হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

শিল্পচর্চায় হালাল ও হারামের সীমারেখা

রিয়াদুল হাসান:
শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা মানুষের প্রাকৃতিক প্রবণতা। তাই আল্লাহর দীন এগুলোকে হারাম করেনি, বরং এগুলোর সঠিক চর্চার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। ইসলামপূর্ব আরবে অশ্লীল কাব্যচর্চা হত। রসুলাল্লাহ কাব্যচর্চা নিষিদ্ধ করেননি, শুধু অশ্লীলতা পরিহার করতে বলেছেন। এমনকি আল্লাহও কোর’আন নাজিল করেছেন কাব্যিক ভাষায়। একইভাবে আরবের নাচ-গানে, জীবনাচরণে অশ্লীলতা মিলে মিশে একাকার ছিল। ইসলাম এই অশ্লীলতাকে নিষিদ্ধ করেছে কিন্তু গান হারাম করেনি। হালাল ও হারাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইসলামের নীতি হল, আল্লাহ যা হারাম করেন নি তা হালাল। আল্লাহ কোর’আনে গুটিকয় কাজ, খাদ্য ও বিষয় হারাম করেছেন। তিনি বলেন, ‘আপনি বলে দিন: আমার পালনকর্তা কেবলমাত্র অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য, হারাম করেছেন আল্লাহর নাফরমানি, অন্যায়-অত্যাচার চালানো, আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে অংশীদার করা, তিনি যার কোনো সনদ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা, যা তোমরা জানো না (সুরা আরাফ ৭:৩৩)।

এখানে তিনটি বিষয়কে হারাম করা হচ্ছে। এক- অশ্লীলতা। দুই- আল্লাহর নাফরমানি অর্থ আল্লাহর সুস্পষ্ট বিধানের লংঘন করা, তিন- আল্লাহর সঙ্গে শেরক করা। আল্লাহ প্রদত্ত হালাল হারামের বিধি-নিষেধ মেনে যে কোনো কাজ, সেটা শিল্পচর্চা হোক কি দৈনন্দিন জীবনের যে কোনো কাজ তা ইসলাম পরিপন্থী বা নাজায়েজ কাজ হতে পারে না। রসুলাল্লাহর উপস্থিতিতেও মদীনায় সাহাবীদের বিয়ে শাদি বা অন্য যে কোনো উৎসবে দফ বাজিয়ে গান গাওয়া হতো। আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘তোমরা এই বিবাহের ঘোষণা দাও। এটা মসজিদে সম্পন্ন করো এবং বিবাহ উপলক্ষে দফ (বাদ্য) বাজাও।’ (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ।)

সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র যদি হারামই হতো তাহলে পবিত্র কোর’আনে একটি আয়াতেও কি আল্লাহ সেটা উল্লেখ করতে পারতেন না? না। তিনি কোথাও এ জাতীয় কোনো কথাই বলেন নি। বাদ্যযন্ত্র হারাম নয় তার বড় প্রমাণ হচ্ছে, আসমানি কেতাববাহী প্রধান চার রসুলের অন্যতম দাউদ (আ.) এর মো’জেজাই ছিল তাঁর সুরেলা কণ্ঠ। তিনি বীণা (ঐধৎঢ়) নামক বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, যার ছবি ঐ সময়ের মুদ্রাতেও অঙ্কিত ছিল।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, আল্লাহর রসুল ছিলেন মানব ইতিহাসের ব্যস্ততম মহাপুরুষ, যিনি মাত্র ৯ বছরে ১০৭ টি ছোট বড় যুদ্ধাভিযানের আয়োজন করেছেন, যিনি মানবজীবনের সর্ব অঙ্গনের আমূল পরিবর্তন সাধনের জন্য এক মহান বিপ্লব সম্পাদন করেছেন। এমন এক মহা বিপ্লবীর গান-বাজনা নিয়ে পড়ে থাকার অবসর ছিল না। তবু হাদিসে পাই অবসরে নিজ গৃহে অথবা যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর তাঁকে গান শোনানো হয়েছে। তিনি নিষেধ করেননি, শুনেছেন। এমনকি মদিনায় এসে মসজিদে নববী নির্মাণের সময় আল্লাহর রসুল (সা.) তাঁর সাহাবিদের সঙ্গে মিলিত কণ্ঠে কর্মসঙ্গীত গেয়েছিলেন এবং তাঁর সঙ্গীরাও গান গেয়েছিলেন। – (বোখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ।)

