনিক বজ্রশক্তির পাঠকদের জন্য আলহাজ¦ কাজী নুরুল ইসলাম এডভোকেট বিরচিত “টাঙ্গাইলের হাজার বছরের ইতিহাস” নামক গ্রন্থ থেকে জনদরদী এই পন্নী পরিবারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস উপস্থাপন করা হলো। – বি.স]

নওয়াব সুলেমান খান পন্নী ছিলেন করটিয়ার জমিদারদের পূর্বপুরুষ। ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস্তার ধারে এক মনোরম পরিবেশে শত শত বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী করটিয়ার জমিদার বাড়ি। সাদামাঠা বাড়িগুলো প্রমাণ করে জনদরদী, মানব প্রেমিক, প্রজাবৎসল এক বিশাল হৃদয়ের জমিদার পরিবার বাস করত এখানে। আজ যদিও ম্লান হয়ে গেছে সে বাড়িগুলো, তবু তার ইতিহাস ও ঐতিহ্য লেখা রয়েছে ইটের পাঁজরে পাঁজরে।
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিচ্ছবি করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের কাছেই জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। দানবীর হিসাবে খ্যাত জনদরদী, দেশপ্রেমিক জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর (চাঁদ মিয়ার) প্রতিষ্ঠিত এ কলেজ। মহান হৃদয়ের এ মানুষটিকে আজও এ দেশের মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। শুধু তাই নয় বহু স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছে এই পরিবার।
এই ঐতিহ্যবাহী পরিবারের ইতিহাস অনেক লম্বা। এখনও এ পরিবারের সদস্যরা নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে স্মরণের পাতায় ধরে রেখেছে- যা অনেক রাজ-পরিবারেই নেই। শত শত রাজ পরিবার বিলুপ্ত হয়ে মিলেয়ে গেছে মাটির গর্ভে, কিন্তু এই পরিবারটি এখনও পাদপ্রদিপের মত সমুজ্জ্বল।
করটিয়া জমিদার বংশ বিখ্যাত আফগান পাঠান বংশোদ্ভূত। উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের প্রথম দিকে আরব পারস্য, তাতার হতে বহু মুসলমান বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। ঠিক তেমনি এদেশেও তারা চলে আসে। কোন কোন রাজ-পরিবারের সদস্যরা পরাজিত হয়ে পালিয়ে অথবা কোন কোন রাজার সুবেদার হয়ে এদেশে এসে রাজত্ব কায়েম করেছেন। হয়তো আর যান নি এ দেশ হতে। প্রতিষ্ঠিত করেছেন পারিবারিক শাসনব্যবস্থা।
এই জমিদার পরিবারকে কখনো পন্নী বা কখনো কররানী বলা হয়ে থাকে। এই পন্নী পরিবার জনগণের সুখে দুঃখে সমহারে জড়িত থেকেছে বলেই জনগণ তাদেরকে চিরকাল স্মরণ করবে।
১৫৪৬ খ্রিষ্টাব্দে শেরশাহের মৃত্যুর পর দেওয়ান সুলায়মান খাঁ বাংলায় বিদ্রোহ করেন। দেওয়ান সুলায়মান খানকে দমন করার জন্য বিহারের শাসনকর্তা তাজ খান পন্নী এবং সেনাপতি দরিয়া খাঁ বাংলাদেশে এসে সুলায়মান খাঁ কে পরাজিত ও হত্যা করেন। এ যুদ্ধে সুলায়মান খাঁ এর পুত্র ইতিহাসখ্যাত ঈশা খাঁ ও ইসমাইল খাঁ বন্দী হয়ে কৃতদাস হিসেবে মঙ্গোলিয়ার বণিকদের কাছে বিক্রি হন।
১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তাজ খান পন্নী বাংলা ও বিহারের রাজপদে অভিষিক্ত হন এবং দিল্লীর অধীনতা স্বীকার করে বাংলায় মূলত স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করতে থাকেন। তাজ খান পন্নী এই সময় নিহত সুলেমান খাঁর ভাই কুতুব খাঁকে তার দরবারে উচ্চপদে নিয়োগ দেন। কুতুব খাঁ উচ্চপদে আসীন হয়েই অনেক খোঁজাখুজির পর সেই সুদূর মঙ্গোলিয়া থেকে দুই ভাতিজা ঈশা খাঁ ও ইসমাইল খাঁকে অনেক অর্থ ব্যয় করে স্বদেশে ফিরিয়ে আনেন।
