হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম:
আমরা বাংলাদেশে মুসলমানরা যখন ঈদের আনন্দ করছি, নামাজ-রোজা করছি, ব্যবসা-বাণিজ্য করছি, অফিস-আদালতে কাজ করছি, ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের থেকে মাত্র ছয় হাজার কিলোমিটার দূরে পবিত্র আরব ভূমির ফিলিস্তিনি মুসলমানদের জীবনে যেন মহাপ্রলয় নেমে এসেছে। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের মুসলমানরা ইসরায়েলি বাহিনীর নির্যাতন, হামলা ও দখলদারিত্বের শিকার হয়ে আসছে। ২০২৩ সাল থেকে এই সহিংসতা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জাতিগতভাবে মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য এখন সেখানে প্রতি মুহূর্তে চলছে বোমাবর্ষণ। ঘরবাড়ি, মসজিদ, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ সকল স্থাপনা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আল জাজিরার তথ্য মতে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত গাজায় ৩৫টি হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। লক্ষ নিরপরাধ মানুষ নির্মমভাবে প্রাণ হারাচ্ছে। শুধু গত এক বছরে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার শিশু ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, নিহতদের কবর দেওয়ারও লোক নেই। উদ্বাস্তু শিবিরে এক বোতল পানির জন্য ছুটে গেলে, সেখানেও বোমা মেরে হত্যা করা হচ্ছে মানুষকে। সোজা কথা, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার ফলে যে অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।
৭৫ বছরের হত্যাযজ্ঞের পরে এবার ইসরাইল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই ভূমিতে আর কোনো একজন মুসলমানকেও থাকতে দেওয়া হবে না। ফিলিস্তিনকে তারা মানচিত্র থেকে একেবারে মুছে দেবে। সেখানকার মুসলমানরা হয় অন্য দেশে চলে যাবে, অথবা তাদেরকে হত্যা করা হবে। এ ধরনের হৃদয়বিদারক, ন্যাক্কারজনক ও পৈশাচিক ঘটনা কেবল ফিলিস্তিনে নয়, মিয়ানমার, বসনিয়া, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, সোমালিয়াতেও হয়েছে, যার নীরব সাক্ষী সমগ্র বিশ্ব। এমন একটি পরিস্থিতিতেও গোটা বিশ্বের ২০০ কোটি মুসলমান ও ৫৫টা মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রের সরকারগুলো এবং মুসলমানদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওআইসি, আরব লীগ এত অসহায় কেন? মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা, হিউম্যান রাইটস, জাতিসংঘ নীরব দর্শক হয়ে আছে কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। একটি প্রবল পরাক্রমশালী শক্তির কাছে সবাই নতি স্বীকার করেছে, তার পদতলে সবাই গড়াগাড়ি খাচ্ছে। এই শক্তিটার নাম ‘ইহুদি-খ্রিষ্টান বস্তুবাদী সভ্যতা’ তথা দাজ্জাল। এর আবির্ভাবের কথা মহানবী (সা.) দেড় হাজার বছর আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। দাজ্জালের শক্তি সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে একটি দানব আসবে, যার এক পা থাকবে মাগরেবে অর্থাৎ পশ্চিমে, আরেক পা মাশরেকে অর্থাৎ পূর্বে। সমস্ত পৃথিবী চামড়া দিয়ে মোড়ানো একটি ডিমের মতো তার করায়ত্ত হবে। সমগ্র মানবজাতি তার পদতলে সেজদা করবে, তাকে প্রভু বা রব বলে মেনে নেবে। যে তার হুকুম মানবে তাকে সে রেজেক দেবে, যে তার আনুগত্য করবে না