মানুষ মননশীল প্রাণী। তাকে যেমন দেহের চাহিদা মেটাতে হয়, তেমনি মনের চাহিদাও মেটাতে হয়। মনের চাহিদা মেটাতে মানুষ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শিল্প ও সংস্কৃতির চর্চা করে আসছে। ইতিহাস থেকে যতগুলো সভ্যতার কথা আমরা জানতে পারি, সবগুলোরই প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে ধর্ম ছিল প্রধান নিয়ামক। ধর্ম প্রবর্তক নবী, রসুল বা অবতারগণের অনুপ্রেরণায় প্রগতিপ্রাপ্ত হয়ে যুগে যুগে মানুষ গড়ে তুলেছে নব সভ্যতা। আর শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা ছিল প্রত্যেক সভ্যতার অপরিহার্য অঙ্গ। তাই ধর্ম কখনও শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ হতে পারে না, বরং তারা একে অপরের পরিপূরক। ধর্ম অর্থাৎ জীবনব্যবস্থা একটি সমাজে শান্তি, ন্যায়, সুবিচার ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। আর এমন পরিবেশই মানুষের শিল্পকলার চর্চা, সাহিত্যচর্চা, সঙ্গীতচর্চা ও জ্ঞানসাধনার পূর্বশর্ত।
ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্নতার জন্য একেক এলাকার পোশাক আশাক, উৎসব, সঙ্গীত তথা সংস্কৃতি একেক রকম হয়। আল্লাহর পাঠানো শেষ জীবনব্যবস্থা ইসলাম এসেছে সমগ্র পৃথিবীর মানবজাতির জন্য। পৃথিবীর সকল এলাকার ভূ-প্রকৃতি ও মানুষের পেশা যেহেতু একরকম নয়, সেহেতু বিভিন্ন এলাকার সংস্কৃতির মধ্যে বৈচিত্র থাকবে – এমনটাই স্বাভাবিক। আর যিনি প্রকৃতির স্রষ্টা তিনি কখনও মানুষের জন্য অপ্রাকৃতিক কোনো বিধান দিতে পারেন না। তাই ইসলামের সকল বিধান সকল এলাকার মানুষের জন্য প্রয়োগযোগ্য, আলো বাতাস পানির মতো স্বাভাবিক।
কিন্তু আমরা বাস্তবে দেখি আমাদের সমাজে যারা আলেমে দীন বলে পরিচিত তারা ওয়াজ মাহফিলে ফতোয়া দিচ্ছেন গান গাওয়া হারাম, বাদ্যযন্ত্র বাজানো হারাম, ছবি আঁকা হারাম, ভাস্কর্য তৈরি করা হারাম, অভিনয় করা হারাম, নৃত্যচর্চা হারাম, পহেলা বৈশাখে মেলায় যাওয়া হারাম, নবান্ন উৎসব করা হারাম, শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া হারাম, জন্মদিন পালন করা হারাম, টিভি দেখা হারাম, সিনেমা-নাটক দেখা হারাম।
বিষয়টি এই ফতোয়ার মধ্যেই সীমিত থাকে না। অনেক সময় এসব ফতোয়া বাস্তবায়ন করার জন্য ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে হামলাযজ্ঞ চালানো হয়। যশোরে উদীচীর কার্যালয়ে বোমা হামলা, রমনার বটমূলে ছায়ানটের পহেলা বৈশাখের সঙ্গীতানুষ্ঠানে বোমা হামলা, ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে সিরিজ বোমা হামলা, সাতক্ষীরায় একটি সিনেমা হল ও স্টেডিয়ামে সার্কাস প্রদর্শনীর উপর বোমা হামলা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে লালনের ভাস্কর্য, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য এমন কি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ভাঙচুর ইত্যাদি ঘটনা এই বার্তাই দেয় যে, ইসলাম বুঝি যাবতীয় দেশজ ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির শত্রু।
এই জাতীয় ফতোয়া মুসলমানদের মনে-মগজে এমন দৃঢ়মূল হয়ে গেছে যে তাদের মধ্যে যারা শিল্পচর্চা করতে চান তারা অনেক সময় নিজ পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের কাছেই বাধার সম্মুখীন হন। সেই বাধাকে অতিক্রম করে অনেকেই তাদের শিল্প-সংস্কৃতির চর্চাকে অব্যাহত রাখলেও সব সময় নিজেকে এজন্য গোনাহগার, পাপী বলে জানেন। পাপবোধ ও সংশয় তাদেরকে ঘিরে রাখে। এহেন হীনম্মন্যতার দরুন তারা শিল্পসাধনায় পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করতে পারেন না, ফলে নিজেদের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা ও প্রতিভাকে পূর্ণরূপে বিকশিতও করতে পারেন না। শেষ বয়সে গিয়ে তারা নাচ, গান, অভিনয় ছেড়ে দিয়ে তওবা করে ভীষণ পরহেজগার হয়ে যান, পাপমুক্তির জন্য মসজিদ মাদ্রাসায় দান করতে শুরু করেন, নারী হলে কঠিন পর্দা করতে শুরু করেন।
কিন্তু বাস্তবেই কি ইসলাম যাবতীয় শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার প্রতিপক্ষ?
এটা জানতে হলে প্রচলিত ফতোয়ার উপর থেকে অন্ধবিশ্বাস একপাশে সরিয়ে রেখে ইসলামের মূল গ্রন্থ কোর’আন এবং রসুলাল্লাহর আদর্শের (সুন্নাহ) দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে এবং নিজেদের আল্লাহপ্রদত্ত যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি-বিবেককে কাজে লাগাতে হবে। হালাল ও হারাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইসলামের নীতি হলো, আল্লাহ যা হারাম করেন নি তা হালাল। আর আল্লাহর বাণী হচ্ছে কোর’আন যা অবিকৃত রয়েছে এবং থাকবে। রসুলাল্লাহর নামে অগণিত জাল হাদিস বাজারে চালু আছে, কিন্তু কোর’আনের একটি আয়াতও জাল করা সম্ভব না। তাই কোর’আন হচ্ছে ইসলামের নামে প্রচলিত যে কোনো ধারণাকে মূল্যায়ন করার মানদণ্ড। আল্লাহ কোর’আনে গুটিকয় কাজ, খাদ্য ও বিষয় হারাম করেছেন। তিনি বলেন, “আপনি বলে দিন: আমার পালনকর্তা কেবলমাত্র অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য, হারাম করেছেন আল্লাহর নাফরমানি, অন্যায়-অত্যাচার চালানো, আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে অংশীদার করা, তিনি যার কোনো সনদ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা, যা তোমরা জানো না (সুরা আরাফ ৩৩)।
এখানে তিনটি বিষয়কে হারাম করা হচ্ছে। এক- অশ্লীলতা। দুই- আল্লাহর নাফরমানি অর্থ আল্লাহর সুস্পষ্ট বিধানের লংঘন করা, তিন- আল্লাহর সঙ্গে শেরক করা। এই তিনটি কাজ না করে যে কোনো কাজ, সেটা শিল্পচর্চা হোক কি দৈনন্দিন জীবনের যে কোনো কাজ তা ইসলাম পরিপন্থী বা নাজায়েজ কাজ হতে পারে না। আর আল্লাহর রসুল ছিলেন জীবন্ত কোর’আন। তিনি তাঁর নব্যুয়তি জীবনে এমন কিছু করতে পারেন না যা কোর’আনের হুকুম পরিপন্থী। আমরা এখন একটা একটা করে দেখব, কোর’আনে কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও শিল্পচর্চাকে হারাম করা হয়েছে কিনা।
গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার
সঙ্গীত সব যুগে সব জাতির সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আদর্শহীনতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের দরুন সংস্কৃতিতে অশ্লীলতার অনুপ্রবেশ ঘটে। ইসলামপূর্ব আরবের জাহেলিয়াতের যুগেও সঙ্গীত ও কাব্যচর্চায় চরম অশ্লীলতার চর্চা করা হতো। অভিজাত ব্যক্তিরা আমোদ-ফুর্তির জন্য বাঈজিদের ভরণপোষণ করতো। দাসের বাজারে যে দাস-দাসীরা গান গাইতে পারদর্শী ছিল তাদের দাম বেশি ছিল। এই জাহেলিয়াতের চর্চা থেকে সমাজকে মুক্ত করেছিল ইসলাম। কিন্তু সঙ্গীত ও সংস্কৃতিচর্চা তিনি বন্ধ করেন নি।
রসুলাল্লাহর উপস্থিতিতেও মদীনায় সাহাবীদের বিয়ে শাদি বা অন্য যে কোনো উৎসবে দফ বাজিয়ে গান গাওয়া হতো। আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘তোমরা এই বিবাহের ঘোষণা দাও। এটা মসজিদে সম্পন্ন করো এবং বিবাহ উপলক্ষে দফ বাজাও।’ (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ।) একটি হাদিসে এমন কি এও বলা হয়েছে যে, ‘হালাল ও হারামের মাঝে পার্থক্য নির্ণয়কারী হলো- বিয়ের সময় দফ বাজানো এবং তা জনসম্মুখে প্রচার করা।’ (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ।) সুতরাং বিয়েতে গান-বাজনা করা রসুলাল্লাহর হুকুম।
