হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
আমি বাঙালি। শত শত বছর থেকে বাঙলার সহজাত সংস্কৃতি আমার রক্তে মিশে আছে। বাঙলার একতারা, দোতরা হাতে বটতলায় বাউলের মরমি গান, কলসি কাঁখে চিরন্তন বাঙালি নারী, মাথায় ঝাঁপি নিয়ে বিল থেকে মাছ ধরে ফিরছে জেলে, লুঙ্গি পরা, মাথায় গামছা বাঁধা কৃষক গরু নিয়ে মাঠে যায়, বাঙালি বধূর বারহাতি শাড়ি, পান্তাভাত, ইলিশমাছ, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বাংলা ভাষা, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাঁশির সুর, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, লালনকে হৃদয়ে ধারণ করে আমরা বাঙালি। আমাদের চেতনার গভীরে আছে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বশেষে সাম্য, মৈত্রী, সৌহার্দ্য, সালাম, প্রণাম। সেই জন্যই আমাদের ছিল গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ। আমি ইচ্ছে করেও শত চেষ্টা করেও, শত চাইনিজ আর ফাস্টফুড, পিজ্জা, থাই স্যুপ খেয়েও, আরবী খোরমা খেজুর খেয়েও ইউরোপীয়, চাইনিজ বা আরবীয় হতে পারব না।
আমি বাংলাদেশি। আমার ইতিহাসের এক বিরাট ও বিস্ময়কর ঘটনা ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের আলোচনা ছাড়া একটা দিনও আমার কাটে না। এ চেতনা আমার সর্বাবস্থায় জাগ্রত। যে চেতনা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, স্বৈরশাসন, জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজ সৃষ্টির জন্য, যেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না, ধর্মের নামে অধর্ম চলবে না, হানাহানি, রাহাজানি থাকবে না, শাসনের নামে জুলুম চলবে না, কয়েকটি পরিবারের কাছে জাতীয় নেতৃত্ব ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত হবে না। এক কথায় তারা চেয়েছিলেন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র মিলে একটি একক শান্তি পূর্ণ সমাজ। পাকিস্তান ছিল এমন একটি রাষ্ট্র যা একটি ধর্মব্যবসায়ী রাষ্ট্র। মুক্তিযোদ্ধারা চেয়েছেন এমন একটি দেশ যেখানে কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হবে না, সব ধর্মের মানুষ তাদের যার যার ধর্ম পালনের সমান অধিকার লাভ করবে। একাত্তরের চেতনা ধর্মহীনতা ছিল না, বরং ছিল ধর্মের নামে চলা অধর্মের বিরুদ্ধে।
আমি মুসলিম। আমার যেমন দেহ আছে তেমনি আছে আত্মা। আমি যেমন সৃষ্ট তেমনি আমার একজন স্রষ্টাও আছেন। আমার ইহকাল যেমন বাস্তব তেমনি পরকালও বাস্তব। কাজেই দুইকাল নিয়েই আমার জীবন। উভয় জীবনের মুক্তির জন্য যুগে যুগে স্রষ্টা তাঁর প্রেরিতদের মাধ্যমে পথ নির্দেশনা পাঠিয়েছেন যার সর্বশেষ সংস্করণ হলো ইসলাম। সেই ইসলামের সাম্যের বাণী নিয়ে অর্ধ দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রথম যুগের মুসলিমরা। ইসলামে প্রবেশের শর্ত হচ্ছে এ কথা বিশ্বাস করা যে “লা ইলাহ হা ইল্লাল্লাহ” – আল্লাহর কথা ছাড়া আর কারো কথা না মানা। অর্থাৎ যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরেুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অঙ্গিকার হচ্ছে ইসলামের মর্মকথা। মানবতার কল্যাণ সাধনই আমার এবাদত। ধর্মের এই প্রকৃত চেতনাকে আমি সর্বাবস্থায় শয়নে, স্বপনে, জাগরণে ধারণ করি।
আমি সনাতন। সনাতন অর্থ হলো চিরন্তন, শ্বাশ্বত, যেটা ছিল-আছে-থাকবে। সনাতনের চিরন্তন বাণী হলো সেই মহাসত্যকে ধারণ করা যেটা ধারণ করলে একজন ব্যক্তি মায়া মমতা, ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, মানবতা, সহযোগীতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ হয়। ধর্ম শব্দটির আক্ষরিক অর্থ যে গুণ বা বৈশিষ্ট্য ধারণ করা হয়, সেটা হচ্ছে এমন গুণ যা ধারণ করলে অপরের দুঃখ কষ্ট দেখে একজনের হৃদয় আকুল হয়। পবিত্র কোর’আনে ইসলামকে বলা হয়েছে দীনুল কাইয়্যেমাহ যার অর্থই সনাতন, শাশ্বত, চিরন্তন।
আমরা এ দেশে যারাই বসবাস করি, তারা এ মাটিরই সন্তান, আমাদের কোনো প্রকার বিশ্বাস বা চেতনাই যেন জাতীয় ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে না দাঁড়ায়। আমাদের সব চেতনাধারীদের এখন এক বিন্দুতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, একক ও অবিভাজ্য মহাজাতি হিসাবে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে বৈদেশিক পরাশক্তিগুলো বিভাজিত জাতিতে দাঁত বসানোর মওকা পায়। সেই ঐক্যসূত্র কী হবে? সেটা হচ্ছে সকল প্রকার অন্যায়, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং সকল ন্যায়ের পক্ষে। আমাদের শ্লোগান হবে- এক জাতি এক দেশ – ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ। সেই জাতির মূল ধর্ম, তারা সত্যনিষ্ঠ জাতি।
এই ই¯পাত কঠিন ঐক্য এখন কেন প্রয়োজন? যেভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের ইন্ধনে ও ধর্মব্যাবসায়ীদের ষড়যন্ত্রে একের পর এক মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই তাণ্ডবলীলা থেকে যদি আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে রক্ষা করতে হয় তাহলে সেটা সম্ভব হবে যদি সকল চেতনার লোককে একটি বিন্দুতে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হয়। আমি সংক্ষেপে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, আমাদের মূল চেতনাগুলোর মধ্যে কোনো সংঘাত নেই, তাই মূল চেতনাগুলো বজায় রেখে, সেগুলোকে শানিত করে আমরা সবাই এক বিন্দুতে আসতে পারি। যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারি তাহলে আমি হলফ করে বলতে পারি বহু সংগ্রাম, ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার চেতনা, হাজার বছরের লালিত বাঙালি চেতনা এবং ধর্মীয় চেতনা, ইত্যাদি কোনো চেতনাই জাতিকে শেষ রক্ষা করতে পারবে না। যে মাটিতে আমি সেজদা করি, যে মাটিতে আমি মন্দির গড়ি, যে মাটিতে আমি ফসল ফলাই সেই মাটি আবারো পরাশক্তির পদানত হয়ে যাবে, যেমন হয়েছে সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান। তখন আমার কোনো চেতনাই থাকবে না, আমাদের মাতৃভ‚মি হয়ে যাবো যুদ্ধবিদ্ধস্তু দেশ। আমাদের একটাই পরিচয় হবে- উদ্বাস্তু। হিন্দু মুসলমান বাঙালি বাংলাদেশী সব চেতনাবাদীরা তখন উদ্বাস্তুশিবিরে বাস করবো। ঐক্যবদ্ধ আমাদের হতেই হবে, আর এটা সম্ভব যার প্রমাণ আমি দিলাম। লেখক: এমাম, হেযবুত তওহীদ