বলা হয়ে থাকে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, আর শিক্ষক হলো মানুষ গড়ার কারিগর। সেই শিক্ষকের হাতে যখন যৌন নির্যাতনের শিকার হয় কোমলমতি ছাত্রীরা- তখন সমাজের নৈতিক অধঃপতনের গভীরতাটি সহজেই বোঝা যায়। নুসরাত জাহান রাফি- মাদ্রাসার অধ্যক্ষের কাছে শ্লীলতাহানির শিকার হওয়া, অতঃপর ঘাতকের আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়া এক প্রতিবাদী মেয়ের নাম। এই মেয়েটি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো পিতৃসম শিক্ষকের কাছেও আজকে নিরাপদ নয় সন্তানতুল্য মেয়েরা। এ কোন সমাজে বসবাস করছি আমরা? আইয়ামে জাহেলিয়াতের সাথে আমাদের সমাজব্যবস্থার পার্থক্যটা কি খুব বেশি? যদি দুই একটি ঘটনা হত তাহলে বিষয়টিকে ‘বিচ্ছিন্ন’ মনে করার সুযোগ থাকত। বলা যেত- একটি সমাজে কিছু বিকৃতমনা ব্যক্তি থাকতেই পারেন, এতে খুব বেশি ঘাবড়াবার কারণ নেই। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর যৌন হয়রানীর ঘটনা দুই একটি নয়, শতশত ঘটছে এবং দিনকে দিন এই তালিকা হচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।
একটি পরিসংখ্যান:
কিছুদিন আগে একটি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলে শিক্ষাঙ্গনে যৌন নিপীড়ন বিষয়ে আলোচনাকালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফা রহমান রুমা। তিনি ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, এই বছর স্কুলে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে নয়টি, কলেজে যৌন হয়রানির শিকার হন একজন, ভার্সিটিতে সাত/আট জন এবং ভয়াবহ তথ্যটি হলো- এই সময়ে মাদ্রাসায় ছাত্র/ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে ২৯ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে, যাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। এই ২৯জন শিক্ষক কেবল ২৯ জন ছাত্র-ছাত্রীকেই যৌন হয়রানি করেছে তা নয়, তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে ১০০-১৫০ ছাত্র/ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এই পরিসংখ্যান কেবল থানায় যেই ঘটনাগুলো নথিভুক্ত হয়েছে তার ভিত্তিতে তৈরি। সন্দেহ নেই যে, এর চেয়ে বহুগুণ বেশি ঘটনাই থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়াবার আগেই ধামাচাপা দেওয়া হয়। কারণ বিষয়টি মানহানিকর।
যারা নিয়মিত খবর পড়েন তাদের অজানা নয়- আজকাল মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ঘনঘন শিশু ছাত্র বলাৎকারের অভিযোগ উঠছে। শুধুমাত্র ২০১৯ সালের জানুয়ারী থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে বলাৎকারের অভিযোগ উঠেছে ২১ জন মাদ্রাসাশিক্ষকের বিরুদ্ধে। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাগুলো যখন সামনে আসে, স্বভাবতই এর বিরুদ্ধে হইচই শুরু হয় এবং তখন অনেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের দ্বারা ছাত্র-ছাত্রীদের যৌন হয়রানীর ঘটনা টেনে এনে মাদ্রাসা-শিক্ষকদের অপকর্মকে জেনারেলাইজ করার চেষ্টা করেন। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা ও মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা- দু’টোর কোনোটিতেই শিক্ষকদের দ্বারা এহেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড বরদাস্ত করা যায় না। সুযোগ নেই কোনোটিকেই খাটো করে দেখার কিংবা কোনোটির পক্ষে সাফাই গাইবার। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, স্কুল-কলেজগুলো কিন্তু নৈতিক গুণসম্পন্ন ধার্মিক মানুষ তৈরির চুক্তিতে গড়ে ওঠেনি, ওগুলো গড়ে উঠেছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, সাংবাদিক, সচিব ইত্যাদি পেশাজীবী শ্রেণি তৈরির চুক্তিতে। পক্ষান্তরে মাদ্রাসা নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গড়েই উঠেছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতাসম্পন্ন এমন একটি ‘মৌলভী’ শ্রেণি তৈরির জন্য যারা কিনা সমাজে পরিচিত হন নবী-রসুলদের উত্তরসূরী হিসেবে, যাদেরকে মনে করা হয় পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতার মডেল। কাজেই, মাদ্রাসার মত প্রতিষ্ঠান, যেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তিই হয় একমাত্র নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষার্জনের জন্য, সেখানেই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের অভিযোগ কেবল উদ্বেগেরই নয়, বিস্ময়েরও।
সমস্যার গোড়ায় নজর দিতে হবে
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় খোঁজাখুঁজি কম হচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে আরম্ভ করে গণমাধ্যমগুলোতে লিখে ও বক্তব্য দিয়ে চিন্তাশীল মানুষরা নিজেদের সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করে চলেছেন। কেউ বলছেন- শিক্ষকদের আচরণবিধি শেখাতে হবে, আরও ভালোভাবে ট্রেনিং দিতে হবে। কেউ বলছেন, দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে অসৎ ব্যক্তিরা শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করছে, তাই দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। কেউ আবার বলছেন, অপরাধীকে ঠিকমত বিচারের আওতায় আনা হয় না দেখেই এত সাহস পাচ্ছে, কাজেই যৌন নিপীড়নের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিলেই, প্রকাশ্যে পাথর মেরে হত্যা করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। অনেকে বলছেন, প্রতিবাদ করতে সবাইকে রাস্তায় নামতে হবে, কেউ প্রতিবাদ করে না বলেই বারংবার এগুলো ঘটছে। আদতে তারা সমস্যার গোড়াটিই ছেড়ে দিচ্ছেন, শুধু ব্যস্ত থাকছেন ডালপালা নিয়ে। কয়টা ডাল কাটবেন তারা? একটি কাটলে আরেকটি গজাবে। বিষবৃক্ষকে সার দিয়ে, সেচ দিয়ে তাজা রেখে সেই বিষবৃক্ষের ডালপালা ছাটাই করে বিষফল থেকে নিস্তার পাওয়া যায় না।
শুধু শিক্ষাঙ্গন নয়, দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র:
মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দূষণ কেবল শিক্ষাঙ্গনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। শিক্ষাঙ্গন ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের যন্ত্রণাক্লিষ্ট একটি অঙ্গমাত্র। এরকম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আরও বহু আছে। সমাজের প্রত্যেকটি সেক্টর আজ দূষিত, বিষাক্ত! রাজনীতির নামে চলছে শক্তির দাপট। একদল আরেকদলকে কুপোকাত করার জন্য হেন অনৈতিক উপায় নেই যা অবলম্বন করছে না। এমন নয় যে, ঘটনাগুলো আমাদের দৃষ্টির আড়ালে ঘটছে। যা ঘটার তা তো দিবালোকে, আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। সেবার নামে চলছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ব্যাংকার-সাংবাদিক-ব্যবসায়ী-আমলা কেউ বাদ নেই। ঘুষ-দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে সারা দেশ। ধর্মের নামে অধর্মের চর্চা হচ্ছে বহুমুখী। কেউ ধর্মকে বানিয়েছে জীবিকার মাধ্যম, কেউ রাজনীতির হাতিয়ার, কেউ ক্ষমতার সিঁড়ি। এদিকে শিক্ষার নামে চলছে রমরমা বাণিজ্য। সর্বত্র Might is right অর্থাৎ শক্তিমানের কথাই ঠিক। যার হাতে শক্তি, যার হাতে অর্থ, যার হাতে প্রভাব-প্রতিপত্তি, তার সামনে অসহায় সমস্ত ন্যায় ও সুবিচারের বাণী।
