মোখলেসুর রহমান
কোন জনসমষ্টির উপর কতৃত্ব করা, ভিন্ন অর্থে সেবা করার সুযোগ যারা পান নিঃসন্দেহে তারা মহা সৌভাগ্যবান। কারণ, অধিকাংশ মানুষ থেকে অল্প সামান্য লোকই এই মহাসুযোগটি লাভ করে থাকেন। মানুষ হিসেবে মানুষের সেবা করার সুযোগে তারা নিজেদেরকে ধন্য মনে করেন। কিন্তু এ সুযোগ লাভের পর তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ পান আবার অধিকাংশ লোকই ব্যর্থ হয়। যারা এই সুযোগের সঠিক ব্যবহার করতে পারেন তারা পার্থিব জীবনে যেমন সম্মানের অধিকারী হোন তেমন পরকালেও আল্লাহর পক্ষ থেকে এর জন্য মহা পুরস্কার লাভ করবেন। কিন্তু এ উভয়প্রকার সুযোগ গ্রহণের জন্য তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, মহা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা থেকে বিরত থাকতে হয়। একজন শাসকের ভূমিকা হয় অনেকটা ঐ পাতিলের ন্যায় যার উপর দিয়ে অনেক সুস্বাদু খাবার রান্না হয়, কিন্তু সে নিজে কখনো সে খাবারের স্বাদ চেখে দেখতে পারে না। একটি রান্নার পাতিলের সাধারণত কোন অনুভূতি শক্তি নেই। সুতরাং এ ব্যাপারে তার কোন প্রতিক্রিয়া থাকার কথা নয়। কিন্তু মানুষের অনুভূতি আছে বলেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তবে ক্ষমতার স্বাদ ভোগ না করে মানুষের উন্নয়ন সাধন ও উপকার করে যে স্বাদ, আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায় তা পৃথিবীর আর কোন প্রাপ্তি দিয়ে পূরণ করা যাবে না।
অপরদিকে পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই ক্ষমতা মানুষকে অনেক ক্ষেত্রেই অসৎ করে ফেলে। স্বভাবতই প্রাকৃতিক নিয়মে যা হওয়ার তাই হয়। প্রবল পরাক্রমশালী রাজা-বাদশাহকেও মানুষের করুণা ভিক্ষা করে বাঁচতে হয়। আবার অর্ধদুনিয়ার খলিফা ওমরের (রা.) এর মত এমন নজীরও আছে যিনি খেজুরের পাতার তৈরি মসজিদে বসে শাসন করেছেন। পথিক কিছুতেই পার্থক্য করতে পারত না কে সাধারণ মানুষ আর কে খলিফা। আবার আমরা ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)কেও দেখি যিনি একদিকে পুরো আরবের অধিপতি, অথচ জীবিকা নির্বাহ করতেন মাথায় করে বাজারে নিয়ে কাপড় বিক্রি করে। অতপর সাধারণের অনুরোধে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যে যৎসামান্য অর্থ গ্রহণ করেছেন তাও এন্তেকালের আগে নিজের বাগান বিক্রি করে তার অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দিয়ে দেওয়ার জন্য আদেশ করে গেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যতটুকু বরাদ্দ পেতেন তা থেকে তাঁর স্ত্রী কিছু কিছু বাঁচিয়ে একদিন ভাল খাবারের আয়োজন করেছেন জানতে পেরে তিনি প্রতিদিনের ঐ অতিরিক্ত অংশটুকু বাদ দিয়ে বরাদ্দ চালু রাখার আদেশ দিলেন। যুক্তি হিসেবে তিনি বললেন, যেহেতু ঐ অংশটুকু ছাড়াই তাঁর সংসার চলেছে তাই ভবিষ্যতেও চলবে।
বর্তমান যুগে এমন শাসক নেই বললেই চলে। তাই সাধারণ মানুষও আজ সেই শান্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অবশ্য আজকের যুগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে জনকল্যাণের কাজ বলে গণ্য করা হয় না। বরং তা নিজেদের আখের গোছানোর মহাসুযোগ বলে ধরা হয়। কাগজে-কলমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় জনগণের সেবক হলেও মূলত তারাই জনগণের প্রভু হয়ে দাঁড়ায়। এরা জনগণের কাছ থেকে উৎকোচ নেন, কাজ আটকে দিয়ে, চাপে ফেলে অর্থ আদায় করেন, হয়রানি করেন। অথচ এর নৈতিক অধিকার তাদেরকে কেউ দেয়নি। না আল্লাহ দিয়েছেন, না মানবরচিত জীবনব্যবস্থাগুলো দিয়েছে। উভয়প্রকার জীবনব্যবস্থায় বরং রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাকে জনগণের সেবক বলেই পরিচয় করিয়ে দেয়। বিনিময়ে তারা রাষ্ট্র থেকে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। তাই তারা জনসেবা করতে একপ্রকারে বাধ্যও বটে। যথাযথ কাজ না করে এর উল্টোটা করাতেই আজ আর মানুষ তাদেরকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করে না।
আজ যারা সত্যিকার মানবতার কল্যাণ ও মানবতার সেবার জন্য নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছেন, নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করেছেন তাদেরকে সত্যিকার অর্থেই সেই পাতিলের ন্যায় হতে হবে। নিজেদের মাধ্যমে জনগণের বহু সম্পদের লেনদেন হবে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সাধিত হবে, কিন্তু তা থেকে অন্যায়ভাবে সামান্য অংশও ভোগ করা চলবে না। অবশ্য এটা তাদের সম্মানের সাথে মানাও না। তাদেরকে দেখিয়ে দিতে হবে সময়ের তালে কিংবা মিথ্যার সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের মধ্যেও সততা নিয়ে টিকে থাকা যায়। এই সততার মাধ্যমেই সাধারণ মানুষের ভালবাসা আদায় করে নিতে হবে। সততার প্রবল শক্তির তোড়ে মিথ্যাবাদীরা ভেসে যাবে। যারাই আজ ক্ষমতার জোরে জোর করে মানুষকে ভালবাসার অভিনয় করতে বাধ্য করছে, একদিন তারাই তাদেরকে প্রতিরোধ করবে। অন্যায়, মিথ্যা পালাতে বাধ্য হবে। নিজেদেরকে সেই আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে দুনিয়ার সম্মান এবং পরকালের পুরস্কার উভয়ই তাঁদের পদচুম্বন করবে।