সুপ্রিয় পাঠক, সওমের উদ্দেশ্য জানার আগে এটুকু জেনে নেই যে, পবিত্র কোর’আনে উল্লেখিত ‘সওম’ শব্দটি ‘রোজা’ শব্দে পরিণত হলো কীভাবে? এ উপমহাদেশে সওম বা সিয়ামের বদলে রোজা শব্দটা ব্যবহারে আমরা এতটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, সওম বললে অনেকে বুঝিই না সওম কী। কোর’আনে কোথাও রোজা শব্দটা নেই কারণ কোর’আন আরবি ভাষায় আর রোজা পার্শি অর্থাৎ ইরানি ভাষা। কেবল নামাজ রোজাই নয়, আরও অনেক শব্দ আমরা ব্যবহার করি যা কোর’আনে নেই। যেমন খোদা, বেহেশত, দোজখ, ফেরেশতা, জায়নামাজ, মুসলমান, পয়গম্বর, সিপারা ইত্যাদি। এই ব্যবহার মুসলিম দুনিয়ায় শুধু ইরানে এবং আমাদের এই উপমহাদেশে ছাড়া আর কোথাও নেই। এর কারণ আছে।
কারণটা হলো – ইরান দেশটি সমস্তটাই অগ্নি-উপাসক ছিল। প্রচণ্ড শক্তিশালী, অন্যতম বিশ্বশক্তি ইরান ছোট্ট উম্মতে মোহাম্মদীর কাছে সামরিক সংঘর্ষে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে গিয়েছিল। পরাজিত হবার পর প্রায় সমস্ত ইরানি জাতিটি অল্প সময়ের মধ্যে পাইকারিভাবে দীন ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে গিয়েছিল। এই ঢালাওভাবে মুসলিম হয়ে যাবার ফলে তারা ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী তা পূর্ণভাবে বুঝতে সমর্থ হলো না অর্থাৎ তাদের আকিদা সঠিক হলো না। তারা ইসলামে প্রবেশ করলো কিন্তু তাদের অগ্নি-উপাসনার অর্থাৎ আগুন পূজার সময়ের বেশ কিছু বিষয় সঙ্গে নিয়ে ইসলামে প্রবেশ করল।
ইরানীরা আগুন উপাসনাকে নামাজ পড়া বলত, সালাহ্-কে তারা নামাজ বলতে শুরু করল, তাদের অগ্নি-উপাসনার ধর্মে উপবাস ছিল, তারা সওমকে রোজা অর্থাৎ উপবাস বলতে লাগল, মুসলিমকে তারা পার্শি ভাষায় মুসলমান, নবী-রসুলদের পয়গম্বর, জান্নাতকে বেহেশত, জাহান্নামকে দোজখ, মালায়েকদের ফেরেশতা, আল্লাহকে খোদা ইত্যাদিতে ভাষান্তর করে ফেলল। শুধু যে সব ব্যাপার আগুন পূজার ধর্মে ছিল না, সেগুলো স্বভাবতই আরবি শব্দেই রয়ে গেল; যেমন যাকাত, হজ্ব ইত্যাদি। তারপর মুসলিম জাতি যখন ভারতে প্রবেশ করে এখানে রাজত্ব করতে শুরু করল তখন যেহেতু তাদের ভাষা পার্শি ছিল সেহেতু এই উপমহাদেশে ঐ পার্শি শব্দগুলোর প্রচলন হয়ে গেল। এক কথায় বলা যায় যে, আরবের ইসলাম পারস্য দেশের ভেতর দিয়ে ভারতে, এই উপমহাদেশে আসার পথে পার্শি ধর্ম, কৃষ্টি ও ভাষার রং-এ রঙিন হয়ে এলো।
সওমের নিয়ম-নীতি-পদ্ধতি:
সওম কীভাবে রাখা হবে, কী করা যাবে, কী করা যাবে না, সওম ভঙ্গ হলে কী করণীয় তা বুঝতে কোর’আনে প্রদত্ত কয়েকটি আয়াতের সরল অনুবাদই যথেষ্ট, বেশি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয় না।
হে মো’মেনগণ! তোমাদের উপর সওম ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সুরা বাকরা ১৮৩)। সুতরাং সওমের উদ্দেশ্য মো’মেনের মধ্যে আল্লাহর মানদণ্ড, আদেশ নিষেধ মেনে সতর্কতার সঙ্গে পথ চলার চরিত্র সৃষ্টি করা।
গণনার কয়েকটি দিনের জন্য অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে, অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে। (সুরা বাকারা ১৮৪) অসুস্থ ও ভ্রমণে থাকা অবস্থায় সওম রাখার প্রয়োজন নেই। তবে পরবর্তীতে সমপরিমাণ সওম রেখে দিতে হবে। অপারগ হলে মিসকিনকে খাওয়াবে।