এই যে নুসরাতকে প্রথমে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হলো এবং তার প্রতিবাদ করায় আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হলো, এটি কেবলই একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত নৈতিক স্খলন নয়। গণমাধ্যমের দেওয়া তথ্য মোতাবেক বোঝা যাচ্ছে, এর পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী একটি মহল এমন কি প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের অদৃশ্য প্রশ্রয়। তাহলে ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে কেবল নৈতিকতার গালভরা বুলি আউড়িয়ে কী লাভ হবে? সমাজের কোনো সমস্যার সমাধানই শেষ পর্যন্ত আসবে কি? পেছন থেকে রাঘব বোয়ালদেরকে না সরাতে পারলে অপরাধীরা নিজেদেরকে আইনের ঊর্ধ্বেই মনে করতে থাকবে, নুসরাতরা নির্যাতিতা হতেই থাকবে, দানবীয় অপশক্তির কাছে হার মেনে প্রাণ হারাতেই থাকবে।
এদিকে এই রাঘব বোয়ালরা রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে যে, প্রচলিত এই রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার না করে কেবল ওয়াজ-নসিহত করে কিংবা সুশীল মনোহর বাণী কপচিয়ে এদের হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলবে না। সমাজের যত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, হতে পারে সেটা মাদকব্যবসা কিংবা সন্ত্রাস, কিংবা শিক্ষাবাণিজ্য, কিংবা স্বার্থের রাজনীতি, কিংবা ধর্মব্যবসা- সবগুলোর লাভের গুড়ের ভাগিদার এই ক্ষমতাবান কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। সম্প্রতি যেই ফেনী জেলার একটি মাদ্রাসার ঘটনা নিয়ে সারা দেশে চলছে তোলপাড়, সেই ফেনীতেই শুক্রবারে চারজন ব্যক্তিকে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হলো। এরা কারা, এদেরকে মারলো কারা, সত্যিই তারা ডাকাত ছিল কিনা, গণপিটুনির নামে নির্দোষ মানুষকেই মেরে ফেলা হলো কিনা তাই বা কে জানে। এদিকে এই উত্তাল প্রতিবাদের মধ্যেই রাজধানীর একটি মসজিদের ইমামের বিরুদ্ধে ‘মনির’ নামের একটি শিশুছাত্রকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। প্রশ্ন হলো, এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কী?
বিগত ২৪ বছর যাবৎ হেযবুত তওহীদ এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছে। আমরা সেটা শুনেছি কিন্তু অনুধাবন করিনি, অনেকে অনুধাবনও করেছি কিন্তু সাড়া দিইনি, অনেকে তিরস্কার করেছি, কেউ কেউ বিরোধিতাও করেছি। তাই বলে কিন্তু সমাজের পতন থেমে থাকেনি। আবার শত অপমান, নির্যাতন আর বিরোধিতা সত্ত্বেও একদিনের জন্য হেযবুত তওহীদের সংগ্রামও বন্ধ থাকেনি। হেযবুত তওহীদ আজও সেই পরশপাথর নিয়ে মাঠে আছে, যেই পরশপাথর দিয়ে আল্লাহর রসুল ঘুনে ধরা পতনোন্মুখ আরব সমাজকে পরিশুদ্ধ করে, এক রেনেসাঁর জন্ম দিয়ে, পৃথিবীর বুকে ন্যায়, সত্য ও নৈতিকতার শক্তিতে বলিয়ান উন্নত জাতি গঠন করেছিলেন। আমরা ইচ্ছা করলেই সেই পরশপাথর ব্যবহার করে পুনরায় আমাদের সমাজের চিত্র পাল্টে দিতে পারি।
তওহীদ: মুছে দিল জাহেলিয়াতের জঞ্জাল
শুধু নারী হয়ে জন্ম নেবার অপরাধে আজকে তনু, নুসরাতরা লাশ হয়ে যায়। কোথাও কোনো মেয়ের নিরাপত্তা নেই, ইজ্জতের নিশ্চয়তা নেই। এত পুলিশ, এত বাহিনী, এত আইন-আদালত, নারীবাদী সংগঠন থাকার পরও লাভ হচ্ছে না। এমনই বিভীষিকাময় অবস্থা ছিল আইয়ামে জাহেলিয়াতের আরবদের। নারীদের কোনো ইজ্জতের মূল্য ছিল না। তাদেরকে কতটা অবাঞ্ছিত মনে করা হত তা বোঝা যায় এই থেকে যে, কারো ঘরে কন্যা সন্তানের জন্ম হলে লজ্জায় অপমানে তার মাথা নিচু হয়ে যেত। অনেকে সেই কন্যা সন্তানকে জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে আসত লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য। নারী ছিল ভোগ্যপণ্য, প্রকারান্তরে যৌনদাসী।
