মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম:
আমাদের জন্য আল্লাহ সুদকে হারাম করেছেন এ কথা প্রতিটি ব্যক্তির নিকট স্পষ্ট। সমাজে আমরা সুদ শব্দটি ঘৃণার সাথে উচ্চারণ করলেও আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে সুদ মিশে রয়েছে। মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে অর্থনীতি। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে অর্থনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে সুদ। কিন্তু এ সুদের মধ্যে যে ঘৃণা ও অপবিত্রতা লিপ্ত রয়েছে তার থেকে রক্ষার জন্য বর্তমান মুসলিম জনগোষ্ঠী সুদের বিভিন্ন নাম ব্যবহার করছে। শুধু মুসলিম জনগোষ্ঠীই নয় অন্যান্য সকল ধর্মের মানুষের কাছেই সুদ ঘৃণিত এবং অন্যান্য সকল ধর্মেই সুদ নিষিদ্ধ। তবুও তারাও একইরূপে সুদকে প্রতারণামূলক ভাষার মোড়কে পুরে ব্যবহার করছে। যেমন ইংরেজিতে Usury শব্দটির বদলে Interest বেশি প্রচলিত, বাংলাতে সুদের বদলে লাভ, মুনাফা, মুদারাবা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ভাষাভেদে হারাম কখনও হালাল হয়ে যায় না।
এই সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার ফলে একটি জাতির সকল সম্পত্তি এক জায়গায় স্ত‚পীকৃত হয় ও এর ফলে বিশাল এলাকায় অর্থনৈতিক শূণ্যতাও দেখা যায়। আজকের এই ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় গুটিকয়েক পুঁজিপতি রাষ্ট্রের সিংহভাগ অর্থ সম্পদ দখল করে রাখার ফলে তারা আজ জঘন্য বিলাসিতায় মগ্ন ও অপরদিকে সাধারণ জনগণের বিরাট অংশ এখনও মৌলিক চাহিদাটুকুও পূরণ করতে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সুদভিত্তিক ব্যবস্থার মূলই হলো এর মাধ্যমে সম্পদ কয়েকজনের মধ্যে পুঞ্জিভ‚ত হয়। এই ব্যবস্থা যদি ১০ জন ব্যক্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় তবে অর্থনৈতিক অবিচার সৃষ্টি হবে তেমনি কোন দেশে প্রতিষ্ঠিত হলে সে দেশেও কিছু লোক ধনকুবেরে পরিণত হবে আর অধিকাংশ লোক শোষিত হবে। এই ব্যবস্থা যদি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় তবে কিছু রাষ্ট্র দুনিয়ার তাবত সম্পদের মালিকানা পেয়ে যাবে আর বাকি দুনিয়া তাদের দিকে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে রাখবে। আজ ঠিক তাই ঘটেছে। আজ সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক শোষণ ও ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণেই আল্লাহ সুদকে হারাম করেছেন।
মানুষের অর্থনীতির সঙ্গে লোকসংখ্যা ও রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে। এরা পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত তাই এর কোনটির একক সমাধান সম্ভব নয়। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এই জীবনব্যবস্থা সম্পূর্ণ মানবজাতির জন্য। ইসলামে যেমন সম্পদ পুঞ্জিভূত করে রাখা নিষিদ্ধ তেমনি নিষিদ্ধ ভৌগোলিক সীমারেখা টেনে জনসংখ্যার জন্য শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহর উভয় বিধানকে আজ অস্বীকার করার ফলে আজ মানবজাতি অপরিসীম দুঃখ ও যন্ত্রণায় নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে। আল্লাহ এ কারণেই ভৌগলিক ও জাতীয় বিভাজন নিষিদ্ধ করেছেন যাতে জনসংখ্যা একজায়গায় পুঞ্জিভূত না থাকে তেমনি অর্থনৈতিক