গতকাল যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পালিত হলো শব-ই-বরাত। অনেকেই রাত জেগে নফল আমল করেছেন, জিকির-আজকার করেছেন। শবে বরাত বার্তা দিচ্ছে যে কিছুদিন পরেই শুরু হচ্ছে মাহে রমজান। রহমত, বরকত, মাগফেরাতের পয়গাম নিয়ে মাহে রমজানের চাঁদ উঠবে। পরবর্তী একমাস মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রোজা রাখবেন, সারাদিন না খেয়ে থাকবেন, পানাহার থেকে বিরত থাকবেন, বিশেষ জৈবিক চাহিদা পুরণ থেকে বিরত থাকবেন। অনেক পরহেজগার তাকওয়াবান মানুষ সারা বছর অপেক্ষা করেন এ মাসটির জন্য। অনেকে অসুস্থতা সত্ত্বেও পানাহার থেকে বিরত থাকেন আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্য। আল্লাহর হুকুম পালনের মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত কিন্তু প্রত্যেকটি হুকুমের আলাদা উদ্দেশ্য বা আকিদা থাকে। সেটা না বুঝে পালন করলে সেই আমল অর্থহীন। সকল আমলেরই পূর্বশর্ত হলো ঈমান ও আকিদা। ঈমান ও আকিদা ভুল হলে যত ঐকান্তিকতা ও আন্তরিকতা নিয়েই আমলগুলো করা হোক সেগুলো অর্থহীন হয়ে যায়।
পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহ পরিষ্কারভাবে বলেছেন, “যে সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নাই, তোমরা তার অনুসরণ কোরো না (সুরা বনি ইসরাইল- ৩৬)”। এটা ইসলামের একটি মৌলিক নীতি – আগে জানা, তারপরে কাজ করা। সমস্ত হক্কানী আলেমরা এ ব্যাপারে একমত যে আকিদা যদি সঠিক না হয় তবে ঈমান ও আমলের কোনটারই মূল্য নাই। আকিদা ভুল হলে ঈমানও ভুল খাতে প্রবাহিত হবে। এই আকিদাটা হলো একটি বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা (ঈড়সঢ়ৎবযবহংরাব ঈড়হপবঢ়ঃ) বা বোঝা। তাই আমরা বোঝার চেষ্টা করবো যে সওমের উদ্দেশ্য কী?
নব্যুয়তের দায়িত্ব লাভ করেই নবী করিম (সা.) জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত আরব জাতিকে একটি কথার দিকে আহ্বান করলেন যে, তোমরা যদি যাবতীয় অন্যায় অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে চাও, ইহকাল ও পরকালে সফল হতে চাও তাহলে একটি কথার উপর ঐক্যবদ্ধ হও – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ (সা.) অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম ছাড়া আর কারো হুকুম মানবো না এবং মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল। প্রকৃত অর্থে তওহীদের এই ঘোষণা একটা বিপ্লবের ঘোষণা, মানুষের আমূল পরিবর্তনের ঘোষণা; যে বিপ্লব ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থার কাঠামো ও পদ্ধতি পরিবর্তনের বিপ্লব, অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের বিপ্লব, মানুষের আধ্যাত্মিক পরিবর্তনের বিপ্লব। রসুলাল্লাহর কণ্ঠে উচ্চারিত এই তওহীদের আহ্বান যেখানেই ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল সেখানেই আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। এই তওহীদের আহ্বান একটি চিরন্তন আহ্বান যা প্রতি যুগে একেকটি সমাজকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে, নির্মাণ করেছে নতুন নতুন সভ্যতা ও সভ্য জাতি। যখনই সমাজ অন্যায়-অবিচার, অশান্তিতে নিমজ্জিত হয়ে যায় তখনই সমাজের অন্যায়-অবিচার থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তওহীদের কোনো বিকল্প নেই। একই তওহীদের ডাক নিয়ে লাখো নবী-রসুল ধরাপৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়েছে যাঁদের ধারাবাহিকতার সবশেষে এসেছেন আখেরি নবী মোহাম্মদ (সা.)।
