হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সার্বভৌমত্ব: তিনি সেই সত্তা যাঁর হুকুম মানতেই হবে

এম আর হাসান:
সার্বভৌমত্ব শব্দটি এসেছে সর্বভূমি থেকে। এর অর্থ হচ্ছে সর্বভূমির উপরে অবাধ কর্তৃত্ব। যিনি সমুদয় ভূমির অধীশ্বর তাকে বলে সার্বভৌমত্ব। নিরংকুশ আধিপত্য বোঝাতে সার্বভৌমত্ব শব্দটি সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা নিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যেমন জাঁ বোডিন, জন অস্টিন, থমাস হবস, জন লক এবং জাঁ-জ্যাক রুশোর প্রদত্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, সার্বভৌম সত্তা হচ্ছে এমন এক কর্তৃপক্ষ যিনি সকল আইনের ঊর্ধ্বে, সকল সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে, যিনি সর্বশক্তিমান। প্রকৃতপক্ষে রক্তমাংসের কোনো মানুষ ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। তাই এমন ক্ষমতার অধিকারী কোনো মরণশীল, পরমুখাপেক্ষী, ক্ষুদ্র জ্ঞানের অধিকারী ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অজ্ঞ ‘মানুষ’ কখনোই হতে পারে না। এজন্য ইসলামে সার্বভৌমত্বের জায়গা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যিনি সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন, যিনি সকল সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে, যিনি আদি ও অন্ত, যিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী, যিনি সর্বজ্ঞানী ও সকল সত্তার ধারক। সার্বভৌমত্বের ধারণা প্রকাশ করার জন্য আল্লাহ ইসলামের মূলমন্ত্র কলেমায় [লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা.)] ‘ইলাহ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ইলাহ শব্দের অর্থ তিনি সেই সত্তা, যার হুকুম মানতেই হবে (He who is to be obeyed)। এই কলেমাই ইসলামের ভিত্তি, এটিতে বিশ্বাস স্থাপন করাই আল্লাহর প্রতি ঈমান, এটাই তওহীদ, এটাই ইসলাম গ্রহণের শর্ত, এটাই সকল আমলের পূর্বশর্ত। সকল নবী-রসুল আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা, সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘আপনার পূর্বে আমি যে রসুলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই এবাদত (আনুগত্য) কর।’ (সুরা আম্বিয়া ২১:২৫)। এখানে মনে রাখতে হবে, কোর’আন আরবি ভাষায় এসেছে বলে ইসলাম যেমন কেবল আরবের জন্য আগত জীবনব্যবস্থা নয়, তেমনি ‘ইলাহ’ শব্দটি আরবি শব্দ বলে এই তওহীদ কেবল মুসলমানদের বিষয় নয়। যেহেতু ইসলাম ধাপে ধাপে এসেছে, তাই পূর্ববর্তী নবী-রসুলদের অনুসারীরা যারা বর্তমানে কেউ খ্রিষ্টান, কেউ হিন্দু, কেউ ইহুদি, কেউ জৈন, কেউ পারসিক ধর্মের পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছেন। তাদের ধর্মেরও মূল ভিত্তি ছিল এই তওহীদ, একমাত্র স্রষ্টাকে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ হিসাবে মেনে নেওয়া; যদিও সেই মূলমন্ত্রের ভাষা ছিল কখনও হিব্রু, সুমেরিয়, আভেস্তান, অ্যারামাইক, কখনো পালি বা সংস্কৃত ভাষা। সনাতন ধর্মের মূল মন্ত্র, একমেবাদ্বিতীয়াম (তিনি এক যার কোনো দ্বিতীয় বা শরিক নেই) এবং একমব্রহ্ম দ্বৈত্ব নাস্তি (একমাত্র ব্রহ্মাই সত্য, বাকি সবই মিথ্যা)- কথাগুলো তওহীদের ঘোষণারই প্রতিধ্বনি।

পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ এমনটাই বলেছেন যে, ‘তোমাদের ইলাহ একমাত্র আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, সকল জ্ঞানের অধিকারী।’ (সুরা ত্বাহা ২০:৯৮, সুরা মুমিনুন ২৩:১১৬, সুরা যুখরুফ ৪৩: ৮৪-৮৫)। এভাবে কোর’আনে বহু আয়াত রয়েছে যেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কাজেই আরবিতে ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র যে মর্মকথা তা কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর জন্য নয়। এটা সার্বজনীন, সমগ্র মানবজাতির জন্য সত্য।