নীতি হিসেবে সম্পদকে নির্দিষ্ট একভূত না করে অবিশ্রান্তভাবে সারা পৃথিবীতে ঘূর্ণায়মান রাখার (Fast circulating) নির্দেশ দিয়েছেন। একটি উদাহারণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার বুঝা যাবে। এক বালতি পানি মাটিতে (পৃথিবীতে) ঢেলে দিলে ঐ পানি চারদিকে ছড়িয়ে যাবে এবং স্বাভাবিক নিয়মেই যেখানে গর্ত (দারিদ্র্য) থাকবে সেটা ভরে দেবে, যেখানে উঁচু (সমৃদ্ধি) থাকবে সেখানে যাবে না এবং ঐ পানি নিজে থেকেই তার সমতল খুঁজে নেবে। ঐ বালতির পানি হলো জনসংখ্যা ও সম্পদ। আমরা যদি আল্লাহর দেয়া অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ ও প্রয়োগ না করি তবে আমাদের দারিদ্র ও প্রাচুর্যের ব্যবধান দুর হবে না, আর যতদিন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে একজাতি না হতে পারবো ততদিন আমাদের পৃথিবীতে সংঘর্ষ ও যুদ্ধ ও রক্তপাত (ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা) বন্ধ হয়ে শান্তি আসবে না।
কোর’আন ও হাদীসে সুদ:
আসুন আমরা পবিত্র কোরআন থেকে সুদ সম্পর্কিত আল্লাহর নির্দেশগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করি। আল্লাহর কোর’আনের একটি বৈশিষ্ট্য হল এতে আল্লাহ যে কোন বিষয় আদেশ বা নিষেধ করলে সে বিষয়ে যুক্তি প্রদান করেন। সুদ হারাম করার বিষয়টিও এমন। আল্লাহ বলেন:
(১) যারা সুদ খায় তারা সেই ব্যক্তিরই ন্যায় দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এ জন্য যে, তারা বলে, ‘ক্রয় বিক্রয় তো সুদের মত।’ অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন। যার নিকট তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে, তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই; এবং তার ব্যাপার আল্লাহর ইখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় আরম্ভ করবে তারাই অগ্নি অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে (সুরা বাকারা-২৭৫)।
(২) আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোন অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালবাসেন না (সুরা বাকারা ২৭৬)।
(৩) হে মো’মেনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের বকেয়া যাহা আছে তাহা ছাড়িয়া দাও যদি তোমরা মো’মেন হও (সুরা বাকারা ২৭৮)।
(৪) যদি তোমরা না ছাড় তবে আল্লাহও তাঁহার রসুলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। ইহার মাধ্যমে তোমরা অন্যায়, জুলুম করবে না এবং নিজেরাও অন্যায়ের শিকার হবে না (সুরা বাকারা ২৭৯)।
পবিত্র কোরআনের নির্দেশনার আলোকে রসুলাল্লাহ লানত করেছেন যে সুদ খায় তাহার প্রতি, যে সুদ দেয় তাহার প্রতি, যে সুদের দলিল লেখে তাহার প্রতি, যে দুইজন সুদখোরের সাক্ষী হয় তাহার প্রতি। রাসুলাল্লাহ ইহাও বলেছেন যে, তারা সকলেই সমান [জাবের রাঃ থেকে মুসলিম, মেশকাত]।