তাঁর উদাত্ত আহ্বানে যারা এই একটি কথার উপর ঐক্যবদ্ধ হলো, তারা হলো মো’মেন। সেই মো’মেনরা যেন ঐক্যবদ্ধ থাকেন, তাদের লক্ষ্য ঠিক থাকে, তারা যেন শৃংখলাবদ্ধ থাকেন, তারা যেন একজন নেতার প্রতি আনুগত্যশীল হন, সব সময় যেন আল্লাহর হুকুমের প্রতি অনুগত থাকেন সেজন্য তাদেরকে প্রশিক্ষণ হিসাবে দেওয়া হলো দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাহ কায়েমের হুকুম। এই হুকুম আসে নব্যুয়তের একাদশতম বর্ষে। আর রোজার বিধান এসেছে মদিনায়।
রসুলাল্লাহ উম্মতে মোহাম্মদী নামক জাতিটি তৈরি করেছেন একটি বিরাট উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে। সেটা হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবজীবন থেকে যাবতীয় অন্যায়, অশান্তি দূরীভূত করে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্যে সংগ্রাম করে যাওয়াই ছিল তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য। এর প্রমাণ হচ্ছে তাঁর সমগ্র কর্মময় সংগ্রামী জীবন। যারা তাঁর সমগ্র জীবনকে এক নজরে দেখবে তারা এটা অস্বীকার করতে পারবেন না যে এই মহাবিপ্লবী মহামানবের সমস্ত আহ্বান, চেষ্টা প্রচেষ্টা, আদেশ-উপদেশ, নিষেধ, যুদ্ধ-সংঘাত সমস্ত কিছুর উদ্দেশ্য ছিল মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা। এ কথাটিই নব্যুয়তের প্রথম যুগে একদিন তিনি খাব্বাবের (রা.) এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, দেখবে অচিরেই এমন সময় আসবে যে একা একটা মেয়ে মানুষ রাতের অন্ধকারে স্বর্ণালংকার পরিহিত অবস্থায় সানা থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত হেঁটে যাবে। তার মনে আল্লাহ ও বন্য জন্তুর ভয় ছাড়া আর কোন ভয় থাকবে না (খাব্বাব রা. থেকে বোখারী)। পরবর্তীতে তাঁর নিজের ও তাঁর হাজার হাজার আসহাবের পবিত্র রক্তের বিনিময়ে ঠিকই এমন একটি শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটা ইতিহাস। শত শত বছর অর্ধ দুনিয়ায় সেই অবস্থা বিরাজ করেছিল। এই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সংগ্রাম করতেই সৃষ্টি করা হয়েছে উম্মতে মোহাম্মদীকে। তাই তাদের প্রয়োজন হয়েছে বিশেষ আত্মিক, মানসিক ও শারীরিক শক্তির। এই চরিত্র গঠনের জন্যই প্রশিক্ষণ হলো সালাহ, সওম ইত্যাদি। দীনের বুনিয়াদ পাঁচটি।
১) কলেমা বা তওহীদ। আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানবো না, এই চুক্তিতে আল্লাহর সঙ্গে আবদ্ধ হওয়াই হচ্ছে তওহীদ গ্রহণের তাৎপর্য। এটি হচ্ছে ঈমান। পরবর্তী চারটি হচ্ছে আমল। এটি সকল আমলের পূর্বশর্ত।
২) সালাহ কায়েম করা। ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, পরিচ্ছন্নতা, সময়ানুবর্তিতা, ভ্রাতৃত্ব, আল্লাহর হুকুমের প্রতি সর্বাবস্থায় অনুগত থাকা ইত্যাদি গুণাবলী (Attributes) চরিত্রে প্রতিষ্ঠার প্রশিক্ষণ।