সে তাকে রেজেক দেবে না, না খাইয়ে রাখবে। তার প্রতারণা, ছলনা সেটা কেমন হবে তা বোঝানোর জন্য রসুল তাকে দাজ্জাল বলে অভিহিত করেছেন যার অর্থই হচ্ছে- চাকচিক্যময় প্রতারক। রসুল বলেছেন, তার এক হাতে থাকবে জান্নাত, আরেক হাতে জাহান্নাম। যে তার হুকুম মানবে তাকে সে তার জান্নাতে স্থান দেবে। কিন্তু সেটা প্রকৃতপক্ষে হবে জাহান্নাম। পক্ষান্তরে যে তার হুকুম মানতে অস্বীকার করবে, তাকে সে তার জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। বাস্তবে সেটা হবে জান্নাত। অর্থাৎ যারা দাজ্জালের জান্নাত দেখে প্রলুব্ধ হবে তারা প্রতারিত হবে।
কথা হচ্ছে, কী এই দাজ্জাল? হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী ইতিহাস, হাদিস, বাইবেল ও বৈজ্ঞানিক সত্য দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ইহুদি-খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’-ই হচ্ছে সেই ভবিষ্যদ্বাণীর ভয়ানক দানব দাজ্জাল। বিগত শতাব্দীতে এই সভ্যতা মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে দুইটি বিশ্বযুদ্ধ করে প্রায় ১৩ কোটি আদম সন্তান হত্যা করেছে। তারপর থেকে বিভিন্ন যুদ্ধে হত্যা করেছে আরো কয়েক কোটি মানুষ। আহত বিকলাঙ্গ উদ্বাস্তুর কোনো গোনাগাঁথা নেই।
এখন সে টার্গেট করেছে মুসলমানদের, কারণ মুসলমানদের কাছে আছে পাল্টা জীবনব্যবস্থা যা দাজ্জালের তৈরি করা জীবনব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। কিন্তু দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য থাকা অপরিহার্য, থাকতেই হবে। মুসলমানদের মধ্যে দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়াই করার একটি প্রেরণা গত ১৪শ বছর ধরেই আছে, কিন্তু মো’মেন ছাড়া কেউ দাজ্জালকে চিনবে না। তাই এই জাতি দাজ্জালকে চিনতে পারছে না। তাহলে তাদের আগে মো’মেন হতে হবে। মো’মেন হবে কীভাবে সেটা মহান আল্লাহ সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে মো’মেনের সংজ্ঞার মধ্যে বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মো’মেন শুধু তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ঈমান আনে, অতঃপর কোনোরূপ সন্দেহ পোষণ করে না এবং জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ (সর্বাত্মক সংগ্রাম) করে। আল্লাহর প্রদত্ত এই সংজ্ঞা মুসলমান জনগোষ্ঠীর কাছে অপরিচিত। দাজ্জালকে চেনা তাদের জন্য এখন বাধ্যতামূলক, কারণ এর সামরিক শক্তি, এর হাতে থাকা বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি, এর অর্থনৈতিক শক্তি এতটাই প্রবল যে আজকের সমগ্র দুনিয়া তার কাছে সারেন্ডার করতে বাধ্য হয়েছে। সে তার শয়তানি শক্তি নিয়ে মুসলিম বিশ্বকে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে, ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে, গণহত্যা চালাচ্ছে একের পর এক ভূখণ্ডে। তাকে মোকাবেলা করতে দরকার আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত একটি দল। মো’মেনদের একটি বাহিনী ছাড়া দাজ্জালীয় তাণ্ডবের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আর তাকে না চেনা পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে মুসলিম জনসংখ্যার ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করারও প্রশ্ন আসে না। তাই হেযবুত তওহীদ দাজ্জালের পরিচয় সর্ব উপায়ে তুলে ধরছে।