রোজার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ অবগত রয়েছেন যে, তোমরা আত্মপ্রতারণা করছিলে, সুতরাং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। অতঃপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর এবং যা কিছু তোমাদের জন্য আল্লাহ দান করেছেন, তা আহরণ কর। আর পানাহার কর যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোজা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। আর যতক্ষণ তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ নিজের আয়াত সমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে। (সুরা বাকারা ১৮৭) অর্থাৎ সওম রেখে দিনের বেলায় জৈবিক চাহিদা পূরণ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নবী করীম (সা.) বলেছেন, কেউ যদি রোজা রেখেও মিথ্যা কথা বলা ও খারাপ কাজ পরিত্যাগ না করে তবে তার শুধু পানাহার ত্যাগ করা (অর্থাৎ উপবাস ও তৃষ্ণার্ত থাকা) আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী) এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তা তার জন্য গুনাহ মাফের এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে। এছাড়া তার সওয়াব হবে রোজাদার ব্যক্তির সমান। অথচ রোজাদার ব্যক্তির সওয়াব কমবে না। এসব শুনে সাহাবীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি তো এমন সামর্থ রাখে না যে রোজাদারকে তৃপ্তি সহকারে ইফতার করাবে? রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহ পাক এই সওয়াব দান করবেন যে রোজাদারকে ইফতার করায় এক চুমুক দুধ দিয়ে, অথবা একটি খেজুর দিয়ে, অথবা এক চুমুক পানি দিয়ে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ায় আল্লাহ তায়ালা তাকে হাউজে কাউছার থেকে পানি পান করাবেন যার পর সে পুনরায় তৃষ্ণার্ত হবে না জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত। (বায়হাকি)
সওমের আকিদা বা উদ্দেশ্য:
তাকওয়া অর্জন:
ইসলামের যেমন একটা উদ্দেশ্য আছে, তেমনি ইসলামের সকল হুকুম আহকামেরও প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য আছে। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ধরুন একটি গাড়ি। গাড়িটির উদ্দেশ্য কী সবাই জানে- এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করা। এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য গাড়িতে বিভিন্ন যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ সন্নিবেশিত করা হয়েছে। যেমন ইঞ্জিন দেওয়া হয়েছে শক্তি উৎপাদনের জন্য। ইঞ্জিন চালনার জন্য তেল সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শুধু ইঞ্জিন দিয়ে লক্ষ্য হাসিল হবে না, লাগবে চাকা। চাকা চলার জন্য চেসিস লাগবে। ডানে-বামে ঘোরানোর জন্য লাগবে স্টিয়ারিং হুইল। দেখার জন্য লুকিং গ্লাস। রাতের বেলায় চলার জন্য লাইট। বসার জন্য সিট। এইভাবে বলতে গেলে শত শত যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ একত্র করেই একটি গাড়ি হয়। প্রত্যেকটি যন্ত্রাংশের আবার উদ্দেশ্য আলাদা।
