হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
বাবা আদম পৃথিবীর বুক থেকে চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর বংশবৃদ্ধি হতে লাগল। পৃথিবীর বুকে তাঁর সন্তান, তাদের সন্তানেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে লাগলেন। আবার ইবলিস তাদেরকে ভ্রান্ত পথে, দালালাহতে নিয়ে গেল। ভাই ভাইয়ের শত্রু হল। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলল। আল্লাহ আবার নবী-রসুল পাঠালেন। তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আবার সেরাতুল মুস্তাকীমে মানুষকে আনলেন, তওহীদে আনলেন। ইবলিস আবার তাদের মন-মগজে ঢুকে তাদেরকে প্ররোচিত করে ভুল পথে নিয়ে গেল। এইভাবে নবী-রসুল আসছেন-যাচ্ছেন, আসছেন-যাচ্ছেন, এভাবে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার কি দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রসুল গুজরান করে গেলেন।
বাবা আদমের কলেমা কি ছিল? ‘লা ইলাহা এল্লাল্লাহ আদম সফিউল্লাহ’; ইব্রাহিম (আ.) এর কলেমা কি ছিল? ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ’; মুসা (আ.) এর কলেমা কী ছিল – ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুসা কালিমুল্লাহ’; ইসমাইল (আ.) এর কলেমা কী ছিল – ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ইসমাঈল জাবিউল্লাহ’; ঈসা (আ.) এর কলেমা কী ছিল – ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ঈসা রুহুল্লাহ’; এভাবেই শেষ নবীর কলেমা হয়েছে – ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা.)’। আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিলেন, মানবজাতি যতদিন আছে পৃথিবীতে তিনি আর নতুন করে নবী-রসুল আর পাঠাবেন না। তাঁর উপাধি দিলেন দিলেন ‘রাহ্মাতাল্লিল আ’লামীন’। তাঁকে আল্লাহ বললেন, “আপনি বলুন, ‘ইয়া আইয়ুহান্নাস, কুল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তুফলিহুন’ অর্থাৎ হে মানবজতি! তোমরা বলো – আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই, তোমরা সফল হবে।” তিনি সে কথাটিই মানবজাতির উদ্দেশে বললেন। আল্লাহ আরো বললেন, “হে রসুল আপনি বলুন, আমি তোমাদের সবার জন্যে আল্লাহর রসুল।” অর্থাৎ পুরো মানবজাতির জন্য তিনি আসলেন। যে কেতাবটা নিয়ে আসলেন, সেই কেতাবের নাম আল্লাহ রাখলেন ‘ফোরক্বান’, ‘কোর’আনুল ক্বারীম’, ‘কোর’আনুল মাজিদ’ ইত্যাদি। ‘ফোরক্বান’ অর্থ ‘ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য নির্ধারণকারী’, ‘সত্য-মিথ্যা আলাদাকারী’। যেই দিনটা নিয়ে আসলেন সেই দিনের নাম আল্লাহ রাখলেন, ‘দীনুল হক্ব’, ‘সত্য দীন’, ‘দীনুল কাইয়্যেমাহ্’, ‘সনাতন দীন’, ‘দীনুল ফিতরা’, ‘প্রাকৃতিক দীন’, ‘উম্মাতে ওয়াসাতা’, ‘ভারসাম্যপূর্ণ উম্মাহ্’। এই যে ভারসাম্যপূর্ণ, প্রাকৃতিক জীবনের উপরে একটা জীবনবিধান দিয়ে আল্লাহর রসুলকে আল্লাহ পাঠালেন সেটা কী দায়িত্ব দিয়ে? সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে সুখ, শান্তি, ন্যায়, সুবিচারের মধ্যে রাখার জন্য। ওই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে আল্লাহর রসুল অক্লান্ত পরিশ্রম করে ‘জাযিরাতুল আরবে’ সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করলেন। দাওয়াত দিলেন সবাইকে তোমরা বল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। ঐটাই ছিল প্রকৃত ইসলাম।