রসুলাল্লাহর নারী সাহাবি রুবাই বিনতে মুআব্বিয ইবনু আফরা (রা.) বলেন, “আমার বাসর রাতের পরের দিন নবী (সা.) এলেন এবং আমার বিছানার ওপর বসলেন, যেমন বর্তমানে তুমি আমার কাছে বসে আছ। সে সময়ে মেয়েরা দফ বাজাচ্ছিল এবং বদর যুদ্ধে শাহাদাত প্রাপ্ত আমার বাপ-চাচাদের শোকগাঁথা গাচ্ছিল। তাদের একজন গাচ্ছিল, আমাদের মধ্যে এক নবী আছেন, যিনি ভবিষ্যৎ জানেন। তখন রসুলুল্লাহ্ বললেন, এ কথাটি বাদ দাও, আগে যা গাইছিলে তাই গাও (সহিহ বোখারী, হাদিস নং ৫১৪৭)।” লক্ষ করুন, এখানে রসুলাল্লাহ (সা.) মেয়েদেরকে গান গাইতে বারণ করলেন না, কিন্তু তাঁর ব্যাপারে একটি মিথ্যা ধারণা তিনি সংশোধন করে দিলেন।
আমাদের ধর্মীয় অঙ্গনে যুক্তিবুদ্ধির চর্চা এতটাই উঠে গেছে যে, এক শ্রেণির মুফতি এও বলে থাকেন যে সব বাদ্যযন্ত্র হারাম, কেবল দফ হালাল, কারণ সাহাবিরা দফ বাজাতেন। প্রকৃত বিষয় হলো, সে যুগে আজকের মতো এত সব বাদ্যযন্ত্র ছিল না, ছিল কেবল দফ, তাম্বুরা ইত্যাদি। সেগুলোই তারা বাজাতেন।
সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র যদি হারামই হতো তাহলে পবিত্র কোর’আনে কি আল্লাহ একটি আয়াতেও কি আল্লাহ সেটা উল্লেখ করতে পারতেন না? না। তিনি কোথাও এ জাতীয় কোনো কথাই বলেন নি। কিন্তু দীনের অতিবিশ্লেষণ করে সুরা লোকমানের ৬ নম্বর আয়াতকে সঙ্গীতের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয় যেখানে আল্লাহ সঙ্গীত শব্দটিই বলেন নি, বলেছেন অসার কথাবার্তা। আল্লাহ বলেন, “একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।”
সঙ্গীত আর অসার বা অবান্তর কথা কি এক বিষয়? সঙ্গীতের বাণী তো শিক্ষামূলকও হতে পারে, সুন্দর সমাজ ও মানবতাবোধের বাণীও সঙ্গীতে ধ্বনিত হতে পারে। নয়তো আজান কেন সুর করে দেওয়া হয়? কোর’আন কেন সুর করে পড়া হয়? ওয়াজ কেন সুর করে করা হয়? তাছাড়া আসমানি কেতাববাহী প্রধান চারজন রসুলের অন্যতম দাউদ (আ.) এর মো’জেজাই ছিল তাঁর সুরেলা কণ্ঠ। তিনি হার্প (Harp) নামক বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, যার ছবি ঐ সময়ের মুদ্রাতেও অঙ্কিত ছিল। তিনি বলতেন, On the harp I will praise you o God (Old Testament – Psalm 43.4)
সুতরাং আল্লাহ যেমন সঙ্গীত হারাম করেন নি, তেমনি রসুলাল্লাহও (সা.) সঙ্গীত চর্চাকে নিষিদ্ধ করেন নি। কিন্তু তিনি ছিলেন মানব ইতিহাসের ব্যস্ততম পুরুষ, যিনি মাত্র ৯ বছরে ১০৭ টি ছোট বড় যুদ্ধাভিযানের আয়োজন করেছেন, যিনি মানবজীবনের সর্ব অঙ্গনের আমূল পরিবর্তন সাধনের জন্য এক মহান বিপ্লব সম্পাদন করেছেন। এমন এক মহা বিপ্লবীর গান নিয়ে পড়ে থাকার অবসর ছিল না। তবু অবসরে নিজ গৃহে অথবা যুদ্ধ থেকে ফিরে সাহাবিদের সঙ্গে তাঁকে চিত্তবিনোদনের জন্য গান শুনতে দেখা গেছে।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, একবার রসুলাল্লাহ কোনো এক সফরে যাচ্ছিলেন। জনৈক উট চালক উটের রশি ধরে হেঁটে যাচ্ছিল আর ‘হুদি’ গান গাচ্ছিল, আর উটগুলোকে আরো জোরে চলার জন্য তাড়া দিচ্ছিল। ঠিক যেভাবে আমাদের দেশের মাঝিমাল্লারা ভাটিয়ালি গান, গাড়োয়ানরা ভাওয়াইয়া গান করেন। উটের পিঠে আরোহী ছিলেন রসুলাল্লাহর স্ত্রীগণ। স্ত্রীগণের উটটি রসুলাল্লাহর উটকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল। তখন তিনি গায়ককে লক্ষ্য করে বললেন, আনযাশাহ! সাবধানে চলো; এই কাচের পাত্রদের সঙ্গে কোমল আচরণ করো। (মুসনাদে আহমদ, ৩:১৭২, ১৮৭, ২০২)।
রসুলাল্লাহ যখন হেজরত করে মদিনায় এসে পৌঁছান তখন তাঁকে বরণ করে নেওয়ার জন্য আনসার নারী পুরুষ শিশু কিশোর নির্বিশেষে দফ বাজিয়ে “তালা-আল বাদরু আলাইনা” গানটি গাইতে থাকেন। এই গানটি ১৪০০ বছরেরও বেশি পুরনো ইসলামি সংস্কৃতির একটি অনন্য সঙ্গীত যা আজও মিলাদের সময় গাওয়া হয়।
মদিনায় এসে মসজিদে নববী নির্মাণের সময় আল্লাহর রসুল (সা.) স্বয়ং গান গেয়েছিলেন এবং তাঁর সঙ্গীরাও গান গেয়েছিলেন। এই গানের নাম হচ্ছে রাজস্। আনাস (রা.) বলেন, রসুলাল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবিগণ মসজিদ নির্মাণের সময় খেজুর গাছগুলোকে কেবলার দিকে সারিবদ্ধভাবে স্থাপন করলেন। চৌকাঠের দুই বাহুতে স্থাপন করলেন পাথর। রসুলাল্লাহ (সা.) এবং তাঁর সঙ্গীরা তখন ‘রাজয’ তথা কর্মসঙ্গীত গাচ্ছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, হে আল্লাহ! আখেরাতের মঙ্গলই প্রকৃত মঙ্গল। আপনি সাহায্য করুন আনসার ও মোহাজিরদের। – (বোখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ।) সুতরাং সৎকাজের উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য গান গাওয়াকে রসুলাল্লাহর সুন্নাহ বললেও অত্যুক্তি হবে না।
জাহেলিয়াতের যুগে আরবে গান আর অশ্লীলতা ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই অনেক সাহাবি গানকেই ফাহেশা কাজ বা মন্দ কাজ বলে ভাবতে লাগলেন। কিন্তু রসুলাল্লাহ (সা.) তাঁদের এই ভুল ধারণা ভাঙিয়ে দিলেন। আম্মা আয়েশা (রা.) খুব সংগীতানুরাগী ছিলেন। তাঁর গৃহে রাসুলাল্লাহর (সা.) উপস্থিতিতেই সংগীত চর্চার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
(ক) একবার আরবের একটি জাতীয় উৎসবের দিন ‘বুয়াস দিবস’- এ দুটো মেয়ে রসুলাল্লাহর ঘরে দফ ও তাম্বুরা বাজিয়ে গান গাইছিল। আম্মা আয়েশাও (রা.) গান শুনছিলেন। এমন সময় তাঁর পিতা আবু বকর (রা.) সেখানে আসেন এবং আম্মা আয়েশাকে (রা.) তিরস্কার করেন। তখন আল্লাহর নবী আবু বকরের (রা.) দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আবু বকর! তাদেরকে তাদের কাজ করতে দাও” (সহিহ বোখারী, হাদিস নং ৯৮৭)।
(খ) আয়েশা (রা.) একটি মেয়েকে লালন পালন করতেন। অতঃপর তাকে এক আনসারের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানস্থল থেকে আয়েশা (রা.) এর প্রত্যাবর্তনের পর রাসুলাল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন,“তুমি কি মেয়েটিকে তার স্বামীর বাড়িতে রেখে এসেছো?” উত্তরে তিনি বললেন, “হ্যাঁ”। পুনরায় রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি এমন কাউকে তাদের বাড়ি পাঠিয়েছ যে গান গাইতে পারে?” আয়েশা (রা.) বললেন, “না”। রাসুলাল্লাহ বললেন, “তুমি তো জান আনসাররা অত্যন্ত সংগীতপ্রিয়” (ইকদ আল ফরিদ)।