ওই সমাজে যত অপকর্ম চলত তার সুবিধাভোগী ছিল তৎকালীন প্রভাবশালী মহল- ধর্মব্যবসায়ী ও গোত্রপতিরা। রক্ষকরাই হয়ে উঠেছিল ভক্ষক। আল্লাহর রসুল তাদের সামনে তওহীদের মশাল জ্বেলে ধরলেন। জাতিকে ডাকলেন কেবল একটি কথার দিকে- ‘বলো, আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানি না।’ বহু ঘাত-প্রতিঘাত শেষে, বহু নির্যাতন-নিপীড়ন ও রক্তপাত শেষে, বহু সত্যনিষ্ঠ প্রাণের কোরবানি শেষে, যখন নির্যাতিন-নিপীড়িত-শোষিত-বঞ্চিত মানুষ সেই ঘোষণাটি দিল- মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আরবের চেহারা পাল্টে গেল। যেই আরবের বাতাসে তখনও নির্যাতিতা নারীর কান্নার আওয়াজ ভাসত, সেই আরবে এমন ন্যায়, সুবিচার ও নিরাপত্তা কায়েম হলো যে, দিনে ও রাতে একা একজন যুবতী সুন্দরী মেয়ে সানা থেকে হাদরামাউত প্রায় তিনশ মাইল পথ হেঁটে যেত তার মনে আল্লাহ এবং বন্য জন্তুর ভয় ছাড়া অন্য কোনো ভয় জাগ্রত হত না। ক্ষমতাবানের ক্ষমতা, সম্পদশালীর সম্পদ, বলবানের বল, জ্ঞানীর জ্ঞান, বক্তার বক্তব্য, যোদ্ধার যুদ্ধাস্ত্র, লেখকের লেখা, কবির কবিতা- সমস্তকিছুই ব্যবহৃত হতে লাগলো মানবতার কল্যাণে ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। জন্ম হলো এক মহান সভ্যতার।
কোনো সভ্যতাই চিরস্থায়ী হয় না। কারণ সভ্যতার ধারণকারীরা সময়ের ব্যবধানে আদর্শচ্যুত হয়। তওহীদের ভিত্তিতে আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবীরা যে সভ্যতাটি গড়ে দিয়ে গেলেন, সেটি বিগত হাজার বছরের কালপরিক্রমায় ক্ষয় হতে হতে যখন বিলুপ্তপ্রায়, তখন পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী দাজ্জালীয় সভ্যতা সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে সমস্ত পৃথিবীতে কায়েম করল এক নৈরাজ্যময় শাসনব্যবস্থা।
আমরা মুসলিমরা যখন প্রকৃত মুসলিম ছিলাম, মো’মেন ছিলাম, উম্মতে মোহাম্মদী ছিলাম, অর্থাৎ তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম, আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস কোনো অপশক্তির ছিল না। আমরা ছিলাম বিজয়ী জাতি। কিন্তু আজ থেকে প্রায় তিনশ’ বছর আগে ব্রিটিশরা যখন আমাদেরকে দখল করতে আসলো, তখন আমরা সেই দুর্ধষ, শক্তিশালী, বিজয়ীর জাতি নেই; তখন আমরা ঐক্যহীন, উদ্দেশ্যহীন, নেতৃত্বহীন, বিশৃঙ্খল একটি জনগোষ্ঠীমাত্র। ব্রিটিশদের কাছে সামরিকভাবে পরাজিত হয়ে যেই না ব্রিটিশের গোলামে পরিণত হলাম, আমাদের গলদেশ থেকে তওহীদের রজ্জু খসে গেল। আমাদের ইলাহ অর্থাৎ হুকুমদাতা তখন আল্লাহ রইলেন না, হুকুমদাতার আসনে বসে পড়ল ব্রিটিশ খ্রিষ্টানরা।
বিষবৃক্ষের চারা রোপন করল ব্রিটিশরা
আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থাকে বাতিল, নিষ্ক্রীয় করে দিয়ে ব্রিটিশরা আমাদের উপর চাপিয়ে দিল তাদের নিজেদের তৈরি ধর্মহীন বস্তুবাদী দাজ্জালীয় সভ্যতার তন্ত্র-মন্ত্র, বাদ-মতবাদ। আমাদের রাজনৈতিক জীবন কীভাবে চলবে, অর্থনৈতিক জীবন কীভাবে চলবে, বিচারিক জীবন কীভাবে চলবে, শিক্ষাজীবন কীভাবে চলবে ইত্যাদি সমস্তকিছু নির্ধারিত হলো আল্লাহর হুকুমের বিপরীতে ব্রিটিশের হুকুম মোতাবেক, পাশ্চাত্যের তৈরি ব্যবস্থা বা সিস্টেমে। বলা বাহুল্য, তারা ব্যবসার জন্য এসেছিল, শোষণ করতে এসেছিল। তাই কোনোদিনই তারা আমাদের ভালো চায়নি। কাজেই তারা এমন রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দিল যাতে আমরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, চিরজীবনের জন্য তাদের গোলামীর শিকলে আবদ্ধ হয়ে যাই, তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি। তারা এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দিল যা চিরদিনের জন্য পাশ্চাত্যের অপশাসন ও শোষণের পথকে নিষ্কণ্টক করে রাখে, কোনো কারণে আপাত ভৌগোলিক স্বাধীনতা দিয়ে চলে গেলেও যেন পরোক্ষভাবে শাসন ও শোষণের ধারা অব্যাহত থাকতে পারে।