ঠিক একইভাবে আল্লাহ যে সত্যদীন বা দীনুল হক দান করলেন, কেতাব নাযিল করলেন, নবী-রসুলদেরকে পাঠালেন ইত্যাদি সমস্ত কিছুরই পৃথক পৃথক উদ্দেশ্য আছে। আসমান-জমিন, গ্রহ-নক্ষত্র কোনো কিছুই যেমন উদ্দেশ্যহীনভাবে মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেননি তেমনি মানুষকেও একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছেন। যে কোনো বিষয়ের উদ্দেশ্য জানাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো আমল করার আগে কাজটি কেন করবো এই উদ্দেশ্য জানা প্রত্যেকের জন্য অত্যাবশ্যক। সঠিকভাবে উদ্দেশ্যটা জেনে নেওয়াই হলো আকিদা সঠিক হওয়া। সমস্ত আলেমরা একমত যে আকিদা সহীহ না হলে ঈমানের কোন মূল্য নেই। এই আকিদা হলো কোনো একটা বিষয় সম্বন্ধে সঠিক ও সম্যক ধারণা (Comprehensive Concept, Correct Idea)। ইসলামের একটা বুনিয়াদী বা ফরজ বিষয় হলো সওম বা রোজা। পূর্বের অন্যান্য ধর্মগুলোর মধ্যেও উপবাস ব্রত (Fasting) পালনের বিধান ছিল যা বর্তমানে সঠিকরূপে নেই। ইসলামের বেলাতেও একই ঘটনা ঘটেছে। কাজেই মো’মেনদেরকে অবশ্যই সওমের সঠিক আকিদা জানতে হবে। প্রথমত জানতে হবে সওম বা রোজা কার জন্য।
সওম কার জন্য?
সওমের নির্দেশ এসেছে একটি মাত্র আয়াতে, সেটা হলো- “হে মো’মেনগণ! তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের মতো তোমাদের উপরও সওম ফরদ করা হয়েছে, যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হতে পার (সুরা বাকারা-১৮৩)।” পাঠকগণ খেয়াল করুন, সওমের নির্দেশনাটা কিন্তু মো’মেনদের জন্য, আয়াতটি শুরু হয়েছে ‘হে মো’মেনগণ’ সম্বোধন দিয়ে। আল্লাহ কিন্তু বলেননি যে হে মানবজাতি, হে বুদ্ধিমানগণ, হে মুসুল্লিগণ ইত্যাদি। তার মানে মো’মেনরা সওম পালন করবে। তাহলে মো’মেন কারা? আল্লাহ সুরা হুজরাতের ১৫তম আয়াতে বলেছেন, তারাই মো’মেন যারা আল্লাহ ও রাসুলের উপর ঈমান আনে, কোনো সন্দেহ পোষণ করে না এবং সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ মো’মেন। এই সংজ্ঞা যে পূর্ণ করবে সে মো’মেন। আমরা সংজ্ঞায় ২টি বিষয় পেলাম। এক, আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমান অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে মেনে নেওয়া। যে বিষয়ে আল্লাহ ও রসুলের কোনো হুকুম-বিধান, আদেশ-নিষেধ আছে সেখানে আর কারো হুকুম মানা যাবে না। এই কথার উপর সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত ও দণ্ডায়মান। তারপর আল্লাহর এই হুকুম-বিধানকে এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্যে যিনি আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাবেন, তিনি হবেন মো’মেন। তার জীবন-সম্পদ মানবতার কল্যাণে তিনি উৎসর্গ করবেন। এই মো’মেনের জন্যই হলো সওম, সালাহ, হজ্ব সবকিছু।
ইসলামের বুনিয়াদ পাঁচটি যার প্রথমেই হচ্ছে কলেমা তওহীদ একত্ববাদের ঘোষণা- এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো হুকুম-বিধান না মানা। তারপরে সালাহ, যাকাত, হজ্ব ও সর্বশেষ হচ্ছে সওম (আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বোখারী)। এখানে প্রথমটি হচ্ছে ঈমান আর বাকি সব আমল। যে ঈমান আনবে তার জন্য আমল। মানুষ জান্নাতে যাবে ঈমান দিয়ে, আমল দিয়ে তার জান্নাতের স্তর নির্ধারিত হবে অর্থাৎ কে কোন স্তরে থাকবে সেটা নির্ভর করবে তার আমলের উপর। এই জন্যই রসুল (সা.) বলেছেন, “যে বললো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ সেই জান্নাত যাবে (আবু যর গিফারি রা. থেকে বোখারী মুসলিম)। তাহলে এখানে পরিষ্কার দুইটা বিষয় – ঈমান ও আমল। সওম হলো আমল। আর মো’মেনের জন্য এই আমল দরকার; কেন এই আমল তা বলছি একটু পরে। এখানে বিষয়টি পরিষ্কার যে সওম বা রোজা রাখবে মো’মেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সওম রাখতে হবে, সওমের উদ্দেশ্য কী?
