“সকল অঙ্গনে ন্যায় প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দেয় যে আদর্শ”
প্রতিবছর ১ মে বিশ্ব শ্রমিক দিবস পালিত হয়। দিবসটির উৎপত্তি কীভাবে সেটা কমবেশি সকলেই জানেন। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা শ্রমের উপযুক্ত মূল্য এবং দৈনিক অনধিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে অনেক শ্রমিক হতাহত হন। তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টা করার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর থেকে দিনটি ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
মনে রাখতে হবে কেন সেই ঘটনাটি ঘটল। ইউরোপে রেনেসাঁর পর কিছু যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি আবিষ্কারের পর সেখানে শিল্প বিপ্লব ঘটল। সেখানে তারা ব্যাপকভাবে কলকারখানা স্থাপন করল। ইউরোপে অর্থনীতিতে রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসল। কিন্তু একদিকে বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা হলে কী হবে, ইউরোপের জীবন ব্যবস্থায় এমন একটা জীবনদর্শন গ্রহণ করে নিয়েছে যেখানে অর্থনৈতিক জুলুম অবিচার হতে বাধ্য। কারণ তাদের অর্থনীতি হচ্ছে সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি আর রাজনীতি হচ্ছে পুঁজিবাদি গণতান্ত্রিক রাজনীতি। এটি ক্রমশ তাদেরকে একটি জুলুমতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে নিয়ে গেল। ফলে তিনশত বছরের মাথায় পুরা ইউরোপের শ্রমজীবী মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেল। একটি সমাজ থেকে যখন ন্যায়বিচার বিদায় নেয় তখন সমাজপতিরা যতই শক্তিধর হোন না কেন, মানুষের ভিতরে জ্বলে ক্ষোভের আগুন তাদের সিংহাসনকে ভস্মিভূত করতে অগ্রসর হয়। তাই রাষ্ট্রীয় জুলুমের বিরুদ্ধে দানা বেঁধে ওঠে কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন,ছাত্র আন্দোলন – এমন আরো বহু আন্দোলন যাকে শ্রেণি সংগ্রাম বলে আখ্যায়িত করা হয়।
শক্তির জোরে বুলেট বেয়নেট দিয়ে সেইসব আন্দোলন দমন করা হয়েছে। শিকাগোতে সেদিন এমনই এক আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক শ্রমিকের জীবন গেল। শ্রেণিবৈষম্য ঘোচাতে কার্ল মার্কস, হেগেলস, এঙ্গেলসরা প্রস্তাব করলেন সমাজতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা বা সাম্যবাদ। সাম্যবাদ বা কম্যুনিজমকে যারা মুক্তির পথ হিসাবে গ্রহণ করেছিল তারা কৃষক শ্রমিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটালেন। তাদের শ্লোগান ছিল Proletarians of all countries, unite! দুনিয়ার মজদুর এক হও। কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না।
এই নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষদেরকে ঐ নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচানোর প্রত্যয় নিয়ে সমাজতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলো। নিজেদের চেতনাকে শান দেওয়ার জন্য এই মে দিবসকে তারা একটি বিশেষ দিন হিসাবে পালন করতে শুরু করল। সেটা এখন অনেক প্রগতিবাদী গণতান্ত্রিক দেশ ফ্যাশন হিসেবে পালন করে। সবচেয়ে পরিহাসের ব্যাপার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রেও এখন এটা পালিত হয়। তবে দিবসটি বেশি সমাদৃত হয় বাম ঘরানার লোকদের কাছে। তারা দিবসটি পালন করতে গিয়ে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলেন, শাসকদের শোষণনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে পুঁজিবাদের যে বৈরিতা সেটা এই দিবস পালনের অসিলায় বারবার সামনে নিয়ে আসা হয়। গণতান্ত্রিকদের একটি ক্ষত, একটি পাপকে বার বার সামনে তুলে এনে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হয়।