পরবর্তীকালে পিতৃব্য কুতুব খাঁর সাহায্যে এবং তাজ খান পন্নীর নির্দেশে ঈশা খাঁ পূর্ব বাংলার এক বিস্তৃত জনপদের শাসনভার প্রাপ্ত হন। ঈশা খাঁ নারায়ণগঞ্জের উত্তর পূর্ব দিক খিজিরপুর নামক স্থানে বাসস্থান নির্মাণ করেন। বীরকুল শ্রেষ্ঠ ঈশা খাঁ করটিয়ার জমিদার পরিবারের সাহায্য ও সহানুভূতিতে নিজের ভাগ্যকে গড়ে তোলেন। করটিয়ার জমিদার পরিবারের পূর্বপুরুষদের সাহায্য সহানুভূতি না পেলে হয়তো ঈসা খাঁ কে সারাজীবন ক্রীতদাসরূপে সেই সুদূর মঙ্গোলিয়ায় জীবন কাটাতে হতো।
১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে নওয়াব তাজ খান পন্নীর মৃত্যু হলে তাঁর ছোট ভাই সুলেমান খান পন্নী বাংলা বিহারের মসনদে বসেন। তিনি উড়িষ্যাও জয় করেন।
নওয়াব সুলেমান খান পন্নী বাদশা আকবরের নিকট উপঢৌকন পাঠিয়ে তাঁর সাথে সন্ধি স্থাপন করেন। সুলেমান খান পন্নী গড়বাড়ির গড়গড়ি নামক এক ব্রাহ্মণের সুন্দরী কন্যা অলকাকে বিবাহ করেন। এই গড়গড়ির নাম অনুসারেই গ্রামের নাম গড়বাড়ি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এই কন্যার গর্ভেই বায়েজীদ খান পন্নী এবং দাউদ খান পন্নীর জন্ম হয়।
সুলেমান খান কররানী সখিপুরের উত্তরে তার বাসস্থান নির্মাণ করেন। আজও তার নাম অনুসারে সেই জায়গার নাম কররানী চালা নামেই পরিচিত। সেই বাসস্থানের পাশেই নাপিত ও ধোপাদের বাসস্থান নির্মাণ করে দিয়েছিলেন বলেই তার পাশেই ধোপা বা ধুপীর চালা আজও বিদ্যমান। মালিরা ফুল তুলে মালা গেঁথে তার দরবারে পৌঁছাত। তাদেরকে যে গ্রামে উপহার দেওয়া হয় সেই গ্রামের নামকে আজও ফুলমালীর চালা বলে।
পিতার মৃত্যুর পর বায়েজীদ খান পন্নী ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার মসনদে বসেন। বায়েজীদ খান পন্নী সিংহাসনে বসে বেশী দিন রাজ্য ভোগ করতে পারেন নি। ক্ষমতালোভী ভগ্নিপতি হাঁসু খাঁ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বায়েজীদ খান পন্নী মসনদে বসার আগে তার নাবালক পুত্র সাঈদ খাকে স্ত্রীসহ বায়েজীদপুরে বা বাজিতপুর রেখে রাজধানী ভারতের উত্তর প্রদেশের তাঁড়ায় (Tanda) চলে যান। সুলায়মান খান পন্নী পাহাড়ি এলাকায় রাজধানী করেছিলেন বলেই তার নাম অনুসারে এখনও সেই জায়গার নাম কররানী চালা নামে পরিচিত। সেখানে প্রচুর ইট পাটকেলের স্তূপ ইতিপূর্বে দেখা গেলেও এখন আর দেখা যায় না।
বায়েজীদ খান পন্নী পশ্চিম এলাকায় যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় কোচ রাজা চিলা রায় বায়েজীদ খাঁর রাজধানী আক্রমণ করে দখল করে নেন। তখন বায়েজীদ খান পন্নী ফিরে এসে চিলা রায়কে পরাস্ত ও বন্দী করে চিলা পুকুর পাড়ে বায়েজীদ খান পন্নীর আবাস ভূমিতে আটক রাখেন বলে উক্ত পুকুররের নাম চিলা পুকুর হয়েছে। বায়েজীদ খান পন্নীর মৃত্যুর পর তার সহোদর ভ্রাতা দাউদ খান পন্নী হাঁসু খাঁকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। তিনি সিংহাসনে বসেই মোঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। বাদশা আকবরের সেনাপতি খানে খানম মোনায়েম খাঁ এবং রাজা টোডরমলের সাথে যুদ্ধে দাউদ খান পরাজিত হন। পরবর্তীকে টোডরমল মহামারীতে মৃত্যুবরণ করলে দাউদ খান পন্নী আবারও আক্রমণ করে তার রাজত্বের কিছু অংশ দখল করেন। পরর্বতীতে বাদশাহ আকবর নিষ্ঠুর খানে জাহান হোসেন কুলি খাঁকে সেনাপতি করে বাংলায় পাঠান।
