হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সাম্প্রদায়িক ঐক্য গঠনে আমাদের করণীয়

হুমায়ুন কবির:

এটা ঐতিহাসিক সত্য যে কেবল মাত্র স্রষ্টার বিধান অনুসরণ করেই মানবজীবন শান্তিময় হয়েছে। আল্লাহ যাঁদেরকে তাঁর নবী-রসুল-অবতাররূপে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন তাঁরা এবং তাঁদের যোগ্য অনুসারীরা যখন স্রষ্টার বিধান দিয়ে মানবসমাজকে পরিচালিত করেছেন তখন পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনাবিল শান্তি। প্রাচীন ভারবর্ষের শান্তিময় সমাজের কথা কিংবদন্তীরূপে মানুষের মুখে মুখে নন্দিত হচ্ছে। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির যুগ বলতে আজও রাজা দাউদ (আ:) ও রাজা সোলায়মান (আ:) এর যুগকেই বোঝানো হয়ে থাকে। এই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ অর্ধ-পৃথিবীতে শান্তির যুগ প্রতিষ্ঠিত হয় মহানবী মোহাম্মদ (দ:) ও তাঁর জাতির মাধ্যমে। যখনই মানবজাতি স্রষ্টার বিধানকে পরিত্যাগ করেছে, তখনই তারা ঘোর অশান্তিতে পতিত হয়েছে। বর্তমানে মানবজাতি যে অশান্তিতে নিমজ্জিত তার মূল কারণ এটাই।
সকল ধর্মই এসেছে একই স্রষ্টার পক্ষ থেকে, মানবতার নিশানকে সকলের ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্যই সকল ধর্মের আবির্ভাব। সেই ধর্মগুলি আজ কেবল আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। যার ফলে মানবজাতি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত। আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব সেই ধর্মগুলিকে ব্যবসায়ের পুঁজিতে পরিণত করেছেন ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি। শুধু তাই নয়, এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি (রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক) কায়েমী স্বার্থে এক ধর্মের মানুষকে অন্য ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য সেই ধর্মের উপাস্য, দেবদেবী, পবিত্র গ্রন্থাদি, পূজনীয় ব্যক্তিত্ব, উপাসনা ইত্যাদি সম্পর্কে অবমাননাকর উক্তি করে। তাদের প্ররোচনায় এক ধর্মের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে অন্য ধর্মের অনুসারীদের উপরে হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবেই সৃষ্টি হয় ধর্মীয় দাঙ্গার। একই ধর্মের মানুষ বিভিন্ন দেশে বসবাস করে। ফলে ধর্মীয় দাঙ্গাও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মানবজাতির অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়কালে কোটি কোটি মানুষ ধর্মীয় দাঙ্গায় প্রাণ দিয়েছে, কোটি কোটি মানুষের মানবাধিকার পদদলিত হোয়েছে। এই নতুন শতাব্দীতেও পৃথিবীতে যতগুলি যুদ্ধ-বিগ্রহ হোয়েছে, সবগুলির পেছনে মূল কারণ রাজনৈতিক আধিপত্য হলেও এতে ইন্ধন যুগিয়েছে ধর্মীয় বিদ্বেষ। অথচ সকল ধর্মের অবতারগণ একই স্রষ্টার প্রেরিত এবং তাঁদের প্রত্যেকের ধর্ম পৃথক পৃথক ছিলো না, তারা সবাই ছিলেন একই ধর্মের অনুসারী। তাহলে তাঁদের অনুসারীরা কেন শুধু শুধু নিজেদের মধ্যে বিভেদ লালন করে চলবেন? আর কতকাল তারা এভাবে ধর্মের নামে অধর্মকে জিইয়ে রাখবেন? এর সমাধান করা আশু কর্তব্য।
পাশাপাশি আছে ধর্মীয় উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ। ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেই নয় কেবল, প্রতিটি ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিকৃত উগ্র মতবাদের দেখা মেলে। তারা নিজেদের ধর্মীয় আদর্শকে জোর করে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। এই জঙ্গিবাদীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য একটি বিরাট বাধাস্বরূপ। বর্তমানে বিশ্বময় এই জঙ্গিবাদকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নির্মূল করার জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু এটা সঠিক পন্থা নয়, শক্তি প্রয়োগ করে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়, সাময়িক দমন করা সম্ভব। পশ্চিমা পরাশক্তিগুলিও এই পথে এখন পর্যন্ত সফলতা অর্জন করতে পারে নি। না পারার কারণ, জঙ্গিবাদ একটি আদর্শিক বিষয়, যেখানে একটি ভ্রান্ত আদর্শের দ্বারা একজন মানুষকে সহিংস কাজে উজ্জীবিত করে তোলা হয়, এমন কি এই কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলেই পরম সফলতা জান্নাত প্রাপ্ত হবে বলে শিক্ষা দেওয়া হয়। এই ভ্রান্ত আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ বুকে বোমা বেঁধে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জীবন দিয়ে দিতেও দ্বিধা করে না। এই কাজটি কিন্তু তাদেরকে দিয়ে জোর করে করানো যেত না, কারণ সকলের কাছেই জীবন মূল্যবান। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েই তাদেরকে দিয়ে এই কাজ করানো সম্ভব হয়। যদি সাধারণ মানুষকে ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা ও প্রমাণসহ বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে, জঙ্গি কর্মকাণ্ড করে জান্নাতে যাওয়া যাবে না উপরন্তু এই পথে চললে মানুষ দুনিয়াও হারাবে আখেরাতও হারাবে, তাহলেই আর কেউ ঐ ভুল পথে পা বাড়াবে না এবং ইতোমধ্যে যারা ভ্রান্তির মধ্যে পতিত হয়েছে তারাও সেই পথভ্রষ্টতা থেকে ফিরে আসবে। কিন্তু তা না করে যদি কেবল শক্তিপ্রয়োগ করে তাদেরকে দমন করার চেষ্টা করা হয়, তবে তারা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠবে। এতে জঙ্গিবাদ গোপনে গোপনে বিস্তারলাভ করবে এবং যে কোন সুযোগ পেলেই আবার সমাজের শান্তিভঙ্গ করবে। একইভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও জোর করে দমন করলে সেটা নির্মূল হবে না, হয়তো সাময়িক নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তবে একে পুরোপুরি দূর করে কেবল পরমতসহিষ্ণুতা নয়- সকল ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাদেরকে বোঝাতে হবে যে, সকল ধর্মই স্রষ্টা থেকে এসেছে, সকল নবী-রসুল-অবতারগণও সেই একই স্রষ্টার প্রেরিত, সকল মানুষই একই বাবা-মা আদম-হাওয়ার সন্তান, সুতরাং তারা সকলে ভাই ভাই। সকল ধর্মগ্রন্থ একই স্রষ্টার বাণীকে ধারণ করে আছে, তাই সেগুলিও সমানভাবে শ্রদ্ধেয়। এই শিক্ষা যদি সর্বসাধারণকে দেওয়া যায় তবে কেউ আর অন্যের ধর্মের প্রতি অবমাননা হয় এমন কোন কাজ করবে না, ভিন্ন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা বিস্তার করবে না।
“মানবজাতির কল্যাণার্থে উপর্যুক্ত বিষয়গুলিতে সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আজ একমত হওয়া আবশ্যক”- এটা উপলব্ধি করে ধর্মীয় সংস্কারমূলক আন্দোলন হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর অনুসারীদের আহ্বানে আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ গত ২০ আগস্ট ২০১৪ ঈসায়ী তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেমিনার কক্ষে আলোচনায় বসেন। তারা সকলেই সর্বসম্মতিক্রমে এই মতে উপনীত হন যে, আমাদের দেশের সর্বশ্রেণির মানুষের সামনে উপর্যুক্ত বিষয়গুলি তুলে ধরে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এটা করতে পারলেই জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নামক এই যুগ যুগান্তরের অভিশাপ থেকে আমরা মুক্তি পাবো। আর ধর্মব্যবসায়ীরাও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে প্রভাবিত করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে পারবে না। এত বড় একটি কাজ আমাদের নাগরিক উদ্যোগে সম্পূর্ণরূপে করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলির যথাযথ সহযোগিতা প্রদান। আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি, আমরা যদি সবাই মিলে সকল ধর্মের মধ্যে যে মিলগুলি রয়েছে, মানবতার কথাগুলি রয়েছে সেগুলিকে ঐক্যসূত্র হিসাবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারি, তবে আন্তঃধর্মীয় বিদ্বেষ দূরীভূত হবে, ধর্মব্যবসায়ী ও জঙ্গিবাদীদেরকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করবে। ফলে এই উদ্যোগ মানবতার কল্যাণে এবং দেশের শান্তিরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে।.

লেখক: যামানার এমামের অনুসারী;

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...