কেন আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ (নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব) হিসাবে মানতে হবে, সেটারও যুক্তি তিনি বহু আয়াতে উপস্থাপন করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘যেহেতু তিনি সৃষ্টি করেছেন, তাই কেবল তাঁরই হুকুম দেওয়ার অধিকার রয়েছে’ (সুরা আরাফ ৭:৫৪)। তিনি অন্যত্র বলেন, ‘বলুন- হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী (মালিকুল মুলক)। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল। (সুরা আল ইমরান ৩:২৬)। সুতরাং সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনিই যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন, যাকে ইচ্ছা ক্ষমতাচ্যুত করেন। এখন মানুষের তৈরি যে বিধানাবলি দিয়ে দুনিয়া চলছে, সেখানে সার্বভৌমত্বের জায়গায় রয়েছে মানুষ। যেমন: গণতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব রয়েছে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতার হাতে, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের সার্বভৌমত্ব রয়েছে শ্রমজীবী মানুষের একদল প্রতিনিধির হাতে যাদের বলে পলিট ব্যুরো (Politburo), রাজতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব রয়েছে রাজার হাতে, এক নায়কতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব রয়েছে একনায়কের হাতে। এ সকল ব্যবস্থায় সার্বভৌমত্ব মানুষের হাতে থাকায় একটি পর্যায়ে সেই ক্ষমতাধর মানুষগুলো প্রায়শই স্বৈরাচার (Fascist) হয়ে ওঠে। এজন্য ইসলামের সার্বভৌম একমাত্র আল্লাহ। এ কারণেই আল্লাহর রসুল (সা.) ও তাঁর পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদিনের কেউ অর্ধ পৃথিবীর শাসক হয়েও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেননি। বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে বোঝাতে ছক আকারে দেওয়া হল:

এই বিন্যাসই এ কথা পরিষ্কার করে দিচ্ছে যে সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোন আপস সম্ভব নয়। ওপরের যে কোন একটাকে গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে বাদ দিয়ে অন্য যে কোনটি স্বীকার, গ্রহণ করে নিলে সে আর মুসলিম বা মো’মেন থাকতে পারে না। কোনো লোক যদি ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহ বিশ্বাসী এবং জাতীয় জীবনে ওপরের ছকের ইসলাম যে কোনটায় বিশ্বাসী হয় তবে সে মোশরেক। এ অবস্থায় সে যতই নামাজ, রোজা করুক কিছুই আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না। এটি ইসলামের একটি বুনিয়াদি ধারণাও বটে, যে বিষয়ে আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে ঘোষণা করেছেন, ‘অন্য যে কোনো অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করলেও তিনি কোনোভাবেই শিরক ক্ষমা করবেন না।’ (সুরা নিসা ৪:৪৮, ১১৬)।
সুতরাং আমাদের জীবনব্যবস্থা ভিত্তিমূল হিসাবে আমরা আল্লাহকে একমাত্র সার্বভৌমত্বের মালিক হিসাবে মেনে নিতে হবে। ইসলামের পরিভাষায় এটাই হচ্ছে তওহীদ। এটি আল্লাহর সাথে বান্দার এক প্রকার চুক্তি। আল্লাহ বহুবার বহুভাবে এ কথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন, আল্লাহর সার্বভৌমত্বে, সেরাতুল মুস্তাকিমে অর্থাৎ তওহীদে যে অটল থাকবে, বিচ্যুত হবে না, তার পৃথিবী ভর্তি গুনাহও তাকে জান্নাত থেকে ফেরাতে পারবে না। এ ব্যাপারে বোখারি, মুসলিমসহ অসংখ্য হাদিস পেশ করা যায়। আল্লাহর নবী (সা.) বলেছেন- বান্দাদের সাথে আল্লাহর চুক্তি (Contract) হচ্ছে, তারা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে মানবে না, তাহলেই আল্লাহ তাদের কোনো শাস্তি দেবেন না (জান্নাতে প্রবেশ করাবেন) [মু’য়ায (রা.) থেকে বোখারি, মুসলিম]।

তিনি আরও বলেছেন- যে হৃদয়ে বিশ্বাস করে যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) তাঁর রসুল, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন [ওবাদাহ বিন সোয়ামেত (রা.) ও আনাস (রা.) থেকে বোখারী, মুসলিম] আল্লাহর রসুল আরও বলেছেন- জান্নাতের চাবি হচ্ছে তওহীদ [মু’য়ায বিন জাবাল (রা.) থেকে আহমদ]। এখানে মনে রাখতে হবে যে, এই তওহীদ বর্তমানের ব্যক্তিজীবনের আংশিক তওহীদ নয়, এ তওহীদ সার্বিক জীবনের তওহীদ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, শিক্ষা ইত্যাদি মানব জীবনের সর্ব অঙ্গনের তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। সহজ বাংলায় এর মূল কথা হচ্ছে, জীবনের যে কোনো অঙ্গনেই হোক, আল্লাহর কোনো বিধান যদি থাকে সেক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম গ্রহণ করা যাবে না। এটাই হচ্ছে আল্লাহর নাজিল করার সামগ্রিক জীবনব্যবস্থার সিদ্ধান্ত সূত্র যার তাৎপর্য পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ এভাবে প্রকাশ করেছেন, “আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.) কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোনো মো’মেন পুরুষ কিংবা মো’মেনা নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। কেহ আল্লাহ এবং তাঁর রসুলকে অমান্য করলে সেতো স্পষ্টতই পথভ্রষ্ট।” (সুরা আহযাব ৩৩:৩৬)

[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১২৩০৯৭৫]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...