(গ) আবু বোরায়দা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (স.) কোনো একটি যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময় একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী সাহাবী মহানবী (স.) এর সামনে এসে বললেন যে- ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি মানত করেছিলাম যে, আপনাকে নিরাপদে আল্লাহ ফিরিয়ে আনলে আমি আপনার সামনে দফ বাজিয়ে গান গাইব।’ মহানবী (স.) বললেন, ‘যদি তুমি মানত করে থাক তাহলে বাজাও। মানত পূর্ণ কর। তারপর মেয়েটি দফ বাজিয়ে গান গাইতে লাগল।’ [তিরমিজি ২য় খণ্ডের ২০৯-২১০ পৃষ্ঠা, মেশকাত শরিফের ৫৫৫ পৃষ্ঠা ও আবু দাউদ শরিফ]।
এই ঘটনাগুলোতে কয়েকটি বিষয় ভাল করে লক্ষ করে দেখুন:
১. যে ঘরে গান হচ্ছে সেটি স্বয়ং রাসুলাল্লাহর ঘর, ২. ঘরে তিনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন, ৩. তাঁর স্ত্রী আয়েশা (রা.) সংগীত অনুরাগী ছিলেন, ৪. মেয়েরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করছিল, ৫. গানগুলো মদীনাবাসীর জাতীয় উৎসবের সাথে সম্পর্কিত গান তা কোনো ইসলামিক হামদ-নাত ছিল না, কিন্তু ইসলামের সীমারেখা অতিক্রম না করায় রসুলাল্লাহ সেগুলোর অনুমতি দিলেন, ৬. বুয়াস দিবস অর্থাৎ আরবের কোনো আঞ্চলিক ঐতিহাসিক দিবস। সেটাও ইসলামিক কোনো অনুষ্ঠান ছিল না। ৭. গান যদি নিষিদ্ধ হতো তাহলে রসুলাল্লাহ নিশ্চয়ই উক্ত নারী সাহাবিকে নিষিদ্ধ মানত পুরণ করতে দিতেন না।
এগুলো হচ্ছে রসুলাল্লাহর জীবনের ঘটনা। তাঁর এন্তেকালের পর সাহাবিগণও তাঁর এই সুন্নাহর কথা জাতিকে সর্বদা স্মরণ করিয়ে দিতেন। ইয়াদ আল আশ’আরী (রা.) একদিন আম্বার নাম এলাকায় ঈদের সালাতে উপস্থিত হন। ঈদের ময়দানে কেউ দফ বাজাচ্ছিল না দেখে তিনি প্রশ্ন করেন যে, আমি তোমাদেরকে দফ বাজাতে দেখছি না কেন, যেমনটা রসুলাল্লাহর (সা.) সামনে বাজানো হতো? (ইবনে মাজাহ)
অন্যান্য শিল্পচর্চা
একইভাবে ইসলামের বৈধ-অবৈধের মূলনীতি মেনে চললে যে কোনো শিল্প-সংস্কৃতির চর্চাই জাতির জন্য কল্যাণকর হয়ে উঠতে পারে। আল্লাহর অবাধ্যতা, অশ্লীলতা ও মিথ্যার বিস্তার না ঘটিয়ে ছবি আঁকা, ভাস্কর্য নির্মাণ করা, নাটক-চলচ্চিত্র নির্মাণ করা, শরীর গঠনমূলক খেলাধুলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায় নয়। মসজিদে নববীর প্রাঙ্গণে নিয়মিতভাবে ঘোড়দৌড়, কুস্তি, তলোয়ার যুদ্ধ, বর্শা খেলা, তীরন্দাজী, দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো, রসুলাল্লাহ স্বয়ং সেগুলোতে উপস্থিত থাকতেন, অংশও নিতেন। সুতরাং যেসব খেলায় শরীর চর্চা হয়, দম, সাহস ও ক্ষিপ্রতা বৃদ্ধি পায় সেসব খেলাকে ইসলাম উৎসাহিত করে। তবে যেসব খেলা মানুষকে অন্তর্মুখী করে সেসব খেলা এবং খেলা নিয়ে জুয়া ইসলামে নিষিদ্ধ।