কিন্তু লক্ষণীয় ব্যপার হচ্ছে কোনো ইসলামী দল এই দিবসটিকে পালন করে না। কারণ দিবসটির সঙ্গে তারা ইসলাম ধর্মের কোনো যোগসূত্র দেখতে পান না। তারা মনে করেন যে এটি পশ্চিমা সভ্যতার বিষয়। আমরা হেযবুত তওহীদ আন্দোলন এ দিবসটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন না করলেও একে আমরা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখি এবং প্রতিবছর এই দিনে আমাদের একটি বিশেষ কর্মসূচি থাকে। আমাদেরকে আল্লাহ এমন একটি সুন্দর ও নিখুঁত আদর্শের জ্ঞান দান করেছেন যে আদর্শ কার্যকর করা হলে সত্যিকার অর্থেই শ্রমজীবী বঞ্চিত মানুষের দুঃখ দুর্দশা দূর হবে। আমরা সেই আদর্শটি এই দিনে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পত্রিকা প্রকাশ করে নিজেরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি। সেই ঘটনার উৎপত্তি কেন হলো, এই ধরণের ঘটনার উৎপত্তি কেন হয়, নিরসনের পথ কী – এই দুইটা বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলি। হেল্ডার কামারা (১৯০৯-১৯৯৯) ব্রাজিলের একজন আর্চবিশপ ছিলেন। তিনি নিজেকে কম্যুনিস্ট বলে পরিচয় দিতেন। তিনি একটি মজার কথা বলেছিলেন, “”When I give food to the poor, they call me a saint. When I ask why the poor have no food, they call me a Communist.” অর্থাৎ আমি যখন গরিব মানুষকে খাদ্য দান করি তখন তারা আমাকে সাধু বলে ডাকে। আর যখন আমি এই প্রশ্ন করি যে গরিব মানুষের কাছে খাদ্য নেই কেন, তখন তারা আমাকে কম্যুনিস্ট বলে ডাকে।
আমরা জানি যে কম্যুনিস্টরা কার্যক্ষেত্রে গরিব মানুষের মুখে আহার যোগাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাদের তত্ত্ব খুবই আকর্ষণীয় ছিল কিন্তু বাস্তবতা ছিল তিক্ত অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। পক্ষান্তরে আমরা হেযবুত তওহীদ মনে করি গরিব মানুষকে খাদ্য দান করা কোর’আনে আল্লাহর পুনঃপুনঃ উচ্চারিত হুকুম। তবে গরিব মানুষের কাছে খাদ্য নেই কেন – এ প্রশ্নের সঠিক জবাব ও কার্যক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে ইসলাম। আর আমরাও এখন সেটার চর্চা করে যাচ্ছি। ফলে হেযবুত তওহীদের হাজার হাজার সদস্যরা যারা অধিকাংশই দরিদ্র, কিন্তু কেউ অসহায় নয়। সবাই সবার বিপদে পাশে দাঁড়ায়, সবার সুখ-দুঃখের অংশ নেয়। তারা একে অপরের জমিতে কৃষিকাজ করে, ঘাম ঝরিয়ে ফসল উৎপাদন করে। নিজেদের গরুর খামারে, মাছের খামারে কাজ করে। সেই শ্রমের দ্বারা জাতি উপকৃত হয়। আমাদের এই আদর্শের কথাগুলোই এই দিনটিতে প্রকাশিত পত্রিকায় থাকে। যেহেতু আমরা বিশ্বাস করি যে যেকোন সমস্যার সমাধান করতে হলে সমস্যার গোড়ায়, আদিতে, উৎসে যেতে হয়। সেটার কারণটা আবিষ্কার করতে পারলে সমাধানের রাস্তা বেরিয়ে আসে।