মো’মেনের লক্ষ্য অর্জনে সওমের ভূমিকা
সওম (রোজা) শব্দের অর্থ বিরত থাকা অর্থাৎ আত্মসংযম (Self Control)। রমজান মাসে মো’মেন সারাদিন সওম রাখবে অর্থাৎ পানাহার ও জৈবিক চাহিদাপূরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখবে, আত্মাকে করবে শক্তিশালী। সে অপচয় করবে না, মিথ্যা বলবে না, পশুর মতো উদরপূর্তি করবে না। সে হবে নিয়ন্ত্রিত, ত্যাগী, নিজের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গকারী এবং আল্লাহর হুকুম মানার ক্ষেত্রে সজাগ। নফসের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সে তার মনকে, আত্মাকে শক্তিশালী করবে। প্রশ্ন হতে পারে, মো’মেনের কেন মনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা দরকার? এর উত্তর আল্লাহ দিয়েছেন- যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো (সুরা বাকারা ১৮৩)।
তাকওয়া হলো সাবধানে, সতর্কতার সাথে, দেখে শুনে জীবনের পথ চলা। আল্লাহর হুকুম যেটা সেটা মানা, আর যেটা নিষেধ সেটা পরিহার করা। এটা করতে হলে প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক। যিনি তাকওয়া অবলম্বন করেন তিনি হলেন মুত্তাকি। আল্লাহর দৃষ্টিতে মো’মেনের মর্যাদার মাপকাঠি হচ্ছে এই তাকওয়া (সুরা হুজরাত ১৩)। যিনি প্রতিটি কাজে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ, ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদি বিচার বিবেচনা করেন এবং সত্য, ন্যায়, হক ও বৈধপথ অবলম্বন করেন তিনি হলেন মুত্তাকি। যিনি যত বেশি ন্যায়সঙ্গত ও বৈধপন্থা অবলম্বন করবেন তিনি তত বড় মুত্তাকি। সুতরাং সওমের উদ্দেশ্য হলো মো’মেনকে মুত্তাকি করবে। তাকওয়া অর্জনে তাকে সহায়তা করবে। জীবনের চলার পথকে সুন্দর ও মার্জিত করবে। আর তার চূড়ান্ত ফলাফল হবে এই যে, মো’মেনের লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়ে যাবে। সেই লক্ষ্য কি আমরা জানি?