আজকের মুসলমানদেরকে এই কথা বুঝতে হবে, আমার রসুল আমাদেরকে যেই তরিকার মধ্যে রেখে গিয়েছিলেন, যেই রাস্তার মধ্যে তুলে দিয়েছিলেন, যেই আদর্শের মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন, আমরা গত তেরশো বছরে আল্লাহর রসুলের রেখে যাওয়া সেই আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করেছি, সেই রাস্তা থেকে আমরা সরে গিয়েছি, সেই ইসলামকে আমরা ভুলে গিয়েছি। এখন আমাদের করণীয় কি? জনগণের সামনে ইসলামের সেই রূপটাকে এখন তুলে ধরতে হবে। ইসলামের চেহারা এতগুলো নয়, এতগুলো আকিদা নয়। ইসলামের সিদ্ধান্ত সকল ক্ষেত্রে হবে একটা।
আমি আপনাদেরকে প্রশ্ন করতে চাই, এই বস্তুটার কি নাম (মোবাইল ফোন দেখিয়ে)? মোবাইল ফোন। এটা কি জন্য? কথা বলার জন্য। এটা কি নাম (সানগ্লাস দেখিয়ে)? এটা কী জন্য? রৌদ্রময় দিনে চোখে দেওয়ার জন্য। এটা কি পাথর ভাঙার জন্য? এটা কি মানুষের মাথায় মারার জন্য? না। এই বস্তুটির সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করার নাম হচ্ছে আকিদা। সমস্ত আলেমরা একমত যে, আকিদা ভুল হলে ঈমানের কোনো মূল্য নাই। ঈমান না থাকলে আমলের কোনো মূল্য নাই। বুখারি শরীফের সপ্তম হাদিস, ইসলামের বুনিয়াদ পাঁচটা। এক নাম্বারটা কি? ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’। দুই নম্বর সালাহ্। তিন নম্বরে যাকাত। চার নম্বরে হজ। পাঁচ নম্বরে রোজা বা সওম। এই পাঁচটি বিষয়ের প্রথমটি হচ্ছে ঈমান আর পরেরগুলো হলো আমল। যার ঈমান নাই তার আমলের কোনো মূল্য নাই। আমরা মসজিদ বানচ্ছি আমল করার জন্য। টাইলসের মসজিদ, এ.সি.যুক্ত মসজিদ, সোনার গম্বুজওয়ালা মসজিদ, সেখানে এমাম সাহেব বসেন সোনার চেয়ারে। সুরা ক্বেরাত যেন ভুল না হয়, নিখুঁতভাবে উচ্চারণ করে যাচ্ছি। মাদ্রাসায় পড়ছি আমল করার জন্য। হজ্ব করছি আমল করার জন্য। রোজা রাখছি, সেহেরে খাচ্ছি, ইফতার করছি, সব আমল করছি। কিন্তু আগে ঈমান তারপরে আমল। আমি বারবার এ কথাটা বলছি – আপনারা মনে রাখুন। এই আমল কেন করবেন, কী জন্য করবেন, ঈমান কেন আনবেন ইত্যাদি জানার নাম আকিদা। তাহলে তিনটা বিষয়- আকিদা, ঈমান, আমল। আকিদা ভুল হলে ঈমানের কোনো দাম নাই। ঈমান না থাকলে আমলের কোনো মূল্য নাই।
এখানে অনেকের মনে একটা খটকা লাগতে পারে যে, হেযবুত তওহীদের এমাম কী বলছেন? আমরা তো আল্লাহ বিশ্বাস করি। আমরা তো আল্লাহ বিশ্বাস করি বিধায় নামাজ পড়তে যাই, আমাদের ঈমান নাই কীভাবে? আমি আপনাদেরকে একটা উদাহরণ দিলে বুঝবেন। বিশ্বাস করা এক জিনিস আর হুকুম মানা আরেক জিনিস। আপনার বাবা, ধরুন আপনি আপনার বাবাকে বিশ্বাস করেন যে তিনিই আপনার জন্মদাতা পিতা। কারণ অবিশ্বাসের কোন উপায় নাই। একেবারে সন্দেহাতীতভাবে আপনি তাঁকে বাবা বলে বিশ্বাস করেন। তাঁকে সম্মান করেন, ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। অন্য কেউ বাবাকে গালি দিলে আপনি ক্ষিপ্ত হন। কিন্তু বাবা বলে বিশ্বাস করা এক জিনিস আর তাঁর হুকুম মানা, তাঁর কথা শোনা আরেক জিনিস। যেমন তিনি বললেন, ‘তুমি সন্ধ্যার পরে বাজারে ঘুরবে না। অসৎসঙ্গে পড়বে। সন্ধ্যার পরে বাসায় এসে পড়াশুনা করবে।’ আপনি ভাবলেন, “বাবা বুড়ো মানুষ। তিনি কী বুঝবেন? আমি রাত বারোটা পর্যন্ত বাজারে ঘুরবো।” এভাবে তাঁর হুকুম অমান্য করে অসৎ সঙ্গের ফাঁদে পড়ে আপনি খারাপ হয়ে গেলেন। বাবা বললেন, ‘মদ খেও না, এটা তোমাকে, তোমার চরিত্র ধ্বংস করে দিবে, নিজের আত্মার উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।’ আপনি ভাবলেন যে, “এই যুগে মদ খাওয়া কোনো দোষের কাজ নয়। বাবা প্রাচীন মানুষ। তিনি কী বুঝবেন?” এভাবে আপনি পড়াশুনা করলেন না, বাজে লোকদের পাল্লায় পড়লেন, মাদকসেবী হলেন, দুশ্চরিত্র হলেন। এখন আপনি মিথ্যাবাদী, চোর, ডাকাত, খুনী, চোরাকারবারী। আপনাকে এখন পুলিশ খুঁজছে।