এখন তো বিশ্ব বহুভাবে বিভক্ত। বিশ্বের একটা বিরাট সংখ্যক লোক বস্তুবাদী জীবনব্যবস্থা, ভোগবাদী জীবন ব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত। মানুষের জীবনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকটগুলোর সমাধানে ধর্মগুলি যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ধর্ম নিয়ে ধর্মগুরুদের অনর্থক কার্যকলাপ, বাড়াবাড়ি, দুর্নীতি, ধর্মের শিক্ষাকে জীবনে ধারণ না করে জীবিকায় পরিণত করা, চিন্তার দৈন্য, দুনিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতা, অহঙ্কার, অন্ধত্ব, কূপমণ্ডূকতা, যুক্তিহীন উন্মাদনা সৃষ্টি ইত্যাদি নানা বিষয় দেখে মুক্তচিন্তার দাবিদার, যারা যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চলতে চায় এমন কিছু মানুষ একেবারে ধর্ম থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ধর্ম নিয়ে তাদের আর কোনো আগ্রহ নাই। যদিও কিছু আনুষ্ঠানিকতা করে থাকে সেটা সামাজিকতার খাতিরে, সাংস্কৃতিক কারণে। তবে তাদের মনে, হৃদয়ে, আত্মায় ধর্মের কোনো জায়গা নেই, কোনো শ্রদ্ধা নেই।
এটা দুটো কারণে হয়েছে। একটি হচ্ছে ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি, আর একটা হচ্ছে বর্তমানের এই ধর্মহীন পাশ্চাত্য সভ্যতার একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব। কিন্তু আমরা গোড়াতে একটা কথা বিশ্বাস করতে চাই। তাহলো মানুষ শুধু দেহ নয়, তার একটা আত্মাও আছে। তার আধ্যাত্মিক দিকও আছে। দেহ এবং আত্মা এই দুটির বিষয়ে সমন্বয়ে আমরা মানুষ। তাই মানুষের জীবন পরিচালিত করার জন্য এমন একটা দর্শন, এমন একটা জীবনব্যবস্থা, জীবন পদ্ধতি প্রয়োজন যেটা তার ব্যক্তিগত জীবনকে সুশৃঙ্খল রাখবে, তেমনি অর্থনৈতিক জীবনকেও সমৃদ্ধ করবে। ইউরোপের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দূর করার জন্য, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি করে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যই গণতন্ত্রের আবির্ভাব হয়েছে। সেখানে তাত্ত্বিকভাবে জনগণের অংশগ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যদিও বাস্তবে সেটা কখনওই হয়নি। এখানে বলা হয় রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। সেটা প্রচার করতে গিয়ে এমন কথাও বলা হয়েছে যে সার্বভোমত্বের মালিক জনগণ, সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ দীর্ঘদিন ইউরোপের পোপ, সামন্ত রাজা, জমিদার এবং ধর্মগুরু এই তিন অপশক্তির দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্ব সংঘাতের ফলে মানুষ রাজনৈতিক অধিকার হারিয়েছে। রাজারা কার্যত সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের জায়গায় চলে গেছে। রাজার আদেশ ঈশ্বরের আদেশ থেকে ভয়াবহ। ঈশ্বর কখনো কখনো তার বান্দদেরকে ক্ষমা করেন কিন্তু রাজার কোনো ক্ষমা নাই। ন্যুনতম স্বার্থ, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য যেমন কোনো একটা প্রেমের পরিণতি দেয়ার জন্য পুরো রাজ্যকে শূন্য করে দিয়েছে। এতটাই স্বৈরাচার হয়ে উঠেছিল রাজারা। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা বলার কোনো অধিকার ছিল না। শাসন ক্ষমতায় তাদের কোনো অংশীদারত্ব ছিল না। এই সমস্ত কারণে ইউরোপে ফরাসি বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে গণতন্ত্রের আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাদের দরুন অর্থনৈতিক বৈষম্য আবারও প্রবল হয়ে উঠেছে। কারণ ঐ রাজনৈতিক ব্যবস্থা অর্থনৈতিক সমস্যার সুষ্ঠু কোনো ভারসাম্যের পথনির্দেশনা দিতে পারে নাই। শুরু হয়ে গেছে অর্থনৈতিক অবিচার। সুদের কারণে সুদি মহাজনরা আরো বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। তারা ভারী ভারী কলকারখানার মালিক হয়ে গেছে। সকল পুঁজি তাদের ব্যাঙ্কে গিয়ে জমা হচ্ছে। যারা পুঁজি জমা করছে তারা হয়ে যাচ্ছে পুঁজিপতি। ঐ পুঁজির প্রভাবে শাসন ব্যবস্থা তাদের করায়াত্বে এসে যাচ্ছে। তারা জনগণের প্রতিনিধি না হয়েও শাসনক্ষমতায় বসে পড়ছে। গণতন্ত্রের সুন্দর সুন্দর কথাগুলো বইয়ের পাতার মধ্যেই থেকে গেছে।