৩) যাকাত প্রদান করা। যাকাতের মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আসবে। সম্পদ যেন ধনীদের কাছে পুঞ্জিভূত হতে না পারে এবং ধনী গরীবের ব্যবধান যেন দূর হয়, সেজন্য যাকাতের ব্যবস্থা।
৪) হজ। এটি একদিকে যেমন মুসলিম উম্মাহর বাৎসরিক মহা সম্মেলন, অপরদিকে হাশরের দিন আল্লাহর সামনে নিজের যাবতীয় আমল নিয়ে দণ্ডায়মান হওয়ার মহড়া। এই হজের সম্মেলনে মুসলিমদের জাতীয় সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে, সমাধান করা হবে, পরবর্তী বছরের কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে। পাশাপাশি নবী-রসুলদের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শন ছাড়াও আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক বহু উদ্দেশ্য হজের রয়েছে।
ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ বা রোকন এই রোজা বা সওম। সেই সওমের উদ্দেশ্য কি? আল্লাহ নিজেই বলেছেন, “লা আল্লাকুম তাত্তাকুন (সুরা বাকারা- ১৮৩) অর্থাৎ যেন তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো। তাকওয়া অর্থ কী? তাকওয়া অর্থ ন্যায়-অন্যায় বুঝে পথ চলা। অন্যায়কে বর্জন করে ন্যায়কে সঙ্গে নিয়ে পথ চলা। আল্লাহ যেটা বলেছেন ন্যায়, সেটা ন্যায় আর আল্লাহ যেটা বলেছেন অন্যায় সেটা অন্যায়। সওম শব্দের অর্থ হলো আত্মসংযম (Self-Control)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর বান্দাকে এটা বুঝাতে চাচ্ছেন মানুষ কেবল পশু নয়। মানুষের দেহ যেমন সত্য তার আত্মাও তেমন সত্য। ইহকাল যেমন সত্য পরকালও তেমন সত্য। সে জন্য মানুষকে ইন্দ্রীয়কে নিয়ন্ত্রণও রাখতে হয়, সংযমীও হতে হয়। মানুষের একদম ভোগ বিলাসী জীবনযাপন হলো তাকওয়া অর্জনের প্রথম অন্তরায়। ন্যায় অন্যায় বুঝে পথ চলতে মানুষের আত্মার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা অপরিহার্য। সে মুখে যা আসবে তা-ই বলবে না, সে কেবল সত্যই বলবে। সে পশুর মতো উদরপূর্তি করে খাবে না, সে পরিমিত খাবে। তার সম্পদের উপর অনাহারী দরিদ্র মানুষেরও হক রয়েছে। এছাড়াও তাঁর উপর দুনিয়াময় সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দায়িত্ব আল্লাহ অর্পণ করেছেন। সেই সংগ্রামী জীবনে অনাহার একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়, যেটা রসুলাল্লাহ ও তাঁর আসহাবগণের জীবনে বার বার ঘটেছে। তাই সওম মানুষকে ক্ষুধার কষ্টকে সহ্য করার শক্তি দান করে। জৈবিক কামনা-বাসনাও যেন সে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সে শিক্ষাও সওম থেকে মেলে। এই হলো সওমের উদ্দেশ্য অর্থাৎ আত্মার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, ভোগীর জীবন যাপন না করে ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া, ত্যাগী হওয়া।