নবী করিম (সা.) এর জীবনের লক্ষ্য ছিল- আল্লাহর দেয়া জীবনবিধান মোতাবেক মানবজাতিকে পরিচালিত করে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য এ দীনের নাম হলো ইসলাম, শান্তি। আল্লাহ বলেছেন, তিনি সঠিক পথনির্দেশ (হেদায়াহ) ও সত্যদীনসহ স্বীয় রসুল প্রেরণ করেছেন যেন রসুল (সা.) একে সকল দীনের উপর বিজয়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন (সুরা তওবা ৩৩, সুরা ফাতাহ ২৮, সুরা সফ ৯)। সেই সত্যদীনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্ব উপায়ে প্রচেষ্টা চালানো তাই প্রত্যেক মো’মেনের জন্যও অবশ্য কর্তব্য, ফরদ। এটাই একজন মো’মেনের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
কিন্তু এই দীন প্রতিষ্ঠা করতে হলে মো’মেনের অবশ্যই কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, গুণ লাগবে। সেই চারিত্রিক, মানসিক, আত্মিক গুণ, বৈশিষ্ট্য (অঃঃৎরনঁঃবং) এটা যে সে অর্জন করবে কোত্থেকে অর্জন করবে? সেটার জন্য আল্লাহ তাঁর দীনের মধ্যেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছেন। সেটা হলো সালাহ, সওম, হজ্ব, যাকাত এগুলো। এগুলোর মাধ্যমে তার চরিত্রে বহু ধরনের গুণ অর্জিত হবে। তারপর সে গুণাবলী চরিত্রে ধারণ করে আল্লাহর সত্যদীন পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা করে মানবসমাজ থেকে অন্যায় অশান্তি দূর করতে পারবে, যেটা উম্মতে মোহাম্মদীর সৃষ্টির উদ্দেশ্য।
খানিক আগেই গাড়ির উদাহরণ দিলাম। একটি গাড়ির উদ্দেশ্য হচ্ছে তা মানুষকে বহন করে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যাবে। এই গাড়ির প্রতিটি যন্ত্রাংশের (Parts) আবার ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে। চাকার উদ্দেশ্য, পিস্টনের উদ্দেশ্য, সিটের উদ্দেশ্য, স্টিয়ারিং-এর উদ্দেশ্য, ইঞ্জিনের উদ্দেশ্য আলাদা আলাদা হলেও তাদের সবার সম্মিলিত উদ্দেশ্য হচ্ছে গাড়িটির এক স্থান থেকে আরেক স্থানে চলন (Movement)। গাড়িটি যদি অচল হয়, তাহলে এর যন্ত্রাংশগুলো আলাদা আলাদাভাবে যতই ভালো থাকুক লাভ নেই। তেমনি ইসলামের একটি সামগ্রিক উদ্দেশ্য আছে তা হলো – সমাজে, রাষ্ট্রে শান্তি রাখা। মানব সমাজে অর্থাৎ জাতীয় রাষ্ট্রীয় জীবনে যদি শান্তিই না থাকে তখন ইসলামের সব আমলই অর্থহীন। গাড়ির যেমন প্রতিটি যন্ত্রাংশের আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য থাকে তেমনি দীনুল হকের (ইসলাম) অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি বিষয়ের আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু সবগুলো মিলিয়ে মূল লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। যেমন সালাতের উদ্দেশ্য ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, সময়ানুবর্তিতা, পরিচ্ছন্নতা, একাগ্রতা ইত্যাদি মো’মেনের চরিত্রে সৃষ্টি, যাকাতের উদ্দেশ্য সমাজে অর্থের সুষম বণ্টন, হজ্বের উদ্দেশ্য মুসলিম উম্মাহর জাতীয় বাৎসরিক সম্মেলন এবং হাশরের দিন আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করার আধ্যাত্মিক মহড়া। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ বছরে একবার তাদের জাতীয় সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করবে এবং কেন্দ্রীয় নেতার সিদ্ধান্ত মোতাবেক সমাধান করবে। একইভাবে সওমও মো’মেনের চরিত্রে একটি নির্দিষ্ট শিক্ষা দিয়ে থাকে। কী সেই শিক্ষা সেটা নিয়ে এখন আলোচনা করব।
সওম কী চরিত্র দান করে?
