জনগণ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক উপাদান। সরকার হচ্ছে রাষ্ট্রের মস্তকতুল্য এবং জনগণ তার দেহ। দেহকে গুরুত্বহীন মনে করা তাই বিরাট বোকামি। যখন কোনো রাষ্ট্র তার জনগণের মধ্যে আস্থা হারায় তখন ক্রমে তার সবগুলো ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার পঁয়ত্রিশ জনে একজন করে পুলিশ। সেই পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে আবার রয়েছে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সেই ব্রিটিশ যুগ থেকেই পুলিশদের ভয় পেয়ে অভ্যস্ত। এখন সেই ভয় আতঙ্কের রূপ নিয়েছে। পুলিশ নির্দোষ মানুষকে গ্রেফতার করে মুক্তিপণ নেয় এমন অভিযোগ সর্বত্র রয়েছে।
সব সন্ত্রাসকে একই দৃষ্টিতে দেখা যায় না। কিছু আছে সামাজিক সন্ত্রাস। স্বার্থের জন্য বা ব্যক্তিগত কারণে এগুলো ঘটানো হয়ে থাকে। আরেক শ্রেণির সন্ত্রাস রয়েছে যাকে বলা হয় মতবাদগত সন্ত্রাস। সমাজতন্ত্র যখন ব্যর্থ হলো তখন অনেক সমাজতান্ত্রিক দল সন্ত্রাসবাদী হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত যে পরিমাণ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে তার অধিকাংশই হয়েছে এই সমাজতান্ত্রিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর দ্বারা। আছে রাজনৈতিক সন্ত্রাস। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলো ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টির নিদর্শন আমাদের দেশে স্থাপন করেছে।
গণতন্ত্রের ব্যর্থতার চিহ্নগুলো সারা পৃথিবীতে দিন দিন সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর লালসার আগুনে একে একে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মুসলিম দেশগুলো। আফগানিস্তানের সাথে আশির দশকে রাশিয়ার যে যুদ্ধটি হয় সেখান থেকে ইসলামিক জঙ্গিবাদের সূচনা ঘটে। তারপর থেকে মুসলিম জাতির উপর একের পর এক যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে থাকে পশ্চিমা বিশ্ব। এই জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে কোনো না কোনো আদর্শিক মতবাদ তো লাগবেই। নির্যাতিত হয়ে, আত্মীয় পরিজন, বাবা-মা, ভাই-বোন হারিয়ে, আবাসভূমি থেকে উৎখাত হয়ে মুসলিমরা এই বিরাট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর জন্য ইসলামকে তাদের প্রেরণা হিসাবে গ্রহণ করেছে। ইসলামের উত্থানের একটি সম্ভাবনা লক্ষ্য করে সারা দুনিয়াতেই এই জঙ্গিবাদ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। সমস্যা হচ্ছে তারা ইসলাম হিসাবে যেটাকে ধারণ করেছে সেটা প্রকৃত ইসলাম নয়, কিন্তু সেটাকেই ইসলামের ভাবমূর্তি দিয়ে হাজার হাজার দলিল প্রমাণ দিয়ে গ্রহণযোগ্যরূপে মুসলিম জাতির সামনে তুলে ধরা হচ্ছে।
এভাবে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে ইসলামিক গণতন্ত্র, ইসলামিক সমাজতন্ত্র যেমন আবিষ্কার ও চর্চা করা হয়েছে, তাদের আলেমরাও যেমন তাদের ঐরকম ইসলামের বিষয়ে বহু বহু কেতাব লিখে নিজেদের দলে লোক টানতে সক্ষম হয়েছে, ঠিক একইরকম একটি মতবাদ হচ্ছে জঙ্গিবাদ যাকে আমরা ইসলামিক ফ্যাসিজম বললে অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু তাদের এই মতবাদ বাকি মুসলিম বিশ্বে এবং বাংলাদেশেও ইসলাম বলেই গৃহিত হচ্ছে এবং তাদের যুদ্ধকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ বলে মনে করা হচ্ছে। এই যে ‘জেহাদী জোশ’- এর জোয়ার সৃষ্টি হচ্ছে সেটা একটি ইসলামের ভুল দর্শনের ভিত্তিতে সৃষ্টি হচ্ছে। এটা খুবই মারাত্মক। বিরাট অরাজকতা, অসন্তোষে পুরো জাতি ও দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু মানুষ ইসলাম পাবে না, শান্তি পাবে না। দেশ চলে যাবে পশ্চিমাদের দখলে, যেভাবে ইরাক আফগানে হয়েছে। পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো আসলে এটা চায়। তারা জানে যে, তাদের ক্ষমতা ও শক্তি কতটুকু এবং জঙ্গিদের কতটুকু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান-রাশিয়া যুদ্ধের সময় রাশিয়াকে পরাস্ত করার জন্য আফগানিস্তানে আল কায়েদা নামক এই আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছিল। সারা দুনিয়া থেকে মুসলিম তরুণরা দলে দলে যোগ দিয়েছিল। আরব রাষ্ট্রগুলো পশ্চিমাদের তাঁবেদার। তারা ইসলামের একটি আইকন, কর্ণধার। তারা আফগানিস্তানে গিয়ে কম্যুনিস্ট রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একে জেহাদ বলে আখ্যায়িত করে। এখানে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করে আমেরিকা। তারা মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ দেয়, অস্ত্র দেয়। এখান থেকেই ইসলামের নামে জবরদস্তিমূলক একটি শরিয়তি ব্যবস্থার ধারণা প্রতিষ্ঠা করে তালেবান। বর্তমানের আইএস-ও সাম্রাজ্যবাদীদের ল্যাবরেটরির প্রোডাক্ট যা সমগ্র মুসলিম দুনিয়াতেই বিস্তার লাভ করছে। বাংলাদেশ ভারতের পেটের মধ্যে অবস্থিত। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম। তাই মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিরা ভারত আক্রমণের যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে তারা বাংলাদেশকে তাদের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে চায়। এসব কিছুতে লাভবান হবে বিশ্বের অস্ত্রবিক্রেতা পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তথা আমেরিকা রাশিয়া ইত্যাদি। তাই তারা সবাই চায় বিশ্বজুড়ে মুসলিম দেশগুলোয় যুদ্ধ লাগুক।
এখন আমাদের কথা হচ্ছে, আমরা আমাদের দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি চাই কিনা? আমরা ষোলো কোটির একটি জাতি। এখানে অধিকাংশ মানুষই বলবেন যে, না যুদ্ধ চাই না। এই ষোল কোটি মানুষের মধ্যে পনেরো কোটি যদি যুদ্ধের বিরুদ্ধে থাকেন আর মাত্র এক কোটি যুদ্ধের পক্ষে থাকেন তবু যুদ্ধ হবে। কারণ পনেরো কোটি মানুষ ঐক্যহীন, লক্ষ্যহীন, নেতৃত্বহীন, আত্মকেন্দ্রিক অপরদিকে এক কোটি মানুষ যারা যুদ্ধ চায় তাদের জীবনের একটি লক্ষ্য আছে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে তারা পরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ ফেলছে। একটি প্রাকৃতিক নিয়ম হচ্ছে ঐক্যহীনের উপর ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠী বিজয়ী হয় যদি তারা সংখ্যায় কম হয় তবু। কিছুদিন আগে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কিছু সরকার নিয়োজিত আলেম জঙ্গিবাদকে হারাম ফতোয়া দিয়ে এক লক্ষ আলেমের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে এই সাক্ষর অভিযানে কওমী মাদ্রাসার আলেমরা অধিকাংশই স্বাক্ষর করেন নি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান, জামায়াতে ইসলামির আলেমগণও স্বাক্ষর করেন নি। বর্তমানে দেশে ২৫,০০০ কওমী মাদ্রাসা রয়েছে যারা এদেশের ইসলামের সেন্টিমেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করেন অনেকাংশে। তাদের লক্ষ লক্ষ আলেম যখন জঙ্গিবাদকে হারাম বলে স্বীকার করেন নি, তার মানে তারা প্রকারান্তরে জঙ্গিবাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন কিনা সেও প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। তাদের