সওম ভঙ্গের অনেকগুলো কারণ আছে সেগুলো মোটামুটি আমরা সবাই জানি। কিন্তু নবী করিম (সা.) বলেছেন যে একটা সময় আসবে যখন মানুষ সারাদিন সওম রাখবে কিন্তু সেটা হবে না খেয়ে থাকা। মানুষ রাত জেগে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়বে, কিন্তু সেটা হবে কেবল ঘুম নষ্ট করা (ইবনে মাজাহ, আহমাদ, তাবারানী, দারিমি, মেশকাত)। এ হাদিসটির গভীর তাৎপর্য রয়েছে যা আজকের বাস্তবতায় উপলব্ধি করা জরুরি। রোজা রাখলে সেটা কেন উপবাস করার সমতুল্য হবে? নবী করিম (সা.) এমন একটি নফল বাছাই করলেন, তাহাজ্জুদ। কোটি কোটি মুসল্লি আছেন যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, জুমার নামাজ পড়েন কিন্তু তাহাজ্জুদ পড়তে পারেন না। কারণ এটা খুব কঠিন একটি আমল। গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে, শীত গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে তাহাজ্জুদ পড়া খুব সাধারণ মুসল্লিদের কাজ নয়। অর্থাৎ মোকাম্মেল ঈমান ছাড়া তাহাজ্জুদ পড়া সম্ভব নয়।
আবার ফরজের মধ্য থেকে এমন একটি ফরজ বাছাই করলেন অর্থাৎ সওম যেটা লোক দেখিয়ে করা সম্ভব নয়। অন্য সব আমল লোক দেখানোর জন্যও করা যায়। নামাজ পড়ে নামাজি সাজা যায়, গনীমতের লোভে, মানুষ বীর বলবে সে জন্য জেহাদও করা যায়, হাজী হিসাবে সমাজে সম্মান পাওয়ার জন্য হজ করা যায়। কিন্তু সওম সঠিক হলো কিনা কেবলই আল্লাহ জানবেন, কারণ মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে পানাহার করা সম্ভব। কিন্তু সেটা না করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই মানুষ সওম রাখে। সেই সওম আর তাহাজ্জুদের মতো আমল যদি নিষ্ফল হয়ে যায় তাহলে অন্যান্য আমলের কী অবস্থা হবে?
প্রশ্ন হলো এই নিষ্ফল হওয়ার কারণ কী? কারণ হলো, মানুষ হেদায়াহ (সঠিক পথ) থেকে বিচ্যুত হবে। কিন্তু তাকওয়ার চর্চা করে যাবে। আজ মানুষ আল্লাহর তওহীদ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। তারা এলাহ বা হুকুমদাতা হিসাবে মানছে গায়রুল্লাহকে। মানছে মানুষের হুকুম, পাশ্চাত্য সভ্যতার তৈরি হুকুম। কিন্তু নামাজ রোজা ও তাকওয়ার কাজগুলো ঠিকই করে যাচ্ছে। ভুল পথে সারাদিন হেঁটে দিনশেষে গন্তব্যে পৌঁছা যায় না। এ কথাটিই রসুলাল্লাহর আরেকটি হাদিসে খুব চমৎকার ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, এমন সময় আসবে যখন- (১) ইসলাম শুধু নাম থাকবে, (২) কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে, (৩) মসজিদসমূহ জাঁকজমকপূর্ণ ও লোকে লোকারণ্য হবে কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না, (৪) আমার উম্মাহর আলেমরা হবে আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব, (৫) তাদের তৈরি ফেতনা তাদের ওপর পতিত হবে। [হযরত আলী (রা.) থেকে বায়হাকী, মেশকাত]
রসুলাল্লাহ বলেছেন, মসজিদসমূহ হবে লোকে লোকারণ্য কিন্তু সেখানে হেদায়াহ (সঠিক পথ তথা তওহীদ) থাকবে না। আমরা এখন এমন সময়েই বাস করছি। তাই আমরা যদি তওহীদে না আসি তাহলে আমাদের যাবতীয় নেক আমল সেটা নামাজ রোজা হজ যাকাত যা-ই হোক সবই অর্থহীন। আসন্ন মাহে রমজান আমাদের হৃদয়ে আল্লাহর তওহীদে প্রবেশ করে অতঃপর আল্লাহর হুকুম পালনের বোধ জাগ্রত করুক। মাহে রমজানের সওম যেন প্রত্যেকটি মো’মেনের আত্মার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সফল হয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে যেন তাদের সেই তাকওয়ার প্রতিফলন ঘটে এমনটাই আমাদের প্রার্থনা।