মুসলমানদের জন্য মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ, তাই বলে অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতিমা ভেঙে ফেলতে হবে এমন কোনো হুকুম আল্লাহ দেন নি। উপাস্যে পরিণত করা না হলে কোনো মহান ব্যক্তির ভাস্কর্য নির্মাণকেও ইসলাম হারাম করে না। তাছাড়া খেলার উদ্দেশে তৈরি মানুষ বা জীবজন্তুর পুতুলের উপরও রসুলাল্লাহর কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এমন কি তাঁর ঘরেও এ জাতীয় খেলনা মানবাকৃতির পুতুল ও পক্ষীরাজ ঘোড়ার পুতুল ছিল বলে জানা যায় (আবু দাউদ, বায়হাকি)।
মক্কাবিজয়ের দিন কাবা ঘর থেকে যখন সকল দেবদেবীর মূর্তিগুলো অপসারণ করা হয়, তখন কাবার দেওয়ালে আঁকা অনেক দেবদেবীর ছবিও পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়। সেখানে ঈসা (আ.) ও মা মরিয়মের (আ.) একটি যুগল ছবি অঙ্কিত ছিল। রসুলাল্লাহ সেই ছবিটা নিজের পবিত্র হাত দিয়ে ঢেকে রেখে বলেছিলেন, এই ছবিটা ছাড়া বাকি সব ধুয়ে মুছে ফেল। (সিরাত ইবনে ইসহাক)।
কোরআনে সুরা সাবার ১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তারা (নির্মাণশ্রমিকরা) সোলায়মানের (আ.) ইচ্ছানুযায়ী উপাসনালয় ও দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউজসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত।” আল্লাহ সকল নবীদেরকে পাঠিয়েছেন শেরেকের বিরুদ্ধে। তাঁরা সবাই এর বিরুদ্ধে ছিলেন। যদি ভাস্কর্য শেরেক হতো তাহলে নবী সোলায়মান (আ.) ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন না।
শেষ নবীর ইসলামেও যে ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ছিল না তার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তও রয়েছে। আবু বকর (রা.) এর শাসনামলে আমর বিন আসের (রা.) মিশর অভিযানের পরও ফারাওদের তৈরি স্ফিংসসহ বিভিন্ন ভাস্কর্য অক্ষত রেখেছিলেন। খ্রিষ্টানদের চার্চের জন্য তিনি নিজে যিশুর মূর্তি গড়ে দিয়েছিলেন। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের (রা.) ইরাকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সময়ও সেখানকার কোনোও ভাস্কর্য মূর্তি ভাঙ্গা হয়নি। ভাঙা হয়নি বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তিও। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে তালেবানরা বোমা মেরে সেই মূর্তিগুলো গুড়িয়ে দিয়েছে।
সুতরাং এটা বোঝা গেল যে, ইসলাম সঙ্গীত, বাদ্য সুর-সংগীতকে নিষিদ্ধ করে নি। নিষিদ্ধ করেছে অশ্লীলতা, নোংরামী, অন্যের ক্ষতি হয়, আল্লাহর নাফরমানি করা হয় এমন বিষয়কে। অশ্লীলতা নিশ্চয়ই কোনো ধর্মই সমর্থন দেয় না। হেযবুত তওহীদও রসুলাল্লাহর এই নীতিকে উপলব্ধি করে সেই শিক্ষার আলোকে গড়ে তুলেছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক অঙ্গন। গান, আবৃত্তি, অভিনয় ইত্যাদি শিল্পকলার মাধ্যমে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার করার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কাছে শিল্প-সংস্কৃতি সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের হাতিয়ার।