জাহেলিয়াতের যুগে আরবে গান আর অশ্লীলতা ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই অনেক সাহাবি গানকেই ফাহেশা কাজ বা মন্দ কাজ বলে ভাবতে লাগলেন। কিন্তু রসুলাল্লাহ (সা.) তাঁদের এই ভুল ধারণা ভাঙিয়ে দিলেন। আম্মা আয়েশা (রা.) গান পছন্দ করতেন। তাঁর গৃহে রসুলাল্লাহর (সা.) উপস্থিতিতেই গান গাওয়ার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

(ক) একদিন দুটো মেয়ে রসুলাল্লাহর ঘরে দফ ও তাম্বুরা বাজিয়ে গান গাইছিল। রসুলাল্লাহ শুয়ে ছিলেন। আম্মা আয়েশাও (রা.) গান শুনছিলেন। এমন সময় তাঁর পিতা আবু বকর (রা.) আসেন এবং আম্মা আয়েশাকে (রা.) তিরস্কার করেন। তখন আল্লাহর নবী আবু বকরের (রা.) দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আবু বকর! তাদেরকে তাদের কাজ করতে দাও। আজ তাদের ঈদের দিন।’ (সহিহ বোখারী, হাদিস নং ৯৮৭)।

(খ) আয়েশা (রা.) একটি মেয়েকে লালন পালন করতেন। অতঃপর তাকে এক আনসারের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানস্থল থেকে আয়েশা (রা.) এর প্রত্যাবর্তনের পর রসুলাল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি গীত গাইতে পারে এমন কাউকে সেখানে পাঠিয়েছ?’ আয়েশা (রা.) বললেন, ‘না’। রসুলাল্লাহ বললেন, ‘তুমি তো জান আনসাররা অত্যন্ত সংগীতপ্রিয়’ (মিশকাতুল মাসহাবি)।

(গ) আবু বোরায়দা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (স.) কোনো একটি যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময় একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী সাহাবী মহানবী (স.) এর সামনে এসে বললেন যে- ‘ইয়া রসুলাল্লাহ, আমি মানত করেছিলাম যে, আপনাকে নিরাপদে আল্লাহ ফিরিয়ে আনলে আমি আপনার সামনে দফ বাজিয়ে গান গাইব।’ মহানবী (স.) বললেন, ‘যদি তুমি মানত করে থাক তাহলে বাজাও। মানত পূর্ণ কর। তারপর মেয়েটি দফ বাজিয়ে গান গাইতে লাগল।’ [তিরমিজি, আবু দাউদ]।

সুতরাং আল্লাহর দীনে সংস্কৃতি চর্চার প্রতিটি দ্বার উন্মুক্ত। সকল মানুষের অধিকার রয়েছে তার নিজেকে প্রকাশ করার, বুদ্ধিবৃত্তিকে বিকশিত করে তার জ্ঞানকে সামাজিক, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে ছড়িয়ে দেওয়ার। সে হিসেবে গান, নাটক, কবিতা, শিল্পচর্চা, অভিনয়, চলচ্চিত্র ইত্যাদি অঙ্গনে অশ্লীলতা, মিথ্যা, ধোঁকা, আল্লাহর নাফরমানিমুক্ত সংস্কৃতি চর্চা করার স্বাধীনতা আল্লাহ দিয়েছেন। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবনে আনন্দ-বিনোদনের প্রয়োজন আছে তবে এগুলোই জীবনের মূল কাজ নয়। জীবনের মুখ্য কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে পৃথিবীতে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবজীবনে শান্তি, ন্যায়, সুবিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।

[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১২৩০৯৭৫]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...