তারা স্কুল-কলেজ স্থাপন করে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে নৈতিকতাহীন, ধর্মীয় মূল্যবোধহীন, নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে হীনম্মন্যতায় আপ্লুত দাস মনোবৃত্তির একটি শিক্ষিত কেরানী শ্রেণি তৈরির ব্যবস্থা করল। অন্যদিকে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে এবং সেই মাদ্রাসার সিলেবাস ও কারিকুলাম নিজেরা বসে তৈরি করে, এমনকি নিজেরা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হয়ে মুসলিমদের মনে-মগজে আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামের বিপরীতে এমন একটি বিকৃত ইসলাম ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হলো যা বাইরে থেকে দেখতে প্রকৃত ইসলামের মত মনে হলেও বাস্তবে, চরিত্রে, আত্মায় ঠিক প্রকৃত ইসলামের বিপরীত একটা কিছু। ওই ইসলামে আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা বলে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা রইলো না, কলেমার ইলাহ শব্দের অর্থ হুকুমদাতা থেকে বদলে ‘মাবুদ’ বা উপাস্য হয়ে গেল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের ঈমানী বাধ্যবাধকতাও মুছে দেওয়া হলো, আত্মার বিরুদ্ধে জিহাদই হয়ে গেল বড় জিহাদ। একটি প্রাণবন্তু পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন জীবন-দর্শন ইসলামকে বানিয়ে ফেলা হলো দাড়ি টুপি, পাগড়ি-মেসওয়াক, ঢিলা-কুলুখ, পায়জামা-পাঞ্জাবি, বোরখা ইত্যাদি পোশাকী ও বাহ্যিক প্রদর্শনীমূলক বিষয়ে।
দুঃখের বিষয় হলো, ব্রিটিশের সেই ষড়যন্ত্র আমরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি, যার ফল হয়েছে এই যে, তারা আজ থেকে ৭০ বছর আগেই আমাদেরকে স্বাধীনতা দিয়ে নিজেদের দেশে ফিরে গেলেও আমরা স্বাধীনতা নিতে পারিনি। আমরা আজও পরাধীনতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছি। ব্রিটিশের চাপিয়ে দেওয়া ষড়যন্ত্রমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থাই আমাদের জীবনে বলবৎ রেখে অন্যায়, অবিচার, অনাচার, অশান্তির সাগরে দিকভ্রান্ত জাহাজের ন্যায় ভেসে চলেছি আমরা। যেই শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যই ছিল অনৈতিক, সেই শিক্ষাব্যবস্থা কখনই নৈতিকতা শিক্ষা দিতে পারে কি? সেই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সিরাজ উদ্দৌলার মত ব্যক্তিই তৈরি হওয়া স্বাভাবিক নয় কি?
কাজেই, আর দোষাদোষী নয়, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি নয়, এখন দরকার সম্মিলিত সিদ্ধান্তের। যেই বিষফল আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ভোগ করতে হচ্ছে, তার বিষবৃক্ষকে চিহ্নিত করতে হবে। ঔপনিবেশিক আমলের ষড়যন্ত্রমূলক অনুপোযোগী, জীর্ণ অচল ব্যবস্থা আর চলতে পারে না, এর কার্যকারিতা নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে। আজকের এই ক্রান্তিকালে জাতির আদর্শের সঙ্কটের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে অনেকেই অনেক প্রস্তাব উত্থাপন করছেন। কিন্তু হেযবুত তওহীদ উত্থাপন করছে সেই প্রস্তাবটি, যেটি আল্লাহর রসুল করেছিলেন আরবদের উদ্দেশ্যে; তোমরা বলো- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানি না।’ আসুন আমরা তওহীদের এই ঘোষণার মাধ্যমে আমাদের সমাজের সাথে, জীবনের সাথে, মননের সাথে, চিন্তার সাথে, ঐতিহ্যের সাথে, সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় এমন একটি মহান সভ্যতা নির্মাণের পথে পা বাড়াই।