মেরাজের রাত্রে রসুলাল্লাহ (স.) কতগুলো লোককে দেখেন যে, তাদের পেট বড় বড় ঘরের মত। তিনি জিজ্ঞেস করেন, এই লোকগুলো কারা? বলা হয়- এরা সুদখোর।’ রাসুলাল্লাহ(সঃ) বলেছেন: যখন আমি লাল রং বিশিষ্ট একটি নদীতে পৌঁছাই যার পানি রক্তের মত লাল ছিল, তখন আমি দেখি যে, কয়েকটি লোক অতি কষ্টে নদীর তীরে আসছে। কিন্তু তীরে একজন মালায়েক অনেক পাথর জমা করে বসে আছেন এবং তাদের মুখ ফেড়ে এক একটি পাথর ভরে দিচ্ছেন। তারপর লোকগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। অতঃপর পুনরায় এই রূপই হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করে জানতে পারি যে, তারা সুদখোরের দল। তাদের এই শাস্তির কারণ এই যে, তারা বলতো সুদ ব্যবসায়ের মতই। তাদের এই প্রতিবাদ ছিল শরীয়তের ওপর এবং আল্লাহর নির্দেশের ওপর। তারা সুদকে ক্রয় বিক্রয়ের মত হালাল মনে করতো (বোখারী)।
তারপর বলা হচ্ছে- আল্লাহর উপদেশ শ্রবণের পর যে ব্যক্তি সুদ গ্রহণ হতে বিরত থাকে তার পূর্বের সব পাপ মার্জনা করে দেয়া হবে। যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ সে পূর্বে যা করেছে আল্লাহ তা ক্ষমা করেছেন (সুরা আল মায়েদা, আয়াত নং ৯৫)।
অতঃপর আল্লাহ বলেন- ’সুদের নিষিদ্ধতা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করার পরেও যদি সে সুদ গ্রহণ পরিত্যাগ না করে তবে সে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। চিরকাল সে জাহান্নামে অবস্থান করবে।’ এই আয়াতটি অবতীর্ণ হলে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন: ‘যে ব্যক্তি এখন সুদ পরিত্যাগ করলো না, সে যেন আল্লাহও তাঁর রসুলের (সা.) সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। হে জনমণ্ডলী! তোমরা সুদ গ্রহণ পরিত্যাগ কর এবং প্রত্যেকে ঐ জিনিস পরিত্যাগ কর যার মধ্যে সামান্যতম সন্দেহ রয়েছে (মুসনাদ-ই-আহমাদ)।
এখন কথা হল আমরা বর্তমানে যে ধর্মগুলি পালন করে যাচ্ছি তা ব্যক্তিগত ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও উপাসনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। পক্ষান্তরে সুদ বর্তমান রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে শুধু বৈধই নয় বরং ইচ্ছা-অনিচ্ছায়েও সুদের সাথে জড়িত হতে হচ্ছে। আমরা যে গাড়িতে চড়ছি, যে রাস্তায় হাটছি, যে পোশাক পড়ছি সেগুলো প্রতিটির সাথে সুদের সম্পর্ক রয়েছে।
ইসলামের মূল বাণী হচ্ছে আমরা আল্লাহর সাথে অঙ্গিকারবদ্ধ হবো যে আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে হুকুমদাতা মানবো না। এই অঙ্গীকার জীবনের ব্যক্তি ও সমষ্টিগত সর্ব অঙ্গনের জন্য প্রযোজ্য। আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি সর্বস্তরের যেখানে যেখানে আল্লাহর বক্তব্য রয়েছে সেখানে আর কারও বক্তব্য মানবো না। এটাই তওহীদের মূল কথা। এই তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহকে হুকুমদাতা থেকে বাদ দিয়ে যদি সেখানে মানুষের তৈরি নিয়মকানুন কে মেনে নিই তবে আমরা শেরকে লিপ্ত হবো যে পাপকে আল্লাহ কখনই ক্ষমা করবেন না। শিরকে লিপ্ত হলে আমরা যতই নামাজ, রোজা করি না কেন সেইসবের আর কোন অর্থ থাকে না।
সুতরাং জীবন থেকে সুদকে পরিহার করতে হলে আমাদের জাতীয় জীবনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। এছাড়া আর কোনভাবেই এই সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। আল্লাহর রসুল বলে গিয়েছেন, “এমন একটা সময় আসবে যখন সুদ সর্বব্যাপী হবে যে একটি লোকও সুদ খাওয়া থেকে রক্ষা পাবে না। কেউ সুদকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও সুদের ধূলা বা ধোঁয়া উড়ে এসে তাকে স্পর্শ করবে (আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আবু দাউদ, মেশকাত)।”