এই অর্থনৈতিক অবিচার থেকে বাঁচার জন্য এবার তারা নতুন আরেকটা পন্থা বের করার চেষ্টা করল। অর্থনীতিই হচ্ছে সমাজের আসল সংকট। টাকা যত বেশি ক্ষমতাও তত বেশি। ক্ষমতা কিনে নিয়ে সমাজে প্রভাব সৃষ্টি করছে। মানুষের উপর জুলুম অত্যাচার বাড়ছে। এখন আর মানুষের রাজনৈতিক ও শাসনকার্যে অংশগ্রহণের অধিকার মুখ্য বিষয় হিসাবে রইল না। এখন প্রাণের দাবি হয়ে দাঁড়ালো, অর্থনৈতিক অবিচার বন্ধ করতে হবে। এটাই হচ্ছে সমস্ত সঙ্কটের মূল। আর এই সমস্যাকে সমাধানের জন্য সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব।
ইসলাম ও এই দুটো মতবাদের মধ্যে বিরাট একটা তফাৎ হলো আত্মিক ভাগ। মানুষ কেন অপর মানুষের কাছে দায়বদ্ধ সেটা ইসলাম মানুষকে অবগত করেছে। ইসলাম মানবজাতিকে বলছে যে, তুমি আল্লাহর খলিফা, আল্লাহর প্রতিনিধি। এমন একটা কর্তৃপক্ষ আছে যার কাছে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। এবং তোমার সবকিছুর একটা পরিণতি আছে। সেখানে তোমাকে একদিন দাঁড়াতে হবে। এই যে গুরুত্বপূর্ণ একটা ভাগ, একটা চূড়ান্ত জবাবদিহিতার জায়গা, একটা সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ, তিনি সমস্ত রাজাদের রাজা, তিনি সর্বময় কর্তা, তিনি সর্বত্র বিরাজমান, তিনি তোমার জীবন ও মরনের মালিক। শেষ পর্যন্ত তাঁর দরবারে তোমাকে সমস্ত কিছু নিয়ে দাঁড়াতে হবে। তার কাছে জবাব দিতে হবে। এই যে একটা শক্তিশালী কর্তৃপক্ষের কাছে পরকালে জবাব দিতে হবে, সর্বাবস্থায় তাঁর নজরদারি অনুভব করা, এখানে আত্মিক একটা ব্যাপার আছে। এই বিশ্বাস মানুষকে সকল অন্যায়, অবিচার, শোষণ, জুলুম ইত্যাদি থেকে বিরত রাখে। এই সত্ত্বায় যারা অবিশ্বাসী তাদের কাছে পৃথিবীর জীবনে ন্যায়-অন্যায়ের কোনো বাছবিচার করার প্রয়োজন পড়ে না। মানুষ কেন ন্যায়ের পথে থাকবে তার কোনো ব্যাখ্যা মানবরচিত ঐ ব্যবস্থাগুলো দিতে পারে নাই। ফলে ক্ষমতাবান মানুষ তার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে যে কোনো প্রকারে স্বার্থ হাসিলকেই জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছে।
সমাজতন্ত্র যখন এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের তাত্ত্বিক সমাধান নিয়ে বের হলো একটা পর্যায় দেখা গেল তারাও আসলে পারে নাই। কারণ সমাজতন্ত্র ব্যক্তির স্বতন্ত্র সম্পত্তি ভোগের অধিকারকে, তার ব্যক্তিসত্ত্বার চাহিদা ও প্রবণতাকে অস্বীকার করেছে। সবকিছু রাষ্ট্রায়ত্ব করে ফেলায় ব্যক্তি তার শ্রমস্বীকারের উদ্যম হারিয়েছে। যার যার বাচ্চাকে সে নিজের সুখ-সুবিধা পরিহার করেও লালন পালন করে, নিজে না ঘুমিয়ে তাকে ঘুম পাড়ায়। এটা মানুষের আল্লাহপ্রদত্ত প্রকৃতি। এই প্রকৃতিকে অস্বীকার করে কোনো জীবনব্যবস্থাই মানুষকে সুখী করতে পারবে না।
