কোরবানি একটি আরবি শব্দ যার অর্থ ত্যাগ করা, উৎসর্গ করা। সেই ত্যাগ হতে পারে লোভ ত্যাগ, স্বার্থ ত্যাগ, মোহ ত্যাগ ও সম্পদ ত্যাগ। মানবতার কল্যাণে, জাতির স্বার্থে ত্যাগ স্বীকারের মাঝেই প্রকৃত সুখ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত।
আমরা যদি রসুল (সা.)-এর সাহাবিদের জীবনীর দিকে দৃষ্টিপাত করি তবে দেখতে পাই, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁরা কোরবানি করেছেন তাঁদের জীবনের সমস্ত সুখ, ভোগ-বিলাসিতা, অর্থ-সম্পদ এমনকি স্বদেশ- যে দেশের মাটিতে তাঁরা পিতা-মাতার আদরে-সোহগে ছোট থেকে বড় হয়েছেন।
পিতা উমায়ের এবং মাতা খুনাস বিনতে মালিকের পুত্র মুসয়াব (রা.)। পরম আদরে এবং ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত মক্কার অন্যতম সুদর্শন যুবক ছিলেন তিনি। মা সম্পদশালী হওয়ায় অত্যন্ত ভোগ-বিলাসের মধ্যে তাকে লালন-পালন করেন। তখনকার যুগে মক্কার যতরকমের চমৎকার পোশাক ও উৎকৃষ্ট খুশবু পাওয়া যেত তার সবই তিনি ব্যবহার করতেন। রসুলাল্লাহর (সা.) সামনে কোনভাবে তাঁর প্রসঙ্গ উঠলে তিনি বলতেন, “মক্কায় মুসয়াবের চেয়ে সুদর্শন এবং উৎকৃষ্ট পোশাকধারী আর কেউ ছিল না।” ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি ছিলেন মক্কার সর্বোৎকৃষ্ট সুগন্ধি ব্যবহারকারী। সৌন্দর্য, সুরূচি ও সৎ স্বভাবের সাথে তাঁর অন্তরও ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ। তওহীদের আহ্বান পৌঁছামাত্রই তিনি সত্য-মিথ্যার পার্থক্য অনুধাবন করতে পারলেন। রসুলাল্লাহর (সা.) মুখ থেকে কোর’আনের কিছু আয়াত তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে লাগলেন। তিনি ঐদিনই তওহীদের ঘোষণা দিয়ে বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। মক্কার অলিতে গলিতে যখন তাঁর ইসলামের গ্রহণের খবর প্রচার হয়ে যায়, তখনই তাঁর পরিবার থেকে নেমে আসে অত্যাচার ও নির্যাতন। বাড়ি ছেড়ে পথে বেড়িয়ে পড়েন কোরায়েশদের এক আদুরে ও বিলাসী পুত্র মুসয়াব (রা.)। তাঁর গায়ে এখন শত তালিযুক্ত জীর্ণ শীর্ণ এক টুকরা চামড়া, একদিন খাবার জুটলে অন্যদিন জুটে না। তখনকার পোশাকগুলো ছিল বাগিচার ফুলের মতো কোমল চিত্তাকর্ষক ও সুগন্ধিময়। তাঁর এই দৃশ্য দেখে রসুল (সা.) বললেন, “আমি মক্কায় এই মুসয়াবকেই দেখেছি পিতামাতার সবচেয়ে আদরের পুত্র হিসেবে। তাঁর মতো সচ্ছল পরিবারের বিলাসী যুবক মক্কায় আর একজনও ছিল না। আল্লাহ ও রসুলকে ভালোবেসে সে সমস্তকিছু ত্যাগ করেছে।” ওহুদ যুদ্ধ অমীমাংসিত অবস্থায় শেষ হলে তাঁর প্রাণহীন দেহের কাফনের জন্য একটুকরা চাদর ছাড়া অতিরিক্ত কাপড়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না। রসুল (সা.) এর আদেশে চাদর দিয়ে মাথার অংশ নিতে এবং ঘাষ দিয়ে পায়ের অংশটুকু ঢেকে দেওয়া হয়।
মদিনায় তখন রসুলকে কেন্দ্র করে একটি জাতি গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে, নতুন নতুন মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হচ্ছে। একের পর এক যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে। হতদরিদ্র সেই জাতিটি এ ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে বিরাট অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। একবার রসুল (সা.) নিরুপায় হয়ে সাহাবিদের এক ব্যক্তি সম্পর্কে