এই যে আপনার এই দৈন্যদশা হল, কী কারণে বলুন তো দেখি? বাবার হুকুম না মানার কারণে, নয় কি? আপনি কি বাবাকে বিশ্বাস করতেন না? শ্রদ্ধা করতেন না? এই যে, আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করি, আল্লাহকে শ্রদ্ধা করি, আল্লাহকে সেজদা করি। আল্লাহকে গালি দিলে আমরা সহ্য করতে পারি না সবই সত্য, কিন্তু ইবলিসের প্ররোচনায়, আমরা একে একে একে একে আল্লাহর সমস্ত হুকুমকে প্রত্যাখ্যান করেছি। এর ফলে কী হয়েছে? আমরা কলেমার চুক্তি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে গিয়েছি। কলেমার কথা কি ছিল? ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, – আল্লাহ তোমার হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানবো না। এই কথার মধ্যে যখন আমি চুক্তিতে আবদ্ধ হলাম, তখন আমি নামাজ পড়ার অধিকার পেলাম। যারা কলেমাতেই নেই তার জন্য কি নামাজের প্রয়োজন আছে, নাকি পড়ে লাভ হবে? নামাজ কার জন্য? নিশ্চয়ই মো’মেনের জন্য। আমি এই কথার মধ্যে যখন আসলাম যে, আল্লাহ, এই বাঁ দিকের রাস্তায় আমি থাকব না, ইবলিসের আনুগত্য করব না, শয়তানের আনুগত্য করব না, আমি তোমার হুকুম মানব, তোমার আনুগত্য করব, তবেই তো আপনার জন্য নামাজ পড়া ফরদ। আল্লাহ কোর’আনে বললেন, ‘ইয়া আইয়ুহাল্লাজি না আমানুসতা ইনুবি সবরি ওয়াস সলাহ্, ইন্নাল্লহা মাআস্ সবিরিন।’ ‘হে মো’মেনগণ, তোমরা সালাহ এবং সবরের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা কর।’ কাকে সম্বোধন করলেন? মো’মেনকে। রোজার হুকুম আল্লাহ কাকে দিলেন, ‘হে মো’মেনগণ, তোমাদের জন্য রোজা ফরয করে দেয়া হল।” কার জন্য ফরজ করা হলো? মো’মেনের জন্য। বলা হলো, ‘হে মো’মেনগণ, মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না।’ ‘হে মো’মেনগণ, ব্যভিচার করো না।’ পুরো কোর’আনে আল্লাহ এই সমস্ত আমলের নির্দেশ কাকে দিচ্ছেন? মো’মেনদেরকে। ‘হে মো’মেনগণ, মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ এটা কি আমার কথা না আল্লাহর কথা? আল্লাহর কথা। মুসলমান হবে কে? মো’মেনগণ। তাহলে আগে মো’মেন না আগে মুসলমান? আমে মো’মেন। আগে আমল না আগে মো’মেন? আগে মো’মেন হন, তারপরে আমলের চিন্তা করুন।
আজকে আমরা ১৬০ কোটি। আমার কথা ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন। আজকে আমরা আল্লামা হতে পারি, মুফতি হতে পারি, মুহাদ্দিস হতে পারি, শায়েখ-দরবেশ হতে পারি, বিরাট আমল করনেওয়ালা হতে পারি, একাধিকবার হজ্বকরনেওয়ালা হাজি হতে পারি, আমরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজ্ঞ হতে পারি কিন্তু আল্লাহর ঘোষনা মোতাবেক ঘোষণা দিচ্ছি, আল্লাহর মানদ- মোতাবেক ১৬০ কোটি জনসংখ্যা, আমরা মো’মেন না, মুসলমান না।
ভয়ংকর কথা। এই কথাকে হজম করতে হবে। মো’মেন না? আপনি বলতে পারেন, এত বড় দুঃসাহসী কথা বল তুমি? আমরা মো’মেন না। আমি বলব তাহলে, আমার আল্লাহ কি মিথ্যা কথা বলেছেন (নাউযুবিল্লাহ)? সুরা নূরের ৫৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘যদি তোমরা মো’মেন হও, ঈমান আন, আমলে সালেহ্ কর, পৃথিবীতে আমি তোমাদেরকে কর্তৃত্ব দিব।’ এটা আল্লাহর ওয়াদা নয় কি? তিনিই অন্যত্র বলেছেন, “আল্লাহর ওয়াদা হক্ব, সত্য; তাওরাত, কোর’আন এবং ইনজিলেও তিনি এই ওয়াদা করেছেন” (সুরা তওবা ১১১)। আল্লাহর ওয়াদা আমাদের ওয়াদার মত না। তাহলে আল্লাহর ওয়াদা যদি হক্ব হয় তাহলে আমরা না-হক্ব, মিথ্যাবাদী। আমার প্রশ্ন, বলেন, আমরা হক্ব না আল্লাহ হক্ব। নিশ্চয়ই আল্লাহই হক্ব। তাহলে আমরা কি মো’মেন? আজি জানি এ সত্য কথা স্বীকার করতে কষ্ট হবে। তবু স্বীকার না করে উপায় নেই।
[১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখ সোমবার ঢাকার উত্তর বাড্ডায় অনুষ্ঠিত একটি আলোচনা সভায় হেযবুত তওহীদের এমাম জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণের খ-াংশ। সম্পাদনায় মো. রিয়াদুল হাসান। বক্তব্যের পরবর্তী অংশ দেখুন আগামীকাল।]