এখন মুসলিম জাতি ঐক্যবদ্ধ হবে কীসের ভিত্তিতে। হ্যাঁ, তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে একমাত্র তওহীদের ভিত্তিতে, আর সেই ঐক্য হবে সীসার তৈরি প্রাচীরের ন্যায় নিñিদ্র, মজবুত। ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা কী করবে? তারা জেহাদ করে, সংগ্রাম করে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করবে, যার নির্দেশ আল্লাহ সুরা শুরার ১৩ নম্বর আয়াতে দিয়েছেন। আরো বহু আয়াতেও তিনি রাসুলকে সংগ্রাম করে আল্লাহর পাঠানো হেদায়াহ ও সত্যদীন প্রতিষ্ঠার হুকুম দিয়েছেন (সুরা তওবা ৩৩, সুরা সফ ৯, সুরা ফাতাহ ২৮)। মহানবীর সমগ্র জীবন যদি এক দৃষ্টিতে কেউ দেখেন তাহলে তিনি নিশ্চিতরূপে বলতে বাধ্য হবেন যে, তাঁর সমগ্র নব্যুয়তি জীবন অতিবাহিত হয়েছে সংগ্রামে, সংঘর্ষে, লড়াইয়ে। একাগ্র লক্ষ্যে (হানিফ) অটল সবর এবং আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কাল করে তিনি খেয়ে না খেয়ে, পেটে পাথর বেঁধে, গাছের লতাপাতা খেয়ে, তপ্তর মরুর বালিতে রক্ত ঝরিয়ে এই সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। সংগ্রাম করার জন্য তিনি একটি উম্মাহ তৈরি করেছেন, যেই উম্মাহকে সামরিক শৃঙ্খলা ও চরিত্র, লোহার মত ঐক্য এবং নিজেদের জীবন-সম্পদকে কোরবানি করে দুর্বার সংগ্রাম করে সমগ্র ধরাপৃষ্ঠে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেছেন। আল্লাহর দেওয়া কর্মসূচি তিনি অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেছেন। সেটা হচ্ছে- ঐক্য, নেতার আদেশ শোনা, নেতার আদেশ পালন করা, শিরক ও কুফর থেকে হিজরত করা এবং আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ (সংগ্রাম) করা। (হাদিস- হারিস আল আশয়ারি রা. মুসলিম, মেশকাত, বাব উল ইমারত, ইবনে মাজাহ)।
দীন প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামই হচ্ছে তাঁর সুন্নাহ। যখন আমরা আল্লাহর তওহীদের উপর ঈমান এনে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করব, তখন সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াত মোতাবেক মো’মেনের সংজ্ঞা পূর্ণ হবে। এই মো’মেনের সঙ্গে আল্লাহর ওয়াদা যে তিনি তাদেরকে সাহায্য করবেন (সুরা নসর ১), তাদেরকে বিজয়ী করবেন (সুরা সফ ১৩), তাদের মোকাবেলা করতে আসলে কাফেররা পালিয়ে যাবে (সুরা ফাতাহ ২২-২৩) তাদের সাহায্যের জন্য ৫ হাজার মালায়েক প্রস্তুত আছে (সুর ইমরান ১২৪-১২৫), এবং তাদেরকে দুনিয়ার কর্তৃত্ব দেওয়া হবে (সুরা নূর ৫৫)। কাজেই এখন সমগ্র উম্মাহর কর্তব্য হচ্ছে, ডানে বামে না তাকিয়ে মানুষের তৈরি সমস্ত বিধি-ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে খালেস দিলে তওবা করে এক আল্লাহর তওহীদের উপরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, একজন নেতার নেতৃত্ব মেনে নিয়ে, আল্লাহর দেওয়া কর্মসূচি অনুসরণ করে, তাদের যা কিছু আছে- মেধা, শ্রম, সামর্থ্য, সম্পদ, জীবন সব একত্র করে এই দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে অবতীর্ণ হওয়া। তাহলেই আসবে আল্লাহর সেই প্রতিশ্রুত সাহায্য যার সামনে পৃথিবীর সকল শক্তি পরাজিত হতে বাধ্য। নববর্ষের শুভেচ্ছা সবাইকে। নতুন চেতনা ও প্রত্যয় নিয়ে শুরু হোক আমাদের নতুন বছর।
[লেখক: এমাম, হেযবুত তওহীদ,
ইমেইল: hezbuttawheed.official@gmail.com
যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১২৩০৯৭৫]