যদিও গ্রীক ও রোমান দার্শনিকগণ বলেছেন, What is thine is mine, and all mine is thine (Marcus Tullius Cicero) আমার যা কিছু সবই তোমার, তোমার যা কিছু সবই আমার। অর্থাৎ আমার তোমার বলে কিছু নেই, সবই আমাদের। এটা যদি মনে করা যায় তাহলেই রাষ্ট্রে শান্তি আসবে। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে এমন একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল যে সুস্থ যুবক ও যুবতীদের বাছাই করা হবে। তারা সন্তান উৎপাদন করবে। সেই সন্তানদের রাষ্ট্র আলাদাভাবে লালন-পালন ও প্রশিক্ষণ দিয়ে জনশক্তিতে পরিণত করবে। এখানে কোনো পরিবার ব্যবস্থা থাকবে না। এই প্রশিক্ষিত জনশক্তিই রাষ্ট্র চালাবে। কিন্তু এটা ছিল একেবারেই অবাস্তব চিন্তাধারা। ঠিক একইভাবে সমাজতন্ত্রও চাইত যে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু থাকবে না। সবাই রাষ্ট্রের নাগরিক, রাষ্ট্রের জন্য কাজ করবে। কিন্তু কয়েক দশক যেতে না যেতেই মানুষ দেখল যে অর্থনৈতিক মতবাদ সমাজতন্ত্র ব্যর্থ। এখন যেসব দেশেই সমাজতন্ত্র আছে সবই কার্যক্ষেত্রে একনায়কতন্ত্রে ও ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু ইসলাম প্রতিটি মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, একজন শ্রমিকও মানুষ। সে যদি মো’মেন হয় তাহলে সে তোমার ভাই। যদি নাও হয় তবু সে তোমার আদি-পিতা মাতার সন্তান হিসাবে তোমারই ভাই। সুতরাং তোমরা সব মানুষ এক পরিবার। প্রথম চেতনা হচ্ছে এটা যে কেন আমাকে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে? কারণ সে আমার ভাই। দ্বিতীয় হচ্ছে সে আল্লাহর খলিফা আল্লাহর প্রতিনিধি। এই পৃথিবীই শেষ নয়, এটাই চূড়ান্ত জীবন নয়। এটা তোমার পরীক্ষার জায়গা। পরীক্ষাটা ঐ মানুষকে দিয়ে। তুমি মানুষের প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দিচ্ছ কিনা এটাই দেখা হবে। তোমার একটা পরকাল আছে। সেই জীবনেও দুটো দিক আছে, সুখ আর দুখ। শান্তি আর অশান্তি। শান্তি হলো অফুরন্ত শান্তি, আর অশান্তি হলো ভয়াবহ অশান্তি। এই জীবনের কর্মকাণ্ডকে সেই দিন তোমার সামনে উপস্থাপন করা হবে। কিছু লুকাতে পারবে না। তুমি যদি এখানে মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দাও, তাদেরকে ভাইয়ের অধিকার ফিরিয়ে দাও, দুনিয়াতে যদি ভোগ না করো ত্যাগ করো, অন্যের জন্য ভূমিকা রাখো, অন্যের জন্য কাজ করো তাহলে ঐ দুনিয়ায় অনন্ত জীবনের অধিকারী হবে। এই কাজগুলো করলে তুমি আল্লাহর খেলাফত করলে। ইসলাম আমাদেরকে এই শিক্ষাই দিচ্ছে। তোমার সম্পত্তির উপর তোমার ভাইয়ের অধিকার, হক রয়েছে। তোমাকে আল্লাহ মেধা দিয়েছেন, সামর্থ দিয়েছেন যা দিয়ে তুমি সম্পত্তি অর্জন করবে। কিন্তু তোমার মত আরেকজনের সঙ্গে তুমি কী ব্যবহার করো সেটাই তোমার পরীক্ষা। যেহেতু শেষ পর্যন্ত কিছু থাকবে না তাহলে তোমার উচিত হলো তোমার এই অর্জনটাকে অন্যের জন্য উৎসর্গ করে দেয়া। তাহলেই তুমি মহান হয়ে গেলে, শ্রেষ্ঠ হয়ে গেলে। একটা বন্দুককে বানানো হয় মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু সেটার কল্যাণ অকল্যাণ নির্ভর করবে বন্দুক ব্যবহারকারীর উপর। বন্দুক দিয়ে সে চোর মারে না গৃহস্থকে মারে সেটাই হলো বিবেচ্য। সে বন্দুকটি দিয়ে ডাকাত দমন না করে যদি ডাকাতি কার্যে ব্যবহার করে তাহলে সেটা ঐ ব্যক্তির দায়। ইসলাম এখানেই এসে মানুষকে ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য শিক্ষা দিচ্ছে। তোমার এই জীবনের সমস্ত হায়াত, সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত বুদ্ধি, সমস্ত প্রজ্ঞা, সাহস ক্ষমতা এগুলো তোমার পরীক্ষা। এখন তুমি যদি সেটা অন্যের কল্যাণে ব্যবহার করো, অধিকার রক্ষা করো তবে তুমি আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ হলে, পরকালে জান্নাত পাবে, দুনিয়াতেও শ্রেষ্ঠ হবে। তুমি আল্লাহর রূহ ধারণকারী। তুমি উন্নত মগজধারী পশু নও।