ছাত্র শিক্ষক সব মিলিয়ে কোটির উপরে সংঘবদ্ধ জনশক্তি রয়েছে। তারাও বাংলাদেশের নাগরিক। আমি বলি না যে তারা বাংলাদেশের শত্রু। কিন্তু তাদের ধারণকরা ইসলামী চেতনা তাদেরকে এমন একটি ভ্রান্ত পথে নিয়ে গেছে যা থেকে দেশের কল্যাণ না হয়ে উপর্যুপরি অকল্যাণই সাধিত হচ্ছে। তারা উন্মাদনা, সহিংসতা সৃষ্টি করছেন এতে জনগণের কতটুকু কল্যাণ হচ্ছে, দেশের কতটুকু উপকার হচ্ছে সেটা তাদের চিন্তার ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্তই নয়। তারা চান নিজেদের সংখ্যাধিক্য, শক্তি আর ঈমানী চেতনার প্রদর্শনী। তারা বোঝাতে চান যে, তারাই ইসলামের কর্তৃপক্ষ। জনগণও তাদের জোশ আর চিৎকার দেখে ক্ষেপে ওঠে। তখন জনগণকে নাম দেওয়া হয় তওহীদী জনতা (Religious Mob)। তারা যাই করে, যেদিকে যায়, যা খুশি ধ্বংস করে তার কোনো বিচার নেই। উম্মতে মোহাম্মদীর একটি কাজও এমন হুজুগ বা গুজব নির্ভর ছিল না। আমাদের দেশে এই উন্মত্ততা তৈরি করতে মাইকে একটি গুজব রটনা করাই যথেষ্ট – এক মুহূর্তে মানুষ ভয়াবহ জঙ্গিতে পরিণত হয়, খুন খারাপি লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে দেয়।
এমন একটি সামাজিক পরিস্থিতিতে আমাদের দেশটিকে যদি ধর্মীয় উগ্রপন্থার উত্থান থেকে রক্ষা না করা যায় দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে, এটা অমোঘ পরিণতি। হাজারটা নিয়ামক সন্নিবিষ্ট হয়েছে এ দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য, সরকার বিরোধী শক্তিগুলোর প্রতি দমননীতি একে দিনকে দিন তরান্বিত করছে। এমতাবস্থায় একটি মাত্র পথ আছে জাতিটিকে প্রাণে রক্ষা করার, আর তা হলো গোটা জাতিকে দুয়ারে কড়ানাড়া বিপদটির সম্পর্কে সচেতন করে তোলা এবং তওহীদী জনতার নামে বা জঙ্গিবাদের নামে যে অনৈসলামিক পন্থা আমাদের দেশে অনুসরণ করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করা। সহিংসতা সৃষ্টির জন্য ধর্মীয় কেতাব, লেবাস ইত্যাদির আশ্রয় নেওয়া হলে জনগণ সহজে তাতে প্রভাবিত হয়। কিন্তু তাদের বক্তব্য যে আসলে ইসলাম পরিপন্থী জনগণ সেটা ধর্ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায় বুঝতে পারে না। এখন জনগণের সামনে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাটিকে তুলে ধরা প্রয়োজন যেন কেউ একদিকে ডাকলেই তারা পঙ্গপালের মতো ছুটে না যায়। যেন তাদের কাছে সত্য-মিথ্যা যাচাই করার কষ্টিপাথর থাকে। সেই কষ্টি পাথর হচ্ছে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা। আজকে তাদেরকে ধর্মের কথা বলে চোরাগলিতে ডেকে নিয়ে যাওয়ার লোকের কোনো অভাব নেই। কেউ ডাকছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দিকে, কেউ ডাকছে মিছিল করতে, কেউ ডাকছে গাড়িতে পেট্রল বোমা মারার দিকে। সত্য ধর্মের কষ্টিপাথর যার হাতে সে বুঝবে এর কোনোটাই ধর্ম নয়, এ কোনোটাই আল্লাহর সন্তুষ্টি এনে দেবে না। তারা বুঝবে যে মোমেন হতে হলে তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হবে, জালেমের ত্রাস হতে হবে। তাহলে জনগণই ঐ সব ধর্মসন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ধর্মযোদ্ধায় পরিণত হবে। বাংলাদেশের মানুষ যদি সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে জঙ্গিবাদ, উন্মাদনা, অপরাজনীতির বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে বিদেশী শক্তিগুলো, তাদের গোয়েন্দাবাহিনীগুলো আর তাদের অভিসন্ধি চরিতার্থ করতে পারবে না। দেশপ্রেম আর ঈমানের চেতনায় ষোলো কোটি মানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্তি এক বিপুল শক্তি।