সেনাপতি হোসেন কুলি খাঁর নিকট যুদ্ধে দাউদ খান পরাজিত ও নিহত হন। আকবরকে খুুশি করার জন্য ১৫৭৬ সনে হোসেন কুলি খাঁ গলাকেটে দাউদ খানের মস্তক দিল্লিতে পাঠিয়ে দেন এবং দাউদ খানের স্ত্রী ও কন্যা দালিয়াকে বন্দী করে আগ্রায় নেওয়া হয়। বাদশা আকবর তাদেরকে সসম্মানে তাদেরকে ভাতার ব্যবস্থা করে আগ্রায় থাকার ব্যবস্থা করেন। দাউদ খানের মতো একজন অসমসাহসী তরুণ সুলতানের মস্তক কর্তনের মতো অবমাননাকর আচরণে আকবর তাঁর সেনাপতির উপর খুবই রাগন্বিত হন। এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে যায়, বাংলাদেশে চলতে থাকে সীমাহীন অস্থিরতা। কারণ পন্নী সুলতানদের সেনাপতিগণ, জমিদারগণ যারা বারো ভুইয়া নামে আখ্যায়িত হন তারা দিল্লীর শাসনকে অস্বীকার করে যার যার মতো নিজেদের এলাকাকে স্বাধীন বলে ঘোষণা দিয়ে বসেন এবং সম্মিলিতভাবে মোঘল সেনাদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যান।
বাদশা আকবর তাই পাঠানদের সাথে সমঝোতায় আসার জন্য চেষ্টা করছিলেন। কাকে দিয়ে সমঝোতা করা যায় তাই ভাবছিলেন। হঠাৎ তার মনে পড়ে বায়জীদ খান পন্নীর ছেলে সাঈদ খান পন্নীর কথা। তাঁর বিশ্বাস তাঁর মাধ্যমেই সমঝোতা করা সম্ভব। তাই তিনি সেনাপতি দেলোয়ার খাঁকে সংবাদ পাঠালেন সাঈদ খান পন্নীকে সশরীরে দিল্লীতে পাঠানোর জন্য।
দেলোয়ার খাঁ বায়েজীদপুরে আসার পূর্বেই বায়েজীদপুরে খবর এসে যায় যে মুঘল সেনাপতি স্বসৈন্যে বায়েজীদপুরে আসছে। তাদের ভয়ে চাকর চাকরানী সৈন্য সামন্ত সব পালিয়ে গেলে অন্ধকার রুমে একা সাইদ খান পন্নী পায়চারী করতে থাকেন। এমন সময় তার শিক্ষাগুরু বাবা আদম কাশ্মিরীর সুযোগ্য শিষ্য মাস্তান শাহ এসে অনেক সান্ত¦না দিয়ে বললেন, “বাবা সাইদ, যৌবনকাল মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদ অবহেলায় নষ্ট করা ঠিক হবে না। জেদের বশবর্তী হয়ে তুমি যদি মুঘলদের হাতে জীবন দাও তবে কী লাভ হবে? কাজেই নিজেকে বাঁচিয়ে জনসাধারণের জন্য কিছু করাই উচিত।” তখন সাইদ খাঁ তার শিক্ষা ও দীক্ষাগুরু বাবা আদম কশ্মিরীর শাহান শাহ (রহ.)-র সুযোগ্য শিষ্য মাস্তান শাহর হাত ধরে দিল্লির ফতেহপুর সিক্রিতে তাপস শ্রেষ্ঠ সেলিম শাহ চিস্তির আশ্রমে আসেন। সাঈদ খাঁ সেখানেই থেকে যান।
সেলিম শাহ চিস্তি বাদশা আকবরের গুরু। বাদশা আকবরের সাথে সাঈদ খান পন্নীর সেলিম শাহ চিস্তির দরবারেই মুলাকাত হয়। বাদশা আকবর তার সাথে মত বিনিময় করে আগ্রায় নিয়ে তার চাচাত বোন শাহাজাদী দলিয়ারের সাথে বিয়ে দিয়ে ঘোড়াঘাট ও সরকার বাজুহারের জায়গীর দান করেন।
সাঈদ খান পন্নী দেশে ফিরে এসে আটিয়ায় তার বাসস্থান নির্মান করেন। এভাবে উড়িষ্যার নবাব সুলায়মান খান পন্নীর বংশধর বাহু চড়াই উৎরাই পড়ি দিয়ে অবশেষে মুঘল সম্রাট আকবরের সুবেদারী নিয়ে আটিয়ায় বাসস্থান স্থাপন করে বসবাস করতে থাকেন। সাঈদ খান পন্নীর মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরি পূর্বপুরুষদের গৌরব স্মরণে রেখেই কৃতিত্বের সাথে জমিদারী পরিচালনা করেছেন।
আটিয়ার জমিদার অথাৎ বর্তমান করটিয়ার পন্নী পরিবারই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যশালী অভিজাত জমিদার। ষোড়শ সপ্তদশ শতাব্দী থেকে দীর্ঘ সাড়ে তিনশত বছরের শাসনকার্য পরিচালনার ঐতিহ্যগত মালিকানা বহন করছেন পন্নী বংশ।

 

(সম্পাদনায়: মুস্তাফিজ শিহাব, সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি)

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...