মানুষের নফস ভোগবাদী, সে চায় দুনিয়ার সম্পদ ও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করতে। পক্ষান্তরে সওমের শিক্ষা হচ্ছে ত্যাগ করা, সংযত থাকা, নিজের ভোগবাদী প্রবণতার মুখে লাগাম দেওয়া। মানবতার কল্যাণে কাজ করা, সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা হচ্ছে ত্যাগের বিষয়, যা ভোগের ঠিক উল্টো। এটা করতে নিজেদের জান ও মালকে উৎসর্গ করতে হয়। ত্যাগ করার জন্য চারিত্রিক শক্তি, মানসিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হবে।
মো’মেন সারা বছর খাবে পরিমিতভাবে যেভাবে আল্লাহর রসুল দেখিয়ে দিয়ে গেছেন এবং সে অপচয় করবে না, পশুর মতো উদরপূর্তি করবে না। সেখানে একটি নিয়ন্ত্রণ থাকবে। কিন্তু বছরে এক মাস দিনের বেলা নির্দিষ্ট সময়ে সে খাবে না, জৈবিক চাহিদা পূর্ণ করবে না, ফাহেশা কথা বলবে না, অনর্থক কথাবার্তা, গালগল্পে মশগুল থাকবে না, অর্থাৎ লাগওয়া বা লাহওয়াল হাদিস ইত্যাদিতে অনর্থক সময় ব্যয় করবে না। মন্দ কাজ, মন্দ কথা, মন্দ চিন্তা থেকে নিজেকে সংযত রাখবে। অর্থাৎ নিজের ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করবে, ফলে আত্মা শক্তিশালী হবে, আল্লাহর হুকুম মানার ক্ষেত্রে সে সজাগ হবে। এটা করতে গিয়ে আল্লাহর হুকুম মানার জন্য তার যে শারীরিক কষ্ট, মানসিক কষ্ট সহ্য করার মানসিকতা তৈরি হবে এটা তার জাতীয়, সামষ্টিক ও সামাজিক জীবনে প্রতিফলিত হবে। আল্লাহর হুকুম মানার ক্ষেত্রে কষ্টদায়ক হলেও সে ভোগবাদী হবে না, পিশাচে পরিণত হবে না, সে নিয়ন্ত্রিত হবে, ত্যাগী হবে। সে আল্লাহর হুকুম অমান্যকারী হবে না, মান্যকারী হবে। তার ত্যাগের প্রভাবটা পড়বে তার সমাজে। ফলে এমন একটি সমাজ গড়ে উঠবে যেখানে সবাই একে অপরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে উৎসাহী, নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়াতে আগ্রহী হবে। তাদের মধ্যে বিরাজ করবে সহযোগিতা, সহমর্মিতা। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে সওমের মূল উদ্দেশ্যটাই হলো আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ। আমরা যদি সালাহকে (নামাজ) সামষ্টিক (Collective) প্রশিক্ষণ মনে করি তাহলে সওম অনেকটা ব্যক্তিগত (Individual) প্রশিক্ষণ।
এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের সমাজে অধিকাংশ মুসলিমই সওম রাখছেন। কিন্তু সওমের যে শিক্ষা তা আমাদের সমাজে কতটুকু প্রতিফলিত হলো। আমরা যদি পৃথিবীতে শুধু মুসলমানদেরকে হিসাবের মধ্যে ধরি যারা আল্লাহ রাসুলকে বিশ্বাস করেন, কেতাব বিশ্বাস করেন, হাশর বিশ্বাস করেন এমন মুসলমান ১৬০ কোটির কম হবে না। আমরা দেখি রোজা যখন আসে মুসলিম বিশ্বে খুব হুলুস্থ’ল পড়ে যায়। ব্যাপক প্রস্তুতি চলতে থাকে ঘরে ঘরে। রেডিও টেলিভিশনে অনুষ্ঠান প্রচারিত হতে থাকে। ইসলামী চিন্তাবিদরা বড় বড় আর্টিকেল লিখতে থাকেন। বিভিন্ন ধরনের কলাম লেখা শুরু হয়। সওমের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য, ইফতারের গুরুত্ব, সেহরির গুরুত্ব। আবার কেউ কেউ সওয়াবের জন্য রাত জেগে সেহরির জন্য মানুষকে জাগিয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের সওমটা যে উদ্দেশ্যে করা সেই উদ্দেশ্য অর্থাৎ তাকওয়া অর্জিত হচ্ছে কিনা, সেটা আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার শর্তাবলী পুরন হচ্ছে কি হচ্ছে না এই ব্যাপারে আমাদেরকে অবশ্যই ভাবতে হবে।