বললেন, “এমন কেউ কি আছে যে আল্লাহর এই বান্দাকে মেহমান বানাবে?” উম্মে সুলাইমের (রা.) স্বামী আবু তালহা তাকে বাড়ি নিয়ে এলেন এবং জানতে পারলেন বাচ্চাদের জন্য সামান্য খাবার শুধু রয়েছে। আবু তালহা (রা.) বললেন, কোনো অসুবিধা নেই। বাচ্চাদের ভুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। তারা ঘুমিয়ে পড়লে আমরা তাদের খাবার মেহমানের সামনে রেখে দেব। তুমি বাতি ঠিক করার অসিলায় তা নিভিয়ে দেবে। অন্ধকারে মেহমান খেয়ে নেবে আমরাও এমনি এমনি মুখ চালাতে থাকবো। আল্লাহর দীনের জন্য স্বামী স্ত্রীর এ এক স্বতঃস্ফূর্ত কোরবানি। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আম্মা খাদিজা (রা.), আব্দুল্লাহ (রা.) সহ আরো অনেকে হাসিমুখে কোরবান করেছেন তাদের সুখ- স্বাচ্ছন্দময় জীবন।
বর্তমানে আমরা কোরবানি বলতে শুধু বছরে একবার ঈদুল আযহায় পশু জবেহ করাকেই বুঝি। মোটা অংকের টাকায় মোটাতাজা, খুঁতবিহীন পশু জবেহ করে গরীব-দুঃখীদের মাঝে নাম মাত্র বিলিয়ে দিয়ে ফ্রিজ ভরাট করে আমরা মনে করি, আল্লাহ আমাদের উপর সন্তুষ্ট। সারাবছর অসহায় মানুষের দিকে সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে ঈদের সময় একটুকরো কাপড় দান করে আমরা মনে করি, আল্লাহ আমাদের উপর সন্তুষ্ট। ফুটপাত শুয়ে থাকা অসহায় শিশু কিংবা বৃদ্ধদের প্রতি আমরা দৃষ্টি দেওয়ার সময় পাই না অথচ আমরা নামাজ রোজা করেই মনে করি আল্লাহ আমাদের উপর সন্তুষ্ট।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্সের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানানো হয়, বাংলাদেশে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে উচ্চ সম্পদশালী (এইচ এন ডব্লিউ) ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়বে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। “ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৯” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল দেশের তালিকায় ধনী জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পাওয়ার হিসাবে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান লাভ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেট ১০ লাখ থেকে তিন কোটি মার্কিন ডলার সম্পদের মালিক ব্যক্তিরা উচ্চ সম্পদশালী এবং যাদের তিন কোটি মার্কিন ডলারের বেশী নেট সম্পদ রয়েছে তারা অতি-উচ্চ সম্পদশালী।
একদিকে দেশের গুটিকয়েক ব্যক্তিবর্গ সম্পদের পাহাড় গড়ছে, অন্যদিকে অধিকাংশ মানুষ অসহায় জীবন-যাপন করছে। এতে করে দেশের উন্নতি হচ্ছে না, তাদের গড়া সম্পদের পাহাড় দিয়ে মানবতার কল্যাণ হচ্ছে না। তারা মূলত অসহায় মানুষ কিংবা দেশের কল্যাণ সাধনের জন্য এই অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলে নাই। তারা নিজেদের ভোগ-বিলাসিতার জন্য গড়ে তুলেছে সম্পদের পাহাড়। আর ধার্মিকরা আছেন উপাসনা ও লেবাসি ধর্মপালন নিয়ে। আজ যদি তারা পশু জবেহের মতো অসহায় মানুষের জন্য অর্থ-সম্পদ দান করাকেও কোরবানি বলে জানতো, তবে আমাদের দেশে এতো অসহায় মানুষ থাকতো না। রসুলাল্লাহর (সা.) সাহাবিদের মতো আত্মত্যাগের সেই আত্মা, সেই চরিত্র যদি আমরা গঠন করতে পারি তবে আমাদের দেশটিও হবে সুখ-শান্তিতে পরিপূর্ণ। সেটাই ছিল প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা।