রাকীব আল হাসান:
এক বনের ঘটনা বলছি। কোনো প্রাণীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সকলে শিয়ালের কাছে যায় মীমাংসা করতে, কোনটি করা যাবে কোনটি যাবে না তা কেবল শিয়ালই মীমাংসা দেয় কারণ সবাই বিশ্বাস করে শিয়াল অনেক জ্ঞানী। আইন ও বিচার-আচারের জটিল মারপ্যাঁচ শিয়ালই বোঝে, এটা অন্যদের বোঝা সম্ভব নয়। শিয়াল মামলার রায় দেয় অত্যন্ত সুচতুরভাবে। বাঘ-সিংহ মামলা আনলে রায় সর্বদা তাদের পক্ষেই যায়, কারণ বাঘ-সিংহ যে শক্তিমান। ন্যায়ের চেয়ে তার কাছে শক্তি বড়। সে বনের সকল প্রাণীকে বিশ্বাস করিয়ে ফেলেছে যে, মামলা-মুকদ্দমার জ্ঞান, ভালো-মন্দের জ্ঞান, উচিত-অনুচিতের জ্ঞান তাদেরই আছে, অন্য কেউ যত যৌক্তিক মীমাংসাই উপস্থাপন করুক- একটি মাত্র বাক্য দ্বারা তা নাকচ করে দেওয়া হয়, বাক্যটি হলো, ‘মীমাংসা যে দিয়েছে সে কি শিয়াল?’ যদি সে শিয়ালই না হয় তবে তার কথা কেন গ্রহণ করা যাবে? শিয়াল ছাড়া তো কেউ মামলা-মুকদ্দমা বুঝেই না। তবে একই ঘটনার মীমাংসা একেক শিয়াল একেকভাবে দেয়। অর্থাৎ শিয়ালদের মধ্যে কিন্তু মতের কোনো মিল নেই, তারা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মত দেয় কেবল তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে একসাথে হুক্কাহুয়া বলে ডাক ধরে। এখন গাধাগুলো বুঝে গেছে মীমাংসা তার পক্ষে নিতে হলে কোন শিয়ালের কাছে যেতে হবে, ছাগলগুলোও বুঝে গেছে কোন শিয়ালটা তাদের পক্ষে রায় দেবে, সিংহ জানে সে যাই করুক না কেন কিছু শিয়াল তার পক্ষে থাকবেই। এভাবে বনের সমস্ত আইন-কানুন ভেঙ্গে গেছে। পানি খাওয়ার সময় তৃণভোজীদের উপর আক্রমণ করা নিষিদ্ধ ছিল বহুকাল থেকে কিন্তু এখন আক্রমণ করা হচ্ছে কিছু শিয়াল এই পক্ষে মত দেবার কারণে। তৃণভোজীদের বসবাসের এলাকায় মাংসাসীদের আক্রমণ নিষিদ্ধ থাকলেও এখন সেটা মান্য করা হচ্ছে না। বাচ্চা প্রাণীর উপরও আক্রমণ এখন বৈধ করে দিয়েছে কিছু শিয়াল। শিয়ালের এই নীতিভ্রষ্ট কাজের কারণ হলো স্বার্থ। মাংসাসী প্রাণীরা কিছু উচ্ছিষ্ট তাকে দেয় আর অমনি রায়টাও চলে যায় তাদের পক্ষে।
তাদের বিচার-মীমাংসার ফলে বনে দিনকে দিন অন্যায়-অশান্তি বেড়েই চলছিল, নাভিশ্বাস উঠছিল নিরীহ প্রাণীগুলোর। শক্তিশালী প্রাণীগুলোর আচরণ দিনকে দিন রুঢ় হচ্ছিল, তাদের অন্যায় আচরণের ফলে দুর্বল প্রাণীগুলোর জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল অথচ তৃণভোজী দুর্বল প্রাণীদের সংখ্যাই বনে অধিক। এমতাবস্থায় অনেকেই বন ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল, এই নরককুণ্ড ছেড়ে তারা অন্য কোথাও যেতে চায়। পাখিদের উপর দায়িত্ব পড়ল এমন একটি বন খুঁজে বের করার যেখানে সকলে মিলে মিশে শান্তিতে বসবাস করা যাবে, যেখানে ঘুমন্ত প্রাণীর উপর, বসবাসের স্থানে, পানিপানরত অবস্থায় আক্রমণ করা হবে না, বাচ্চা প্রাণীর উপর, অতি ছোট প্রাণী, ক্ষুধার্ত প্রাণী, ডুবন্তপ্রায় প্রাণী- এগুলোর উপর আক্রমণ করা হয় না।
পাখিরা চতুর্দিকে উড়ে গেল। একসপ্তাহ পর খবর নিয়ে ফিরে আসলো। সকল বনের একই অবস্থা, বরং বেশিরভাগ বনে এর চেয়েও ভয়ংকর অবস্থা। কোথাও মীমাংসা দিচ্ছে শিয়াল আবার কোথাও বানর কিন্তু অবিচার, বিশৃঙ্খলা, অশান্তি সকল বনেই চরম আকার ধারণ করেছে। কোনো প্রাণীর মনে সুখ নেই। পাখিগুলো চোখে দেখে এসেছে সমস্ত বনের অশান্তিময় অবস্থা, এ কারণে তারা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছে। অনেক চিন্তা করে তারা দেখল এই সমস্ত অশান্তির মূল কারণ হলো বনের যে সনাতন, সত্য, সঠিক নিয়মগুলো যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল তা অমান্য করা। আর এ কাজটির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হলো শিয়ালগুলো।
এবার পাখিরা সকল প্রাণীকে ডেকে বলতে লাগল- শিয়ালদের বিচার আচারগুলো যদি সঠিক, নির্ভুলই হবে তবে আমাদের বনে এভাবে অন্যায় বেড়ে চলেছে কেন? অবিচার থেকেই তো অন্যায় বৃদ্ধি পায়, অশান্তি চরমে ওঠে। কাজেই শিয়ালরা যেটা করছে তা অবিচার। আর যেকোনো বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত তো একটিই হয়, তবে বিভিন্ন শিয়াল বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দেয় কেন? আসলে তাদের প্রত্যেকের সিদ্ধান্তই ভুল, তারা নিজ স্বার্থে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত দেয়। আইন ও বিচারের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে তারা অন্য প্রাণীগুলোর কাছ থেকে নানা সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে- এটাই তাদের ভণ্ডামির সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
পাখিরা বুঝতে পারল এই অশান্তি থেকে সকল প্রাণীকে বাঁচাতে হলে সব প্রাণীকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে আর এজন্য প্রথমেই দরকার এই সত্য ও যৌক্তিক কথাগুলো সকলকে বোঝানো। পাখিরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সমস্ত বনে ছড়িয়ে পড়ল আর এই কথাগুলো গানের সুরে সুরে বলে বেড়াতে লাগল। এ কাজে তারা এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে, অনেক সময় খাবার অন্বেষণে যাবার কথাও ভুলে গেল। খুব সকাল থেকে রাত অবধি তারা এভাবে গান গেয়ে বেড়াল। কিন্তু তেমন কেউই তাদের কথায় সাড়া দিল না। তারা যতভাবে সম্ভব প্রাণীগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করে যেতে লাগল। কখনো মহিষের পালের মধ্যে গিয়ে, কখনো ছাগলের দলে গিয়ে, কখনো হাতির পিঠে বসে, কখনো বা হরিণের কাছে গিয়ে বোঝানোর চেষ্টা চালালো।
ছাগল বলল- তোমাদের কথা তো সঠিকই মনে হচ্ছে কিন্তু আমরা ছাগল, অত বুদ্ধি আমাদের নেই, চল শিয়ালের কাছে যাই, তারা কী বলে শুনি, তারাই তো সবচেয়ে জ্ঞানী। খরগস বলল- তোমারা তো ভারি সুন্দর কথা বলছ কিন্তু আমরা তো অতি দুর্বল প্রাণী, এ ব্যাপারে আমাদের কী-ই বা করার আছে? তবে তোমাদের সাথে আছি আমরা। পাখিরা বলল- আমরা যা বলে বেড়াচ্ছি তোমরাও তা বলে বেড়াও। কিন্তু খরগস ভয় পেল। গণ্ডার বলল- সব তো ঠিকই আছে, তোমরা আবার অশান্তি দেখছ কোথায়? বেশ তো ভালো আছি সবাই। গাধা বলল- তোমাদের কথা তো ভালো কিন্তু তোমরা অতি ক্ষুদ্র প্রাণী, শিয়ালদের মতো শিক্ষা তোমাদের নেই, তাহলে শিয়ালদের কথা বাদ দিয়ে তোমাদের কথা শুনব কেন? ঘোড়া বলল- তোমরা দুর্বল, তোমাদের কথা শুনে লাভ কী? এভাবে তাদের বক্তব্য অধিকাংশ প্রাণী প্রত্যাখ্যান করলেও হাঁস, মুরগী, ময়ূর জাতীয় কিছু দুর্বল প্রাণী তাদের সাথে একমত হলো এবং একইভাবে তারাও এই কথাগুলো প্রচারে অংশগ্রহণ করল। তাদের সকল প্রচারণা ছিল মূলত অন্যায়ের বিরুদ্ধে। যেহেতু অন্যায়কারীরা ছিল শিয়াল ও শক্তিশালী হিংস্র প্রাণীগুলো তাই এই প্রচারণায় অংশগ্রহণকারী সকল প্রাণীর উপর নেমে আসলো নির্মম নির্যাতন। তারা এই দুর্বল প্রাণীগুলোকে ধরে ধরে খেতে লাগল। কিন্তু প্রচারণা থামল না। বনে অন্যায়-অশান্তিও বাড়তে লাগল। আশেপাশের কিছু বনের খবরও এই বনের প্রাণীগুলো জানত যে, এমন অবস্থার কারণে সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। নিরীহ প্রাণীগুলো বন ছেড়ে লোকালয়ে চলে গেছে (যদিও লোকালয়ে তাদের আশ্রয় হয়নি), খাবার সঙ্কটে হিংস্র প্রাণীও বনের বাইরে এসেছে, লোকালয়ে ঢুকেছে তখন মানুষ হিংস্র প্রাণী নিধন করবার অজুহাতে বনে ঢুকেছে, গাছপালা কেটে নিয়ে গেছে, প্রাণীগুলোকে মেরে ফেলেছে, সমস্ত বন ধ্বংস করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতি এই বনেও ঘটতে পারে- এ আশঙ্কা অনুভব করে কিছু কিছু প্রাণী পাখিদের প্রচারিত কথাগুলো একটু করে বুঝতে লাগল, পাখিদের সাথে ঐকমত্ব পোষণ করতে লাগল। এভাবে কিছু হাতি, কিছু জিরাপ, কিছু জলহস্তির মতো অতিকায় বড় বড় প্রাণীও পাখিদের সাথে যোগ দিল। তাদের উদ্যোগে এক সভা ডাকা হলো। সভায় সকল প্রাণীকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। বেশিরভাগ শিয়াল এবং হিংস্র প্রাণীরা সেখানে না আসলেও অন্যান্য প্রায় সকল প্রাণীই উপস্থিত হলো। পাখিদের নেতৃত্বে ছিল সাদা ফুটফুটে এক ঝাঁক কবুতর। বড় কবুতরটি সবচেয়ে বড় হাতির মাথার উপর গিয়ে বসল। সকল প্রাণীর উদ্দেশ্যে সে অতি গুরুত্বপূর্ণ এক বক্তব্য দিল।
বৃদ্ধ কচ্ছপদের উদ্দেশে বলল- ‘তোমরা তো কালের সাক্ষী, বহুদিন এ বনেই বসবাস করছ। বর্তমানের ন্যায় অবস্থা কখনো এই বনে ছিল কিনা?’ বৃদ্ধ কচ্ছপরা না বোধক উত্তর করল। বানরদের উদ্দেশে বলল- ‘তোমরাও অনেকদিন বেঁচে থাকো, তোমাদের জ্ঞান-বুদ্ধির ব্যাপারেও প্রশংসা আছে। তোমরাই বল, বনের বর্তমাণ অবস্থা কেমন বুঝছো?’ উত্তরে বানররা বলল, ‘এই বন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসেছে। আর বন ধ্বংস হলে আমরা কেউই বাঁচবো না।’
এবার ফুটফুটে সেই কবুতর সবার উদ্দেশ্যে বলল- অনেকেই হয়ত ভাবছেন লোকালয়ে গিয়ে আশ্রয় নেবেন, কেউ ভাবছেন মানুষের কাছে অভিযোগ করবেন হিংস্র প্রাণীগুলোর বিরুদ্ধে। কিন্তু এতে লাভ হবে না। পার্শবর্তী ধ্বংস হয়ে যাওয়া বনগুলো দেখে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। লোকালয় থেকে মানুষ হিংস্র প্রাণী মারার অজুহাতে বনে এসে পুরো বনই ধ্বংস করে দিয়েছে। তৃণভোজী প্রাণীগুলোকেও মেরেছে, গাছ কেটে নিয়ে গেছে আর সব শেষে বন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। আমরা যদি এখনই সকলে এক না হই তবে আমাদের পরিণতিও একই হবে।
এখন দেখার বিষয়, বক্তব্য শুনে বন্যপ্রাণীগুলোর বোধোদয় হয় কি না।
[এই গল্পের চরিত্রগুলো সম্পূর্ণ কাল্পনিক, কারো সাথে কিছুটা মিলে গেলে লেখকের দায় থাকবে না।]