এই বুনিয়াদি শিক্ষাটা ইসলাম দিয়ে থাকে যার প্রভাবে একটা মানুষ শোষকের পরিবর্তে দানশীল হবে। আত্মকেন্দ্রীক না হয়ে পরের জন্য জীবন উৎসর্গকারী হবে। আর এটা শুধু তাত্ত্বিক ব্যাপার নয়, কল্পনাবিলাসী কেতাবি কথা নয়। কেতাব তো এখন হয়েছে। তার আগেই আল্লাহর মনোনীত একজন মানুষ আল্লাহর রসুল (সা.) এসে এটা হাতেকলমে করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি এমন একটা জীবনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন যেটার নাম দীনুল হক। সেখানে সুদের কোনো কারবার নাই। সেখানে করযে হাসানা অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় ঋণ। সেখানে আছে যাকাত, আছে দান, আছে উৎসর্গ, আছে কোরবানি, আছে ফেতরা, আছে ইনসাফভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্য। সেখানে সুদের কোনো কারবার নেই। কোনো মজুদদারি নেই। ফলে সেখানে এমন একটা জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠে যেই জীবন ব্যবস্থায় যিনি শাসন করবেন তিনি আল্লাহর প্রতিনিধি, আল্লাহর খলিফা। তিনি সেই পরিমাণ ভাতা নেবেন একজন সাধারণ কর্মচারী যেই পরিমাণ ভাতা পান। তিনি এমন বাড়িতে বসবাস করবেন যেখানে সাধারণ নাগরিক বসবাস করেন। কোনো আর্মি বা নির্দিষ্ট কোনো সেনাবাহিনী নাই যে তাকে রক্ষার জন্য থাকবে। বরং পুরো জাতিটাকে রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী থাকবে। ফলে এখানে রাজনৈতিক কোনো জুলুমের সম্ভাবনাও নেই। সেই শাসন ব্যবস্থায় সন্তান নাতিপুতিকে ক্ষমতার উত্তারাধিকার হিসাবে রেখে যাওয়ার কোনো বিধান নেই। সেখানে মসজিদে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে খোতবা দেয়ার মধ্য দিয়ে জনগণের সামনে শাসক তার বিবৃতি পেশ করবেন। জাতির উদ্দেশ্যে কথা বলবেন। জনগন এবং শাসকের মধ্যখানে কোনো ব্যবধান নেই, প্রতিবন্ধকতা নেই। রাষ্ট্রীয় কাজে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সম্পূর্ণ অধিকার। সেখানে খোলামেলা আলোচনা হবে। অথচ আজকের সংসদে সাধারণ মানুষ ঢুকতেই পারে না। ইসলামের শাসনব্যবস্থায় একজন সাধারণ কুলি, মজুর, রিক্সাচালকও দাঁড়িয়ে বলতে পারেন যে আমার বাড়িতে চাল নেই। শ্রমিক বলতে পারেন আমাকে মজুরি দেওয়া হয় নি বা কম দেওয়া হয়েছে। তাহলে এখানে রাজনৈতিক হানাহানিরও কোনো সুযোগ নাই। এই জীবনব্যবস্থাটার রূপরেখাটা কী রকম হেযবুত তওহীদ তা তুলে ধরেছে।
একজন মানুষ যদি আল্লাহর হুকুম মানে, রাসুলের হুকুম মানে, এই অঙ্গীকারের মধ্যে এসে মো’মেন হয় তখন তাকে হুকুম দেয়া হয়েছে ঘাম শুকানোর আগে শ্রমিকের পারিশ্রমিক দেয়া। সে তোমার ভাই, তার সাধ্যের বাইরে তাকে কাজ করাবে না, তার সাথে কঠোর ভাষায় কথা বলবে না। এই নীতিগুলো যদি চলত তাহলে শিকাগোতে শ্রমিক হত্যার ঘটনা ঘটত না। পহেলা মে দিবস পালনেরও প্রয়োজন হত না।
আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, একটার পর একটা জীবনব্যবস্থা মানুষের জীবনে প্রয়োগ করা হয়েছে। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু একদিনের জন্যও যুদ্ধ রক্তপাত, অন্যায় অবিচার বন্ধ হয় নি। বরং দিনদিন সর্বপ্রকার অপরাধের পরিসংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সকল সিস্টেমের ব্যর্থতার পর আমরা প্রস্তাব করছি যে, এখন মানুষের সামনে একটাই পথ খোলা আছে। তা হলো, মানুষকে স্রষ্টার দেওয়া সহজ সরল পথ সিরাতুল মুস্তাকীমে প্রত্যাবর্তন করা। এটাই হচ্ছে সেই জীবনব্যবস্থা যা দিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, আধ্যাত্মিক সকল সংকটের সমাধান সম্ভব।