মিজানুর রহমান
আল্লাহ বলেছেন যে তিনি মানুষকে এবাদত করা ভিন্ন অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেন নি। তাহলে কী সেই এবাদত? বর্তমানে আলেমরা ওয়াজে নসিহতে মানুষকে কেবল নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদি করার জন্য উপদেশ দেন, এগুলোকেই তারা এবাদত ও ধর্মকর্ম বলে মনে করেন। প্রকৃত অর্থে নামাজ, রোজা করাই কেবল মানুষের এবাদত নয়। এবাদত কথাটির অর্থ হচ্ছে যে জিনিসকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেই কাজ করা। একটি ঘড়ি তৈরি করা হয়েছে সময় দেখানোর জন্য, এটা করাই তার এবাদত। সূর্য সৃষ্টি করা হয়েছে আলো, তাপ ইত্যাদি দেওয়ার জন্য, এগুলো দেওয়াই তার এবাদত। মানুষকে যে জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেটা আগে জানতে হবে। কারণ সেটা করাই তার এবাদত। মানুষকে কি মসজিদে, মন্দিরে, গির্জা, প্যাগোডায় গিয়ে বসে থাকার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে?
আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতিনিধি (Representative) হিসাবে (সুরা বাকারা-৩০)। অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টিকে আল্লাহ যেভাবে সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ রেখেছেন ঠিক সেভাবে এ পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল রাখাই মানুষের এবাদত। মানুষের মধ্য থেকে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, যুদ্ধ, রক্তপাত ইত্যাদি দূর করে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের প্রচেষ্টাই হলো মানুষের এবাদত। ধরুন আপনি গভীর রাত্রে প্রার্থনায় মগ্ন। হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে ‘আগুন আগুন’ বলে আর্তচিৎকার ভেসে এল। আপনি কী করবেন? দৌড়ে যাবেন সাহায্য করতে নাকি চোখ-কান বন্ধ করে প্রার্থনা চালিয়ে যাবেন। যদি আগুন নেভাতে যান সেটাই হবে আপনার এবাদত। আর যদি ভাবেন- বিপন্ন ব্যক্তি অন্য ধর্মের লোক, তাহলে আপনার মধ্যে মানুষের ধর্ম নেই, আপনার নামাজ-রোজা, প্রার্থনা সবই পণ্ডশ্রম।
প্রকৃতপক্ষে এবাদত হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব। মুসার (আ.) দায়িত্ব অর্থাৎ এবাদত কী ছিল তা আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ফেরাউনের নিকট যাও, সে দারুণ উদ্ধত হয়ে গেছে (সুরা ত্বা-হা: ২৪)। আল্লাহ তাঁকে ফেরাউনের কাছে পাঠালেন অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ইহুদি জাতিকে দাসত্বের কবল থেকে মুক্ত করে তাদের মানবাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, মানবতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
মানুষের প্রকৃত এবাদত হলো মানবতার কল্যাণে কাজ করা। আল্লাহ বলেছেন, পূর্ব এবং পশ্চিমদিকে তোমাদের মুখ ফিরানোতে কোন পুণ্য নেই। কিন্তু পুণ্য আছে কেউ আল্লাহর উপর, কিয়ামত দিবসের উপর, মালায়েকদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসুলগণের উপর ঈমান আনবে, আর আল্লাহরই প্রেমে স¤পদ ব্যয় করবে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও দাসমুক্তির জন্যে। আর যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা স¤পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই মুত্তাকী (সুরা বাকারা ১৭৭)। সুতরাং মানুষ কী করলে শান্তিতে থাকবে, দরজা খুলে ঘুমাবে সেই লক্ষ্যে কাজ করাই হলো এবাদত। এবাদতের সঠিক অর্থ না বোঝার কারণে নির্যাতিতের হাহাকার, ক্ষুধার্তের ক্রন্দন মহা ধার্মিকদের কানে প্রবেশ করে না। এগুলোকে দুনিয়াবি কাজ বলে এড়িয়ে যাবার মতো পাশবিক মনোবৃত্তি তাদের তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি নামাজ, রোজা, হজ্ব করতে হবে না? হ্যাঁ, অবশ্যই করতে হবে, কিন্তু আকিদা বুঝে। মানুষের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার শারীরিক সক্ষমতা ও আত্মিক শক্তি ও প্রবণতা সবার থাকে না। এটা সৃষ্টির প্রশিক্ষণ (Training) হচ্ছে নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদি। এগুলো উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষণ, উদ্দেশ্য হচ্ছে শান্তি। যে মানবতার কল্যাণে সংগ্রাম করবে না, অন্য মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘোঁচাতে সম্পদ ব্যয় করবে না, তার তাহাজ্জুদ হবে ঘুম নষ্ট করা, রোজা হবে না খেয়ে থাকা; অন্য আমলের কী দশা হবে ভেবে দেখুন। এটা আমার কথা নয়, স্বয়ং মহানবীর বাণী (ইবনে মাজাহ, আহমাদ, তাবারানী, দারিমি, মেশকাত)। আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবীরা আজীবন মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, এটা করতে গিয়ে তাঁরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। সকল ধর্মের অবতার ও মহামানবদের জীবনেও রয়েছে শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। অথচ আজকের সমাজে মানুষের ধর্মীয় জীবনের নেতৃত্ব দানকারী এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী আলেম-পুরোহিতরা মানুষকে কেবল পরকালমুখী হতে শিক্ষা দেন। ফলে দেখা যায়- লেবাসে-সুরতে যে যত বড় ধার্মিক কার্যক্ষেত্রে সে তত বেশি নির্বিরোধী। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ইচ্ছা বা সাহস কোনোটাই তাদের থাকে না। কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে তারা এবাদত মনে করেন না, এবাদত বলতে কেবল নামাজ-রোজাই বোঝেন। এ জন্য উপাসনালয়ের চার দেওয়ালের অভ্যন্তরকেই তারা বেছে নিয়েছেন। ফলে বিশ্বজোড়া এদের দুর্গতিও সীমাহীন।
[০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫]